রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তেহার কতটা ভরসাযোগ্য, ফাঁকগুলি কী কী?
Lok Sabha Election 2024 Manifesto: কংগ্রেস ইস্তেহার বানিয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে, বিজেপি বানিয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ মার্চ থেকে। কংগ্রেস যতটা সময় নিয়েছে, সেই তুলনায় বিজেপি সময়ই নেয়নি।
ভোট শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সব দলের ইস্তেহারও প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। একটি দল অন্য আরেকটি দলের ইস্তেহার নিয়ে কুৎসাও রটিয়েছে। প্রতিটি দলের ইস্তেহারে ছত্রে ছত্রে রয়েছে উন্নয়নের কথা। কিন্তু তা কি বাস্তব, নাকি হওয়ায় ভাসানো কথা? শাসক দল কি ১০ বছরে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পেরেছে? আবার মিথ্যে প্রচার করে চলেছে বিজেপি? অন্যদিকে বিরোধী দলগুলির ইস্তেহারে কী বলা হয়েছে? সব প্রতিশ্রুতি কি বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি সামলে নিতে পারবে? তাদের ইস্তেহারের ফাঁকগুলি কী কী?
বিজেপির ইস্তেহার - 'সঙ্কল্পপত্র'
মহিলা খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ প্রোগ্রামের ব্যবস্থা, সারভাইকাল ক্যান্সার নিয়ে প্রচার। আগামী ৫ বছর নারী শক্তি ভিত্তি, ১০ কোটি মেয়েদের আইটি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রিটেলের কাজ করানোর জন্য প্রশিক্ষণ। ৩ কোটি মহিলাকে 'লাখপতি দিদি' বানানোর গ্যারান্টি, গ্রামের মেয়েদের 'ড্রোন পাইলট দিদি'-র পরিচিতি দেওয়া।
এদিকে, মণিপুরের মহিলাদের নগ্ন করিয়ে হাঁটানোর পরও, প্রধানমন্ত্রী মণিপুরের মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে ভাবেননি। মহিলা কুস্তিগীরদের সঙ্গে হওয়া যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত শাস্তি পায়নি। ২০২৩ সালে, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীর ধর্ষণ হয়। অভিযুক্তরা ছিল ভারতীয় জনতা পার্টির আইটি সেলের সদস্য। ধর্ষণে অভিযুক্তদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সহ যোগী আদিত্যনাথ, স্মৃতি ইরানি, জেপি নাড্ডাদের ছবি সামনে এসেছিল। ২০২১ সালের এনসিআরবি রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের সর্বোচ্চ নারী হিংসার ঘটনা ঘটেছে ভারতে। ভারতে মোট ৪,০৫,৮৬১ টি অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনার রিপোর্ট করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৩২,০৩৩ টি ঘটনাই ছিল ধর্ষণের। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালে, ২৬.৩৫% ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, মহিলাদের সুরক্ষার জন্য তাঁদের ক্ষমতায়নে জোর দেওয়া প্রয়োজন। সরকারের প্রকল্পগুলি ঠিক কতটা ক্ষমতায়ন করছে তা প্রশ্নের মুখে। মহিলা ভোট ব্যাঙ্কের সিংহভাগ নির্ভর করে সরকারের প্রকল্পে। কিন্তু আদৌ তা বাস্তবায়িত হয়?
গ্লোবাল নিউট্রিশন হাবের প্রতিশ্রুতিতে ২ কোটির বেশি কৃষক উপকৃত হবে বলে দাবি, ফিশারি ও স্টোরেজের উন্নয়ন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি। ১০ কোটি কৃষকের জন্য 'পিএম কিসান সম্মাননিধি'
প্রধানমন্ত্রী মোদির সময়কালেই কৃষকরা দু'বার আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন। বহু কৃষকেরা আহত ও নিহত হয়েছেন। দেশে কৃষি বিল পাশ হয়ে যায় কৃষকদের মতামত না জেনেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষকদের দাবি মেনেই যদি আইনি গ্যারান্টি দেওয়া হয় তাহলে তো আর তাঁদের আন্দোলন করতেই হতো না। কিন্তু তা সুনিশ্চিত করতে সরকারকে অনেক কাজ করতে হবে এবং অর্থও ব্যয় হবে। যেমন - মান্ডির সংখ্যা দেড় গুণ বাড়াতে হবে, আধুনিক পরিকাঠামো করতে হবে, চাষিরা যাতে চাপ ছাড়াই ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তার জন্য কড়া নজরদারি প্রয়োজন, তাই হয়তো কৃষকদের দাবিকে গুরুত্বই দেয় না সরকার। এনসিআআরবি-র রির্পোট বলছে, ২০১৪- ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ১,০০,৪৭৪ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ গড়ে, প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন কৃষকের আত্মহত্যা।
২০২৫ সালে বীরসা মুন্ডার ১৫০ তম জন্মজয়ন্তী রাষ্ট্রীয় স্তরে পালন, ডিজিটাল জনজাতি কলা আকাডেমি তৈরি, ৭০০-র বেশি একলব্য স্কুলের প্রতিষ্ঠা
কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের প্রতি অবহেলার অভিযোগ উঠেছে বারবার। ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, মনমোহন সিংয়ের জমানায় অরণ্যের অধিকার আইনের মূল কথা ছিল- আইনত জঙ্গলের জমিতে বসবাসকারী আদিবাসী ও অন্যান্য বনবাসীদের বংশানুক্রমে বসবাস করা জমি ও জঙ্গলের সম্পদ সুনিশ্চিত করা। কিন্তু শাসকদল সেই আইনও দুর্বল করে। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, ওই আইনের আওতায় যেসব পরিবারের অধিকার খারিজ হয়েছে তাঁদের ২০১৯ জুলাইয়ের মধ্যে উৎখাত করতে হবে। সে সময় ১৬ টি রাজ্যের ১০ লক্ষের বেশি আদিবাসী-বনবাসী পরিবার উচ্ছেদের আশঙ্কায় ভুগছিলেন। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে, মোদি সরকার অরণ্যের অধিকার আইনকে দুর্বল করেছে। আদিবাসীদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে ইস্তেহারে কিছুই উল্লেখ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১০ বছরে আদিবাসী, বনবাসীদের উচ্ছেদ আটকাতে গুরুত্ব দেয়নি সরকার, এখন ভোটের রাজনীতি করতে বীরসা মুন্ডার জন্মজয়ন্তী পালনের কথা বলা হচ্ছে।
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ
বিজেপি বারবার দুর্নীতি রুখবে বলে দাবি করে এসেছে। তবে ৩ এপ্রিল 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের' একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সংস্থার অভিযোগ তোলা মোট ২৫ জন বিরোধী দলনেতাই বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ-তে যুক্ত হওয়ার পর ২০১৪ সাল থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে চলা মামালাগুলি চাপা পড়ে গিয়েছে। ইলেক্টোরাল বন্ডের মতো গুরুতর আর্থিক দুর্নীতিতে শীর্ষে নাম রয়েছে বিজেপি নেতাদেরই। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, কোথায় কড়া পদক্ষেপ?
ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনা, এক দেশ, এক নির্বাচন-এর বাস্তবায়ন
এক দেশ, এক নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বিজেপির মূল যুক্তি হলো, নির্বাচনী প্রচারে বিপুল অর্থের খরচ হয়। কিন্তু গুগল অ্যাডস ট্রান্সপারেন্সি সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১ জানুয়ারি থেকে ১০ এপ্রিলের মধ্যে অনলাইন নির্বাচনী প্রচারে মোট ১১৭ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজনৈতিক দলগুলি। তার মধ্যে বিজেপি করেছে তিনভাগের একভাগ। যা প্রায় ৩৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস খরচ করেছে ৭.৫৬ কোটি টাকা। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, বিজেপি সত্যি যদি নির্বাচনী খরচ নিয়ে সচেতন হতো এত টাকা নিজেরাই খরচ করত না। বিরোধীরা বলছে, নিজেদের শাসনকাল দীর্ঘদিন ধরে রাখতেই নাকি বিজেপির এই পরিকল্পনা।
মহাকাশ ক্ষেত্রে উন্নতি, গ্রিন জব তৈরি, ইলেকট্রনিক গাড়ি বিক্রি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি
একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছিল, ১৭ মাস বেতন না পেয়েও চন্দ্রযান ৩-এর সফল উৎক্ষেপণের জন্য পরিশ্রম করেছিলেন 'হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন' সংস্থার ইঞ্জিনিয়াররা। অভিযোগ ছিল, কেন্দ্রের ভারী শিল্প মন্ত্রকের কাছে বারবার ১,০০০ কোটি টাকার আর্জি জানানোর পরেও সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়নি। এই সময়ে সংস্থার এমন অবস্থা হয়েছিল যে কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি। জেপি নাড্ডা, অমিত শাহের বক্তব্য ছিল, 'মোদি দেশবাসীর হাতে চাঁদ এনে দিয়েছেন'। চারিদিকে মোদির জয়গান শুরু হয়েছিল। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে, আসলে কাদের নিয়ে মাতামাতি করা প্রয়োজন ছিল? চন্দ্রযান ৩ কর্মীদের নিয়েই এই অবহেলা যদি হয়, বাকি ক্ষেত্রে কী উন্নয়ন হতে পারে তা আন্দাজ করা যায়।
সামাজিক, ডিজিটাল পরিকাঠামোর উন্নয়ন, উড়ান ব্যবস্থার উন্নতি, তিনটি মডেলে বন্দে ভারত ট্রেন চালু - স্লিপার, চেয়ারকার, মেট্রো, বুলেট ট্রেন চালু
তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে মুম্বই-আহমেদাবাদে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে ভূমিপুজোও হয়েছিল। ২০২২ সালের ১৫ অগাস্টের মধ্যে ট্রেন চালু হয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণাও হয়ে গিয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, ২০২৭ সালের আগে ট্রেন চালু হওয়া সম্ভব নয়। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে ইস্তেহারে আবার বুলেট ট্রেনের দাবি অলীক স্বপ্ন নয়? অন্যদিকে, বন্দে ভারত ট্রেনের খাবারের গুণমান, অত্যধিক ভাড়া, গতিবেগ নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। বাকি ট্রেনের তুলনায় স্টপেজ কম বন্দে ভারত ট্রেনের, তাই তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছায়। গতিবেগের তেমন ফারাক নেই বলেই অভিযোগ।
রূপান্তরকামীদের আয়ুষ্মান ভারতের অন্তর্গত
'দ্য ও্যয়ার'-এর একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, ভারতে রূপান্তরকামী বন্দিদের যৌন হিংসা, হয়রানি-সহ একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিরোধীরা বলছে, সারা দেশে প্রশাসনে, আইনের নানা ক্ষেত্রে কী কী অবহেলা পোহাতে হয় ভিন্ন যৌনপরিচয়ের মানুষদের তা ভাবা যায় না। সেসবের ব্যবস্থা না নিয়ে আয়ুষ্মান ভারতের অন্তর্গত করার কথা বলা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি নয় কি?
মুদ্রা যোজনার অধীনে উদ্যোগপতিদের সাহায্য, যুব সম্প্রদায়কে নিজের পছন্দের কাজ করার জন্য সাহায্য
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) একটি রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনে। দেখা যায়, ভারতের জনসংখ্যার ৮০% যুবক বেকার। 'দ্য ইন্ডিয়ান এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট' অনুযায়ী, ২০২২ সালে দশম শ্রেণি এবং তার বেশি যোগ্যতার ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ৬৫.৭%। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, দু'বার ক্ষমতায় থাকার পরও যখন এই রির্পোট, এরপরও কি তাঁদের প্রতিশ্রুতি যুব সম্প্রদায়ের কাছে ভরসাযোগ্য?
৩ কোটি পাকা বাড়ির প্রতিশ্রুতি
এদিকে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সিএজি রিপোর্টে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার প্রায় ১,৫০০ ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনায় 'বেআইনি'-ভাবে সুবিধে পাইয়ে দিয়েছে। যার আর্থিক হিসেব ১৫ কোটি টাকা। বিরোধীরা বলছে, এই রাজ্যের বাইরে যে প্রকল্পের অপব্যবহার হয়নি সেই গ্যারান্টি কে দেবে?
আগামী ৫ বছরও বিনামূল্যে রেশন পরিষেবা দেওয়া হবে এবং বিজেপির দাবি , ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমা থেকে বের করে আনা হয়েছে
২০২২ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার রিপোর্টে ভারতের স্থান ১০৭ তম। ২০২১ সালেই স্থান ছিল ১০১। ১২১ টি দেশের মধ্যে ভারত ১০৭ তম। ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও উন্নতি হয়নি, অবনতি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, আবারও কি মানুষ মিথ্যে দাবিতে বিশ্বাস করে ভোট দেবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপি সরকারের ১০ বছরের রাজত্বে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষকে স্বাভাবিক জীবন দিতেও অক্ষম হয়েছে মোদি সরকার। এরপরও যা তারা বলছে সবটাই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি। বিজেপির ইস্তেহারে মোদি দাবি করেছেন, শেষ ১০ বছরে আমূল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে দেশ। মানুষের মানসিকতারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর দাবি, 'বিকশিত ভারত'-এর কথা যুব সম্প্রদায়ের মুখে মুখে। দেশ নাকি 'আত্মনির্ভর ' হওয়ার পথে এখনও 'আত্মবিশ্বাসী'। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, ২০১৪-র আগের সরকারের শাসনকালে দেশ যে দুরবস্থার মধ্যে ছিল তার বদল হয়েছে। জেপি নাড্ডা বলেছেন, কংগ্রেস ভোটের রাজনীতি করেছিল, রামলালার কথা ভাবেনি। মোদির নেতৃত্বে ঘরে ফিরেছেন রামলালা। প্রশ্ন উঠছে, এই কথা কি সরাসরি ধর্মের বিভাজন করে না? তথ্য বলছে, প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি সরকার। এরপরও গেরুয়া শিবিরের নেতারা যে নিজেরাই নিজেদের সুনাম করে যাচ্ছেন, এটা কি ভণ্ডামি নয়?
আরও পড়ুন- চৌকিদারই চোর? বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি নির্বাচনী বন্ডই?
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ইস্তেহার- ন্যায়পত্র
- ন্যায়বিচারের প্রতি জোর দিতে - ইয়ুথ জাস্টিস, জেন্ডার জাস্টিস, ফার্মাস জাস্টিস, ওয়ার্কার জাস্টিস ও ইকুইটি জাস্টিস
- সকল নাগরিকদের মতো সংখ্যালঘুদেরও পোশাক, খাদ্য, ভাষা ও ব্যক্তিগত পছন্দের স্বাধীনতা রক্ষা
- সরকারি পরীক্ষার আবেদন ফি বাতিল
- এলজিবিটিকিউআইএ+ দম্পতিদের জন্য আইন
- জাতি ও বর্ণ এবং তাঁদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির গণনা, এসসি,এসটি এবং ওবিসিদের সংরক্ষণ ৫০% বাড়ানো হবে
- বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধীদের ভাতা ১০০০ টাকা করা হবে
- গরিব পরিবারের মেয়েদের বছরে ১ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে, দেশে সংরক্ষণ ৫০% বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি
- ভারতের নিকটতম প্রতিবেশীদের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ (ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি)
- দেশের প্রতিটি শিশুর বিনামূল্যে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি শিক্ষার বন্দোবস্ত
- বেসরকারি বিদ্যালয়ে বেতনের সীমাবদ্ধতার জন্য কমিটি গঠন, সরকারি বিদ্যালয়ে সকলকে স্থায়ী কর্মী
- শহরে চাকরিতে নিশ্চয়তা, গিগ শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, বাড়ির পরিচারিকাদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা
- সরকারি চাকরিতে মহিলাদের ৫০% সংরক্ষণ
- বিনামূল্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলা, চিকিৎসক স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা
- সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার, তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন
- নোটবন্দি, পেগাসাস, রাফাল এবং নির্বাচনী বন্ডের জন্য তদন্ত কমিশন গঠন
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দেশের প্রধান বিরোধী দল। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, শাসকগোষ্ঠী বিজেপির তুলনায় কংগ্রেসের ইস্তেহার সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয়তাকে লক্ষ্য রেখেই তৈরি হয়েছে। কারণ, তাদের ইস্তেহারে রয়েছে- গিগ শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, বাড়ির পরিচারিকাদের কথা, চাকরিতে মহিলাদের ৫০% সংরক্ষণ,সাংবাদিকদের সুরক্ষা, এলজিবিটিকিউআইএ+, বিনামূল্যে পরীক্ষার আবেদনের কথা। 'দ্য ও্যয়ার'-এর একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, কংগ্রেস ইস্তেহার বানিয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে, বিজেপি বানিয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ মার্চ থেকে। কংগ্রেস যতটা সময় নিয়েছে, সেই তুলনায় বিজেপি সময়ই নেয়নি। প্রতিবেদক বলছেন, আগে ভোটাররা প্রতিটি দলের ইস্তেহার জেনে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিত কাকে ভোট দেবে। ইস্তেহার তৈরির এই স্বল্প সময়সীমাই হয়তো ইঙ্গিত করছে, বিজেপি ভোটে জেতার জন্য ইস্তেহারকে গুরুত্বই দেয়নি। তবে কংগ্রেসের ইস্তেহারে পরিবেশ সচেতনতা, জনসংখ্যার ভিত্তিতে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট রয়েছে কিনা দেখা, দলিতদের সমস্যা, আদিবাসীদের সমস্যার বিষয়গুলি নেই।
আরও পড়ুন- পাকিস্তান, বাংলাদেশের চেয়েও বেশি বেকার ভারতে! চাকরিগুলো কোথায় গেল মোদিজি?
তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তেহার - 'দিদির শপথ'
দুয়ারে রেশন
ইডির দাবি, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে, রেশন দুর্নীতির ৭৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, বারবার দুয়ারে রেশন প্রকল্প এনে নিজেদেরই কি সুবিধের রাস্তা করে দিচ্ছে সরকার পক্ষ? কারণ, রাজ্য সরকার বলেনি দুর্নীতি না হওয়ার জন্য তারা কোনও পদক্ষেপ করছে কিনা।
কর্মসংস্থান নিশ্চিত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ, শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণে বৃত্তি, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড
শিক্ষা, মিড ডে মিল ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। ইডির দাবি, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে নাম রয়েছে ১০০ জনেরও বেশি নেতার। এসএসসি, টেট চাকরি প্রার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে, মমতা আগের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি, নতুন করে আবার চাকরির প্রতিশ্রুতি বৃথা।
সিএএ, এনআরসি এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বাতিল
বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, এত সচেতন হলে, লোকসভায় সিএএ, এনআরসি বিল পাশ হওয়ার সময়ে তৃণমূল সাংসদ দেব এবং মিমি অনুপস্থিত ছিলেন কেন?
এছাড়াও তৃণমূলের ইস্তেহারে উল্লেখ রয়েছে -
মহিলাদের আর্থিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে ১০ লক্ষ টাকার বেশি চিকিৎসার খরচ প্রদান
আইন মেনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য
স্বল্প মূল্যে পেট্রোপণ্য
বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস
শ্রমিকের আয় বাড়ানো
বাড়ি বানানোর প্রতিশ্রুতি
বিপিএল গ্রাহকদের বিনামূল্যে ১০ টি রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার
সকলের নিরাপত্তা রক্ষা
বিশেষজ্ঞদের মতে, তৃণমূল কংগ্রেস আগেও বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু পূরণ করেনি। আবারও একই ধাঁচে তাদের ইস্তেহার মানুষের মন কতটা জয় করতে পারবে তা সন্দেহের।
আরও পড়ুন- ২০১৪: মোদিকে যেভাবে মসনদে বসিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর
বামফ্রন্টের ইস্তেহার
- বিজেপি এবং তৃণমূল যে প্রত্যাশা পূরণ করেনি, তার সপক্ষে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে
- কেন্দ্রীয় এজেন্সির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।
- দু'দিনে ১৪৬ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা বিজেপি সরকারের নিন্দা রয়েছে
- দাবি, ৭৯% বাজেট আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে পাশ করা হয়েছিল
- দাবি, বিজেপিকে সুবিধে পাইয়ে দেয় তৃণমূল, তাই রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ইন্ডিয়া জোটে নেতৃত্বে দেবে
- কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরির ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি
বামফ্রন্টের ইস্তেহারেও ফাঁক রয়েছে। যেমন - পরিবেশ সচেতনতা, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ যথেষ্ট রয়েছে কিনা দেখা, গিগ শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, দলিতদের সমস্যা, আদিবাসীদের সমস্যার বিষয়গুলি নেই।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ২০ টি শহরের মধ্যে ভারতেই রয়েছে ১৪ টি শহর। 'আরকিউএয়ার'-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের দূষণের তালিকায় ভারতের স্থান তৃতীয়। এর সবচেয়ে বড় কারণ সবুজ ধ্বংস।ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, পরিবেশ বিষয়ক সমস্যাগুলি যার সঙ্গে নাগরিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত সেগুলির বিষয়ে কোনও দলই কোনও কথা বলেনি।
দলিতদের নিয়ে কোনও সুরক্ষা, নিরাপত্তার কথা নেই ইস্তেহারে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী , ভারতের জনগণের প্রায় ১৭% অর্থাৎ ২০ কোটিরও বেশি মানুষ দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত। ২০১৪-২০১৫ সালের মধ্যে আইআইএম, এনআইটি, আইআইটি ইত্যাদিতে ৬৮% আত্মহত্যা করেছেন সংরক্ষিত আসনের শিক্ষার্থীরাই। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু আর্থিক বা সামাজিক নয়, সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতারও সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। ২০২২ সালের উত্তরপ্রদেশের একটি ঘটনা, সপ্তম শ্রেণির দলিত সম্প্রদায়ের এক ছাত্র স্কুলে ২৫০ টাকা মাইনে দিতে পারেনি বলে, শিক্ষক এমন মেরেছিলেন যে ১০ দিনের মধ্যেই সে মারা যায়। প্রশ্ন উঠছে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলির দলিতদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার কি কোনও দায় নেই?
দেশের বর্তমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে যথেষ্ট কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিনা তা দেখা প্রয়োজন। কারণ, জনসংখ্যা তো বাড়ছেই কিন্তু সেই তুলনায় নতুন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার খবর মেলে না। অন্যদিকে, মাঝেমধ্যেই যুব সম্প্রদায় অভিযোগ তোলে সংরক্ষণ ব্যবস্থার জন্য নাকি সাধারণ বিভাগের ছেলেমেয়েরা বাদ যায়। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন, আদৌ দেশে যথেষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, না কি যুব সম্প্রদায়ের কাছে বাস্তব পরিস্থিতি চাপা দিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থাকেই টার্গেট করা হয়? এই বিষয়েও কোনও রাজনৈতিক দল বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসেব বলছে, ২০২২ অবধি ভারতে কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ৪ লক্ষ ৮৩ হাজার মানুষের। 'সায়েন্স' পত্রিকার গবেষণা বলছে, ২০২২ অবধি, কোভিডে ৩২ লক্ষ মানুষের বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। যা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসেবের ৬ গুণ বেশি। কেন্দ্র এই তথ্য কেন লুকিয়েছে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী ভবিষ্যতেও অতিমারি-মহামারি আসতে পারে বলে সচেতন করেছিলেন। কিন্তু তা মোকাবিলার জন্য স্বাস্থ্যবিভাগে জোর দেওয়া হবে কিনা দলগুলি তা উল্লেখই করেনি। প্রায় সব দলই বলেছে বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা, কিন্তু অতিমারিতে লক্ষ লক্ষ রোগীর ভিড়েও প্রকল্পের সুবিধে দেওয়া হবে কিনা তাও সুনিশ্চিত করেনি কেউই।