১০০০ তালিবানের 'খুনি' কমিউনিস্ট মার্শাল দোস্তাম কি আফগানিস্তান বাঁচাতে পারবেন?
প্রসেনজিৎ চৌধুরী: আফগানিস্তানে এখন তালিবান সরকার। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০২১ এর ১৫ আগস্ট রবিবার থেকে ...আগামী অজানা ভবিষ্যৎ পর্যন্ত দুবার জঙ্গিদের সরকার কায়েম হলো। আফগান সরকার পরাজিত। দেশ ছেড়ে প্রতিবেশি তাজিকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন অপসারিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি।
তবে তালিবান সরকারের ভয় আছে। তাদের দোজখের দরজা (নরকের দ্বার) দেখানো চরম কুশলী আফগান সেনাপতি আবদুল রশিদ দোস্তাম জীবিত। তিনি অবশ্য গোপন ডেরায় চলে গিয়েছেন। তাঁর গণ মিলিশিয়া বাহিনি তৈরি হচ্ছে তালিবান তাড়াতে।
দোস্তাম কোথায়? কেউ জানে না। ওয়াশিংটনের কাছে খবর নেই। ক্রেমলিন জানলেও নীরব। ইজরায়েলের বিখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ আঁতিপাঁতি করে খোঁজ লাগাচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিসেন্স) কর্তারা দোস্তামের সর্বশেষ খবরটি কাবুলে তালিবান সরকারের কাছে পাঠাতে মরিয়া।
কারণ মার্শাল দোস্তাম নামটাই তালিবানের কাছে ভয়। দোস্তাম তালিবান খুনি। এক হাজার তালিবানকে মেরে ফেলার জন্য বিখ্যাত। আফগানিস্তানের এই সেনা কমান্ডারের অপর পরিচয় তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ। ৮০-৯০ দশকে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রনাধীন আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ সেনা কমান্ডার। পরবর্তীতে আফগান শীর্ষ রাজনীতিক ও নিজের বিশেষ বাহিনির প্রধান।
আসুন আবদুল রশিদ দোস্তামকে নিয়ে কিছু কথা জানি। বিভিম্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে এই তালিবান বিরোধী কমিউনিস্ট মনোভাবের আফগান সেনানায়কের বিষয়ে কিছু তথ্য প্রকাশ হয়েছে।
কেমন লোক আবদুল রশিদ দোস্তাম?
৬ ফুট লম্বা, গোলাপি রঙের মানুষ দৈত্য যেন। আব্দুল রশিদ দোস্তাম জোকস আর টম অ্যান্ড জেরির লাফালাফি দেখে হো হো করে হাসেন। তাকে ডরাত মোল্লা ওমর, ওসামা বিন লাদেন। ডরায় এখনকার তালিবান প্রধান হাইবাখান্দা আখুন্দাজাদা। পাকিস্তানের জঙ্গি নেতা মাসুদ আজাহার তো সেই তুলনায় শিশু।
দোস্তাম সাহেব দুধে চোবানো বাছুরের মাংসের রোস্ট দিয়ে ভদকা খেতে খেতে স্বপ্ন দেখেন রাশিয়ায় আবার কমিউনিস্ট সরকার হবে ! ফের সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল রঙের পতাকা উড়বে !
আব্দুল রশিদ দোস্তামের কোমরে থাকা পিস্তল সদা লোডেড। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন আফগান মহিলারা যতদিন না পড়াশোনা করবে ততদিন বিপদ কাটবে না।
দেস্তাম লোকটা আসলে রক্তসূত্রে আফগানি নয়-ই। উজবেক বংশজ। পুরো জীবনটা আফগানিস্তানের হয়ে লড়াই করেছেন। প্যারাসুট বাহিনির যোদ্ধা হিসেবে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখান।
দোস্তামের ঘাঁটি আফগানিস্তানের মাজার ই শরিফ। পুরো আফগানিস্তানে একমাত্র এই এলাকায় তালিবান বিরাট বাধা পেয়েছিল। কারণ দোস্তাম ছিলেন নেতৃত্বে। হাজারে হাজারে আফগান সেনা তালিবান ভয়ে বন্দুক ফেলে পালাচ্ছিল, তখন মাজার ই শরিফে দোস্তামের গণ মিলিশিয়া বাহিনি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে।
দোস্তাম বিতর্কিত। তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তিনি আত্মসমর্পণ করা হাজার খানেক তালিবান জঙ্গিকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেন। তবে এই অভিযোগ উড়িয়ে দেননি দোস্তাম।
আশির দশকে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে সে দেশে প্রবেশ করেছিল সোভিয়েত সেনা। বরাবর সোভিয়েত অনুরাগী দোস্তাম সরাসরি সেই সুযোগ নেন। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির হামলা রুখে দিয়ে দ্রুত পরিচিত হন। পরবর্তী সময়ে আফগান সেনার অন্যতম কমান্ডার হন।
সোভিয়েত মদতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডক্টর মহম্মদ নাজিবুল্লাহ। কমিউনিস্ট মনোভাবের প্রেসিডেন্ট ড নাজিবুল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ আফগান বীরের পদক পাওয়া সেনা কর্তা হলেন আবদুল রশিদ দোস্তাম। নব্বই দশকে সোভিয়েত ভেঙে যায়। নাজিবুল্লাহর আফগান সরকারকে উপড়ে ফেলতে ধর্মীয় মুজাহিদিনদের একত্রিত করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জন্ম নেয় তালিবান।
১৯৯৬ সালে আমেরিকার মদতে তালিবানদের ক্ষমতা দখল করা ছিল চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সেই বছরেই কাবুলে নাজিবুল্লাহকে খুনের পর প্রথমবার তালিবান সরকার হয়।
২০০১ সালে পরিস্থিতি উল্টে গেছিল। আমেরিকায় ৯/১১ নাশকতার জেরে মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে ঢোকে। ওয়াশিংটনের মদতে যে তালিবান তৈরি হয়েছিল তাদেরই তাড়ানো শুরু হলো। এই পর্বে তালিবান বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আবদুল রশিদ দোস্তাম গেরিলা হামলা শুরু করেন। ধীরে ধীরে গুটিয়ে গেছিল তালিবান।
টানা কুড়ি বছর পর সেই তালিবান ফের আফগানিস্তানের শাসনে। মার্কিন সরকার জানিয়েছে, আর তাদের সেনা আফগানিস্তানে থাকবেনা। সুযোগের সদব্যবহার করেছে তালিবান।
গত কুড়ি বছরে আফগান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আলোচিত দোস্তামের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সম্পর্ক ছিল শীতল। দুজনই সম্মানজনক দূরত্ব রাখতেন। মাজার ই শরিফ নিয়েই ব্যাস্ত থাকতেন দোস্তাম। তবে তালিবান হামলা নতুন করে শুরু হতেই মার্কিন সাহায্যহীন আফগান সেনার পিছু হটা শুরু হয়। একের পর এক প্রদেশ সরকারের হাতছাড়া হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আশরাফ ঘানি বিপন্ন বোধ করেন।
পরিস্থিতি বুঝে ঘানি মাজার ই শরিফ গিয়ে দোস্তামের সাহায্য চান। ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। তবে দোস্তাম নেমে পড়েন তালিবান বিরোধী সংঘর্ষে। প্রাথমিকভাবে তিনি তালিবান ঠেকালেও আফগান সেনার প্রাণভয়ে পালানো রুখতে পারেননি। সামনাসামনি যুদ্ধ ছেড়ে দোস্তাম চলে গেছেন গেরিলা রণকৌশলে।
উজবেক বংশজ দোস্তাম কি উজবেকিস্তান গিয়েছেন? কেউ বলতে পারবে না। কারণ দোস্তাম রহস্যময় চরিত্র। তিনি একাধারে সোভিয়েত অনুরাগী। আবার তিনিই সোভিয়েত ও তালিবানের একসাথে বিরোধী পঞ্জশির পর্বতমালার সিংহ বলে পরিচিত আহমেদ শাহ মাসুদের দোস্ত। তুমুল তালিবান বিরোধী মাসুদের মৃত্যু হয়েছে আগেই।
তবে দোস্তাম বেঁচে। তাঁকে ঘিরে ফের তালিবান বিরোধী আফগানিরা কোমর কষছে। কঠিন লড়াই।
সৌ: Warlord Rashid Dostum pledges to kill Taliban in Afghanistan: The Sentinel Assam