টাটা ন্যানো থেকে তাপসী মালিক, কেন বারবার মমতার মুখে বিকৃত প্রসঙ্গ?
Singur Tata Nano Controversy: কী এমন কারণ ঘটল যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমান রাজ্যের রাজনৈতিক চালচিত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটি পুরনো ঘটনা তুলে ধরলেন?
২০০৮ সালে সিঙ্গুর থেকে টাটা ন্যানো প্রকল্প সরে যাওয়ার দায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নয়। তার জন্য দায়ী ছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। শিলিগুড়িতে একটি বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠান থেকে এমনই মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা দাবি করেন, কেউ কেউ নাকি তাঁর ব্যাপারে কিছু বাজে কথা রটিয়ে বেড়াচ্ছে, তিনি নাকি টাটাদের সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু, সেটা সত্যি নয়। মমতা দাবি করেছেন, তৎকালীন শাসক সিপিএম কৃষকদের থেকে জোর করে জমি ছিনিয়ে নিয়েছিল, আর ক্ষমতায় আসার পর তিনি সেই জমি ফিরিয়ে দিয়েছেন কৃষকদের। পাশাপাশি, কালীপুজোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে তাপসী মালিকের প্রসঙ্গ তুলেও বামফ্রন্টকে একহাত নিয়েছেন মমতা। বলেছেন, “সিপিএম কৃষক বিরোধী। কৃষক খুন করেছে। তাপসী মালিকের মতো মেয়েকে খুন করেছে।” ইতিমধ্যেই রাজ্য রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই দু’টি মন্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক।
সিঙ্গুর থেকে টাটা ন্যানো প্রকল্প নিয়ে গুজরাতে চলে যাওয়ার সময় টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা একটি সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন। সেখানে তিনি সরাসরি তৎকালীন বিরোধী নেত্রী তথা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে বলেছিলেন, “আমি বলেছিলাম আমার মাথায় বন্দুক ঠেকালেও আমি ন্যানো প্রকল্প ছেড়ে যাব না। কিন্তু মমতা তো সোজা ট্রিগার টেনে দিলেন।” বর্তমানে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মাথা পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে ডুবে রয়েছে, সেখানে ১৪ বছর পর মমতার এহেন একটি মন্তব্য স্বাভাবিকভাবেই তৈরি করেছে বিতর্ক। শিলিগুড়িতে করা ওই মন্তব্যের জেরে মমতার বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ তুলেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার পশ্চিমবঙ্গ ছাড়ার আগে করা ওই মন্তব্য প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেছেন, “মমতা মাথায় বন্দুক ধরে ট্রিগার টিপে দিলেন বলেই তো সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যেতে হল, সে কথা তো রতন টাটা নিজেই বলেছেন।”
ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সিঙ্গুরে মধ্যবিত্তদের জন্য গাড়ি (টাটা ন্যানো) তৈরির একটি কারখানা তিনি স্থাপন করবেন। টাটা গ্রুপের ইচ্ছে জানতে পেরে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাগ্রহে টাটাদের পশ্চিমবঙ্গে ডেকে আনেন। এই পুরো পরিকল্পনায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সাহায্য করেছিলেন তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী তথা বাম সরকারের সেকেন্ড ইন কমান্ড নিরুপম সেন।
কিন্তু উর্বর কৃষি জমি দখল করে শিল্প তৈরি হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে রীতিমতো জমি আন্দোলন শুরু করে দেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। এর পরের পর্যায়ে পরপর দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রথমত, টাটারা বাধ্য হয় সিঙ্গুর থেকে প্রকল্পটি নিয়ে নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাতের সানন্দে চলে যেতে। সেখানে সানন্দে থেকে পরে ন্যানো গাড়ি বাজারজাত করা হয়। আর দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে ঠিক তিন বছর পর, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সপ্তম বাম সরকারের পতন।
আরও পড়ুন- কৌশল না স্মৃতিভ্রম! টাটা তাড়ানোর ইতিহাস নিয়ে মমতার মন্তব্যে দানা বাঁধছে জল্পনা
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী, সংবাদ মাধ্যমের কর্মী এবং সুশীল সমাজের মধ্যে এখনও সিঙ্গুর আন্দোলনের সেই ঘটনার স্মৃতি তাজা। সকলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই অনুষ্ঠান এবং আন্দোলনের ব্যাপারে জানেন। তাহলে কী এমন কারণ ঘটল যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমান রাজ্যের রাজনৈতিক চালচিত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটি পুরনো ঘটনা তুলে ধরলেন? তাও আবার পুরোপুরি বিকৃত একটি ভাষ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে?
এবার দেখা যাক সেদিনের ঘটনা পরম্পরা ঠিক কেমন ছিল? বুধবার শিলিগুড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠান থেকে করা মন্তব্য রীতিমতো বিতর্ক তৈরি করেছে রাজনৈতিক মহলে। ইতিহাস বলছে, ২০০৬ সালের ১৮ মে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সিঙ্গুর অঞ্চল থেকে মধ্যবিত্তদের জন্য একটি ছোট গাড়ি তৈরির কারখানা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা। মুহূর্তের মধ্যেই সারা বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল হুগলির ওই ছোট্ট গ্রামটি। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের কাছেও বিষয়টা ছিল একেবারে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। ফলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং নিরুপম সেন টাটাদের ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য নেমে পড়েন মাঠে। সিঙ্গুরে ৯৯৭ একর কৃষি জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন বাম সরকার। কলোনি জমি অধিগ্রহণ আইন ১৮৯৪ অনুসারে সেই জমি অধিগ্রহণ করেছিল বাম সরকার। তবে সিঙ্গুর প্রথম থেকেই ছিল কৃষি নির্ভর একটি এলাকা। প্রায় ১৫ হাজার জন মানুষ ওই জমির ফসলের উপর ছিলেন সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। এই জমি অধিগ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে কেবলমাত্র ১,০০০টি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় টাটা, যার মধ্যে অনেকেই এমন ছিলেন, যারা সিঙ্গুরের বাসিন্দাই নন। ফলে স্বভাবতই সিঙ্গুরের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। পরিবেশবিদরাও একই আন্দোলনের সামিল হন। তাঁরা দাবি রাখেন, যদি সিঙ্গুরে এই প্রজেক্ট তৈরি করা হয়, তাহলে এই জমি এবং সিঙ্গুরের আশেপাশের অন্যান্য জমিও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। আর এখান থেকেই বাম সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার অক্সিজেন পান তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এমনিতেই, ১৮৯৪ জমি অধিগ্রহণ আইন ভারতীয় সংবিধানের সুখ্যাত ধারাগুলির মধ্যে স্থান পায় না। পরিবেশ কর্মীদের পাশাপাশি, অর্থনীতিবিদরাও এই আইনকে অর্থনৈতিক শিথিলতার কারণ বলে দাবি করে থাকেন। ২৫ মে থেকে ৯৯৭ একর কৃষি জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শুরু হয় বিক্ষোভ। আর সেই বিক্ষোভের পুরোধা ছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। গোপালনগর, বেড়াবেড়ি, বাজেমেলিয়া, সিংহের ভেড়ি, খাসেরভেড়ির মতো কিছু জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। ২৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভকারীদের উপরে পুলিশি হামলার অভিযোগ ওঠে এবং এই হামলায় আহত হন বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী। এই হামলার পরেই সমগ্র জমি আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর সিঙ্গুরে গিয়ে আক্রান্ত হন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই হামলার রেশ সরাসরি এসে পৌঁছয় রাজ্য বিধানসভায়।
বিরোধী দল তৃণমূলের বিধায়কের একাংশ বিধানসভার আসবাবপত্র ভাঙচুর করেছিলেন বলে অভিযোগ করে বাম শিবির। গড়ে ওঠে অনিচ্ছুক কৃষকদের একটি জোট। সেই জোটের নেতৃত্ব দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরানোর দাবিতে ২৬ দিন ধর্মতলার মোড়ে অনশন অবস্থান করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাঠে নামেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। তাঁর তৎপরতায় রাজভবনে মমতার অনশনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। মমতার সেই অনশন মঞ্চে আসেন বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীরা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর পাশাপাশি সেদিন সমর্থন এসেছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকেও। অনশন মঞ্চে সরাসরি চিঠি পাঠিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রীদের সনির্বন্ধ অনুরোধে অবশেষে অনশন প্রত্যাহার করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আন্দোলনের আঁচ আরও তীব্র হয় যখন ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ১৬ বছরের কিশোরী তাপসী মালিককে ধর্ষণ করে খুন করা হয় এবং প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে তাঁর দেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আর এই পুরো ঘটনায় অভিযোগের তির ওঠে সিপিআইএমের দিকে। বিশেষত সুহৃদ দত্ত এবং দেবু মালিকের বিরুদ্ধে উঠেছিল ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করে খুন করার অভিযোগ। সিঙ্গুরের যে যে এলাকা টাটার এই কারখানার জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেই এলাকার মধ্যেই পড়ে এই বাজেমেলিয়া। আর সিঙ্গুরের টাটাদের কারখানা থেকেই উদ্ধার হয় তাঁর আধপোড়া মৃতদেহ। মৃত্যুর পরে তাপসী রাতারাতি সংবাদের শিরোনামে চলে আসেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো তাঁকে সিঙ্গুর জমি মামলার শহিদ হিসাবে তুলে ধরেন। তাপসীর মৃত্যু নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। এক পক্ষের যুক্তি ছিল, তাপসী মালিককে ধর্ষণ করে তারপর খুন করা হয়েছে। অন্যপক্ষের যুক্তি ছিল, তাপসী আত্মহত্যা করেছেন বাবার কাছে বকুনি খেয়ে।
তবে, কারণ যাই হোক না কেন, সেই সময়ে তাপসীকে সামনে রেখেই নতুন করে উত্তাল হয়ে ওঠে সিঙ্গুর। এলাকায় দাপুটে সিপিআইএম নেতা হিসাবে পরিচিত সুহৃদ দত্ত ও দেবু মালিক গ্রেফতার হন বাম আমলেই। প্রথমে স্থানীয় পুলিশ এবং পরে সিআইডি তদন্তের ভার নিলেও তাতে ঘোর আপত্তি জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত তার দাবি মেনে নিয়ে ঘটনার তদন্ত করতে আসে সিবিআই।
পাশাপাশি জমি হারা কৃষকের আত্মহত্যা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। চাপে পড়ে, মে মাসে সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো প্রকল্প রূপায়ণের পথ সুগম করতে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করতে বসেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে সেই আলোচনায় কোনও সুরাহা মেলেনি। ২১ মে রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে সিঙ্গুরসহ একাধিক এলাকায় বড় মার্জিনে জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস। অগাস্ট মাসে নতুন করে শুরু হয় জমি রক্ষা আন্দোলন। ২৪ অগাস্ট থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে অবস্থান বিক্ষোভ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ততদিনে গাড়ি প্রদর্শনীতে আত্মপ্রকাশ করে ফেলেছে রতন টাটার স্বপ্নের গাড়ি টাটা ন্যানো। ফলে, ফ্যাক্টরি স্থাপন করা হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী।
চাপ বাড়তে শুরু করে বাম সরকারের উপর। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানান, অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি না নিতে সরকার সম্মত। পাশাপাশি সরকার ক্ষতিপূরণের কথাও ঘোষণা করে। কিন্তু, বাম সরকারের এহেন ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হন রতন টাটা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাটা ন্যানো বাজারজাত করার চাপ সেই মুহূর্তে তাঁর মাথায়। ফলে বাম সরকারের আশায় বসে না থেকে ৩ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরে কারখানা নির্মাণের কাজ স্থগিত করে দেয় টাটা মোটরস। তখন থেকেই শুরু হয় অন্য রাজ্যে জমি খোঁজার কাজ।
আরও পড়ুন- গৌতম দেবকে মনে পড়ে মিথ্যে আর দুর্নীতির পচা শামুকে পা কাটা রাজ্যবাসীর?
এর ঠিক এক মাস পরে ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প সারানোর ঘোষণা করে দেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের শিল্পের প্রতি আগ্রহ দেখেই তিনি সিঙ্গুরে টাটা ন্যানো কারখানা তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেরকম আন্দোলন করবেন সেটা তিনি ভাবতে পারেননি। তাঁর মাথায় বন্দুক ঠেকালেও তিনি তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতেন, তবে মমতা তো সরাসরি ট্রিগার টেনে দিলেন। ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, ন্যানো কারখানা স্থানান্তরিত হবে নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাতের সানন্দে।
২০১১ সালে নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুর ইস্যুকে হাতিয়ার করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জয়ের পরেই প্রতিশ্রুতি মতো তিনি অনিচ্ছুক কৃষকদের হাতে জমি ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। তবে এই জমি ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ এতটা সহজ ছিল না। ৯ জুন জমি ফেরানোর লক্ষ্যে একটি আদেশ জারি করা হলেও এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে টাটা গোষ্ঠী। এরপরে চলে দীর্ঘ মামলা-মোকদ্দমার পালা। জমি পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে এক দিকে থাকে টাটা আর অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য সরকার।
২০১৬ সালের ৩১ অগাস্ট এই মামলায় ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। জানানো হয়, বাম জমানায় আইন মেনে জমি নেওয়া হয়নি ফলে ১২ সপ্তাহের মধ্যে টাটাকে জমি ফেরানোর নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। কিন্তু ততদিনে, গুজরাটের সানন্দ হয়ে উঠেছে ভারতের অন্যতম একটি অটোমোবাইল অ্যানসিলিয়ারি এবং অটোমোবাইল প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। রতন টাটা স্বপ্নের প্রকল্প ব্যর্থ প্রমাণিত হলেও, বিকল্প শিল্পের জায়গা থেকে ততদিনে বেশ উন্নতি করে ফেলেছে সানন্দ।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরো সরকার সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতির অভিযোগে ডুবে। তাপসী মালিকের মৃত্যুর সময়ে তিনি যে সিবিআইয়ের তদন্তের দাবি রেখেছিলেন, আজকে সেই সিবিআই নিয়েই তাঁর মাথাব্যাথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার নম্বর টু পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ শিক্ষা দপ্তরের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় পদাধিকারীরা এই মুহূর্তে জেলে। তার পাশাপাশি কয়লা, গরু পাচার, বালি পাচার, খাদ্যশস্য পাচার এবং লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি বিক্রি করা সহ বিভিন্ন অভিযোগে জর্জরিত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা। এমনকী মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধেও চলছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ও ইডির তদন্ত। এমন একটা পরিস্থিতিতে মমতার ১৪ বছর আগেকার টাটা প্রসঙ্গ উত্থাপন কি মানুষের নজর ঘোরানোর লক্ষ্যেই? নাকি পশ্চিমবঙ্গে বামের উত্থান নতুন করে ভাবাতে শুরু করেছে মমতাকে?