প্রয়াত সব নেতা, আত্মসমর্পন বাকিদের! ভারতে মাওবাদী ধারা শেষ?
Naxalism in India: ২০১৪-২০২৪ সালের মধ্যে মাওবাদী হামলা কমেছে ৫৩%। প্রভাবিত জেলা ছিল ১২৮ টি, এখন কমে মাত্র ১৮টি।
ভারতে একসময় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছিল মাওবাদের ছায়া। ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা থেকে মহারাষ্ট্র— দেশের প্রান্তে প্রান্তে ভয়, হিংসা আর হতাশার প্রতীক ছিল এই সশস্ত্র বাম-বিদ্রোহ। কিন্তু গত একদশকে সেই শক্তি ক্রমে মিলিয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দীর্ঘদিন বলে আসছেন, মার্চ ২০২৬-এর মধ্যেই মাওবাদকে কার্যত শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। সরকারি পরিসংখ্যানও বলছে একই কথা— বিদ্রোহী কার্যকলাপ কমেছে, এলাকায় মাওদের দাপটও কমেছে।
গত ১৯ নভেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের আল্লুরি সীতারামারাজু জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে সাতজন মাওবাদীর মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের তরফে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এটি দ্বিতীয় এনকাউন্টার। অন্ধ্রপ্রদেশের ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ (ইন্টেলিজেন্স) মহেশ চন্দ্র লাড্ডা সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে জানান, নিহতদের মধ্যে চারজন পুরুষ ও তিনজন নারী। মৃতদের তালিকায় অন্যতম হলেন মেট্টুরি জোগা রাও; টেক শঙ্কর নামে পরিচিত। মহেশ চন্দ্র লাড্ডা জানান,
“মেট্টুরি জোগা রাও ওরফে টেক শঙ্কর সিপিআই (মাওবাদী)-র অন্ধ্র-ওড়িশা সীমান্ত অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন এবং দলের কারিগরি শাখার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলাতেন।”
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার ভোর ছ’টা থেকে সাতটার মধ্যে মারেদুমিলির কাছে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের প্রথম সংঘর্ষ হয়। সেই অভিযানে নিহত হন শীর্ষ মাওবাদী নেতা মাদভি হিডমা। এনকাউন্টারের পর তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন এডিজি মহেশ চন্দ্র লাড্ডা। এদিকে ছত্তিশগড়ের উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় শর্মা জানিয়েছেন, বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত তল্লাশি অভিযান চলছে এবং এর ফল মিলছেও। মাওবাদীদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, সহিংসতার পথ ছেড়ে আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসনের দিকেই এগোতে হবে। তিনি বলেন,
“যারা মূলস্রোতে ফিরতে চায়, তাদের জন্য সরকারের দরজা খোলা। সম্মানজনক পুনর্বাসনের সব ব্যবস্থাই করা হবে।”
আরও পড়ুন
বন্ধুহীনতা আর ভুল লাইন, ভারতে মাওবাদী আন্দোলনের সংকট
ঝাড়খণ্ড-সহ দেশের যেসব এলাকায় এখনও মাওবাদীরা রয়েছে, সেখানে টানা অভিযান চালাচ্ছে আধাসেনা ও রাজ্য পুলিশের যৌথ বাহিনী। একসময় সিপিআই (মাওবাদী)-র সশস্ত্র শাখা পিএলজিএ (পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি)-র ‘মুক্তাঞ্চল’ হিসেবে পরিচিত ছিল পশ্চিম সিংভূমের সারান্ডা জঙ্গলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এখন সেই এলাকাতেও নিয়মিত combing operation চলছে, যাতে জঙ্গলের ভেতরের ঘাঁটিগুলো ভেঙে দেওয়া যায়। সম্প্রতি এসব অভিযানের ফলেই বড় ধাক্কা খাচ্ছে মাওবাদীরা। গত মাসেই পশ্চিম সিংভূম জেলার সংঘর্ষে পিএলজিএ-র এরিয়া কমান্ডার অমিত হাঁসদা, ওরফে আপ্তান, নিহত হন। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক হামলার অভিযোগ ছিল এবং মাথার দাম ছিল ১০ লাখ টাকা।
গত দশ বছরের পরিসংখ্যান দেখলে স্পষ্ট হবে মাওবাদীদের দাপট ক্রমশ কমছে। ২০১৪-২০২৪ সালের মধ্যে মাওবাদী হামলা কমেছে ৫৩%। প্রভাবিত জেলা ছিল ১২৮ টি, এখন কমে মাত্র ১৮টি। মাওবাদীদের হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর মৃত্যুও ৭৩% কমেছে। সাধারণ মানুষের মৃত্যু কমেছে ৭০%। আত্মসমর্পণও বেড়েছে। এই সংখ্যাগুলো দেখলে পরিষ্কার মাওবাদীদের ‘রেড করিডর’ আজ প্রায় ধূসর। গত দু'বছরে আত্মসমর্পণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কারণ, সংগঠনের নেতৃত্ব ভেঙে পড়েছে। তাহলে কি মাওবাদ শেষ? বিশ্লেষকরা বলছেন, পুরোপুরি শেষ হয়েছে তা এখনই বলা যায় না। ঘন জঙ্গলে এখনও মাওবাদী ক্যাম্প রয়েছে। কোথাও কোথাও তরুণদের নতুন করে সংগঠিত করার চেষ্টাও চলছে।
বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী বাসু আচার্য্য ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন,
“লাঠি-গুলিতে আন্দোলন থামে, কিন্তু মতাদর্শকে হত্যা করা যায় না”।
তাঁর কথায়,
“ইতালীয় বামপন্থী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশির জীবনের উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায় ফ্যাসিস্টদের নির্যাতনে শহিদ হওয়ার পরও তাঁর আদর্শ, তাঁর দর্শন শেষ হয়ে যায়নি।”
তিনি উল্লেখ করেন,
“তৎকালীন ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড পালমিয়া তুইলি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'গ্রামশি শহিদ হওয়ার সময়ে তাঁর সহযোদ্ধাদের একটি অংশ স্পেনের গৃহযুদ্ধে লড়ছিলেন। অনেকেই শহিদ হয়েছেন, কেউ নিখোঁজ বা লুকিয়ে ছিলেন। আর যে দলটির জন্য গ্রামশি লড়াই করেছিলেন, সেই কমিউনিস্ট পার্টি তখন প্রায় ছিন্নভিন্ন, ভেঙে পড়া, জনমানবশূন্য, একপ্রকার অস্তিত্বহীন সংগঠন।“
“তবুও সেই দল আবার উঠে দাঁড়ায়। কেন? দর্শনের শক্তিতে। মতাদর্শের ভিত্তিতে।”
বলেন বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী বাসু আচার্য্য।
বর্তমান ভারতীয় পরিস্থিতিকে তিনি সেই সূত্রেই ব্যাখ্যা করেন। তাঁর অভিযোগ, কর্পোরেটপন্থী নীতির কারণে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের জল-জঙ্গল-জমি কর্পোরেট গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিচ্ছে। আর যাঁরা এর প্রতিবাদ করছিলেন, বিশেষ করে আদিবাসী এলাকার মাওবাদী বিপ্লবীদের, তাঁদের নির্মূল করতেই রাষ্ট্র বাহিনী ব্যাপক দমন চালিয়েছে। তাঁর বক্তব্য,
“মানুষকে হত্যা করা যায়, সংগঠন ভেঙে দেওয়া যায়, কিন্তু মতাদর্শকে শেষ করা যায় না। এটা ভেতরে ভেতরে জন্ম নেয়, সুযোগ পেলে আবার মাথা তোলে।”
তিনি আরও বলেন,
"মাওবাদী আন্দোলন একসময় সমতল এলাকা থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থা, সামাজিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিবর্তনকে যথাযথভাবে বিবেচনা না করে একরোখাভাবেই লড়াই চালানো হয়। সেই ভুলের ফলেই আন্দোলন ধীরে ধীরে সমতল থেকে সরে পাহাড়-জঙ্গল-দূরবর্তী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।"
তাঁর দাবি, ভবিষ্যতে যাঁরা এই আদর্শ বহন করবেন, তাঁরা অতীতের ভুলগুলো সংশোধনই করবেন। শেষে তিনি বলেন,
“সংগ্রামের ধারাটি মতাদর্শিক ভিত্তিতে আবারও এগোবে। হয়ত খুব কম মানুষ থাকবে, কিন্তু সেই কয়েকজনই নতুন ভিত্তিতে আবার আন্দোলনকে গড়ে তুলবেন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন কল্যাণ মৌলিকও ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন, ভারতের বাম বিপ্লবী ইতিহাস বারবারই দেখিয়েছে— কোনো পর্যায়ে আন্দোলন দমে গেলেও, আদর্শ ও কারণ টিকে থাকলে সেটি নতুন রূপে আবারও ফিরে আসে। তাঁর কথায়,
“ইতিহাসে যতবার বাম বিপ্লবী আন্দোলনের শেষকথা ঘোষণা করা হয়েছে, ঠিক ততবারই তার ফিনিক্সের মতো পুনরুত্থান ঘটেছে।”
সত্তরের দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের বিপর্যয়ের পর বিপ্লবী শক্তি নানা ধারায় ভেঙে যায়। সুমন কল্যাণ মৌলিক মনে করিয়ে দেন, তখন একদিকে বামপন্থী আন্দোলনের একটি অংশ সংসদীয় রাজনীতিকে গ্রহণ করে এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে পরিত্যাগ করে। অন্যদিকে অন্যধারার কয়েকটি বিপ্লবী শক্তি— সিপিআই (এমএল) জনযুদ্ধ, পার্টি ইউনিটি ও এমসিসি একত্রিত হয়ে গঠন করে সিপিআই (মাওবাদী)। গত ২৫ বছর ধরে এই সশস্ত্র ধারা ভারতের বামপন্থী ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় তৈরি করেছে বলেই তাঁর মত।
আরও পড়ুন
হিডমার মৃত্যুতে ভারতে সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনের ইতি?
ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরে মাওবাদী দমনে বিভিন্ন সশস্ত্র অভিযান চালিয়েছে— সালওয়া জুড়ুম, অপারেশন গ্রীন হান্ট, এবং সর্বশেষ অপারেশন কাগার— এ সমস্ত অভিযানের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবী শক্তিকে নির্মূল করা। বিশ্লেষক সুমন কল্যাণ মৌলিকের মতে,
“যে কার্যকারণ একটি বিপ্লবী আন্দোলনের জন্ম দেয়, তা এখনও বর্তমান। তাই এই আন্দোলনের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো অনিবার্য।”
তিনি আরও বলেন, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ জল, জঙ্গল, জমি, খনিজ ক্রমাগত কর্পোরেট স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে; এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ বিকল্প পথ খুঁজবে। তাঁর মতে,
“কর্পোরেট লুটের বিরুদ্ধে যখন মানুষ বিকল্প রাজনীতির খোঁজে নামবে, সেখানে মাওবাদী রাজনীতি স্বাভাবিকভাবেই এক সম্ভাব্য বিকল্প হয়ে উঠবে।”
উল্লেখ্য, ভারতে সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলন যে অতীতের তুলনায় দুর্বল— তা সরকারি পরিসংখ্যান, সাম্প্রতিক এনকাউন্টার থেকেই স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মাওবাদকে কার্যত শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বামপন্থী চিন্তাবিদরা বলছেন, আন্দোলনের জনভিত্তি তৈরি হওয়ার যে সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা, তা আজও অটুট রয়েছে। জল-জঙ্গল-জমির দখল, কর্পোরেট বিস্তার, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হতাশা ও বঞ্চনা— এই কাঠামোগত সংকটগুলো রয়ে গেলে শুধুমাত্র সামরিক অভিযান দিয়ে মাওবাদের সমাপ্তি নিশ্চিত করা যায় না। শ্রেণি-দ্বন্দ্ব ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে ভিত্তি করে থাকা বাম আন্দোলনের ইতিহাস দেখিয়েছে— তা বারবার বদলায়, পিছিয়ে যায়, আবারও নতুন রূপে ফিরে আসে। তাই মাওবাদীদের অস্তিত্ব আজ যতই ক্ষীণ হোক না কেন, এর পুনরুত্থান রোধ করতে হলে শুধু বন্দুকের নল নয়, দরকার উন্নয়ন, ন্যায্যতা এবং স্থানীয় মানুষের রাজনীতির প্রতি ভরসা ফেরানো। না হলে ‘রেড করিডর’ সত্যিই শেষ হয়েছে কি না— ভবিষ্যতেও সেই প্রশ্ন থেকেই যাবে।

Whatsapp
