শুধু মহারাষ্ট্রেই আক্রান্ত প্রায় হাজার, পরবর্তী মহামারীর আশঙ্কা তৈরি করছে এই ভয়াবহ হাম?

Measles Outbreak in the World: ইতিমধ্যেই আশঙ্কার কথা শুনিয়ে রেখেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু (WHO)। গত নভেম্বরেই তারা মিসলস বা হাম নিয়ে গোটা বিশ্বেই সতর্কতা জারি করেছে।

গত নভেম্বরেরই মাঝামাঝি সময়ের একটি ঘটনা। ভারতের প্রাণের শহর মুম্বইয়ের নল বাজার এলাকার মাত্র এক বছর বয়সী এক শিশুর আচমকা মৃত্যু হয়। ডাক্তারি রিপোর্টে বলা হয়, কিডনিতে সংক্রমণ হয়েই ওই একরত্তি শিশুটি মারা যায়। সংক্রমণ হল কেন? ডাক্তারদের বক্তব্য, শিশুটি মিসলস বা হাম রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। কস্তুরবা হাসপাতালে ভর্তি করার পর চিকিৎসাও শুরু হয়। কিন্তু মারণ কামড় থেকে তাকে বাঁচানো যায়নি।

তবে ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ৪ থেকে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে মুম্বইয়ের ওই হাসপাতালে ৬১ জন শিশুকে পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, প্রত্যেকেই হামে আক্রান্ত। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে, মহারাষ্ট্রে এখনও অবধি ৯২৫ জন হামে আক্রান্ত। মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। এসবের মধ্যেই আশঙ্কার কথা শুনিয়ে রেখেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু (WHO)। গত নভেম্বরেই তারা মিসলস বা হাম নিয়ে গোটা বিশ্বেই সতর্কতা জারি করেছে। ভারতকেও সতর্ক করা হয়েছে। ব্যাপারটি যে সত্যিই আশঙ্কার ও চিন্তার, মহারাষ্ট্র ও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিই তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। হাম, রুবেলা রোধে ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি – প্রায় এক মাসব্যাপী টিকাকরণ অভিযান শুরু হচ্ছে এই রাজ্যে। স্বাস্থ্য দফতরের তরফে চলছে তারই প্রস্তুতি। তবে হু-এর বক্তব্য যে একেবারে ভুল নয়, দক্ষিণ সুদানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিও সেই আশঙ্কার দিকেই ইঙ্গিত করছে। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটি সম্প্রতি হামের প্রকোপ বাড়ার কথা ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ সুদানের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের প্রিভেনটিভ হেলথ সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল জন রুমুনু জানিয়েছেন, টানা ৩৮ সপ্তাহ ধরে হামের এই বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। এখনও অবধি দক্ষিণ সুদানে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪৭১ জন। মারা গিয়েছেন ৩১ জন।

আরও পড়ুন : করোনার পর কোন ভাইরাস? অতিমারীর ভয়াল দিন ফেরাচ্ছে জলবায়ুর ভোলবদল?

হাম বা মিসলস এই নামটি বিশ্বের কাছে নতুন নয়। এর আগে ভারত তো বটেই, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। এটিও মূলত ভাইরাসঘটিত রোগ। জ্বর, সর্দি, কাশি, গায়ে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট হওয়ার পাশাপাশি গায়ে র্যা শও বের হয়। লাল লাল র্যা শে ভরে যায় গোটা শরীর। এর চিকিৎসাও অনেকেই জানেন। ডাক্তাররাও নিজেদের কাজে সচেষ্ট। সেইসঙ্গে রয়েছে ভ্যাকসিনও। টিকাকরণের সময় হাম প্রতিরোধের জন্য সেই ভ্যাকসিনও ছোট শিশুদের দেওয়া হয়।

সেভাবেই চলছিল প্রতিরোধ ব্যবস্থা। রিপোর্ট বলছে, দু’বার ভ্যাকসিনের ডোজ নিলে অধিকাংশ খেতেরেই আর ভয়ের ব্যাপার থাকে না। প্রথম ডোজটি জন্মের ১২ মাস পর, এবং দ্বিতীয়টি চার বছর বয়সের সময় দেওয়ার নিয়ম থাকে। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার জেরেই পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছিল। একটা সময় হামের কারণে অনেকে মারা গেলেও ধীরে ধীরে সেই মৃত্যুর হার কমে আসে। মূলত বসন্তকালে ঋতু পরিবর্তনের সময়েই এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যেত। ঠিকঠাক যত্ন, খাওয়া দাওয়ার ফলে সেটা কমেও যেত। কিন্তু ২০২২ সালে সেই ছবিটা পুরোপুরি উল্টে গেল। সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর মাসেই বহু মানুষ হামে আক্রান্ত হয়েছেন। শিশুদের দিকেই প্রকোপের সংখ্যা বেশি।

কেবল ভারত নয়, বিশ্বজুড়ে হঠাৎ কেন হামের প্রাদুর্ভাব? এমনকী মারাও গিয়েছেন অনেকে! প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা দেখে প্রমাদ গুনছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। আবার যেন মহামারীর সম্মুখীন না হতে হয়, সেই আহ্বানই জানিয়েছে হু। কিন্তু সাম্প্রতিক এই উৎপাত কেন? বিশেষজ্ঞরা এর জন্য দায়ী করেছেন তিনটি ইস্যুকে। করোনা, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং বিভিন্ন দেশে টিকাকরণের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অব্যবস্থা।

আরও পড়ুন : সাড়ে ৪৫ হাজার বছরের পুরনো ভাইরাস ডেকে আনছে সর্বনাশ! আবার ঘনাবে মহামারীর কালো ছায়া?

২০২০ সাল হয়তো কোনওদিনই ভুলতে পারবে না মানব সভ্যতা। ‘করোনা’ এই একটি শব্দই যেন রোজনামচা হয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বের। সারাদিন অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ আর আক্রান্ত-মৃতের হিসেব – লকডাউনের পৃথিবী সবসময়ই আতঙ্কে ভুগছিল। কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন তারও কয়েক গুণ। সেইসঙ্গে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে গিয়েছে এই ভাইরাস। করোনা আর হাম – দু’টি রোগই সংক্রামক। দু’টি রোগই মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। ফলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে হাজির হয় আরও নানা সমস্যা। করোনার পর বিভিন্ন পুরনো ও পরিচিত রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা আগে থাকতেই করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দুর্বল শরীরে আরও প্রভাব বিস্তার করছে মিসলস ভাইরাস। ফলে হামও একটু একটু করে ব্যাপক আকার ধারণ করছে।

করোনার সঙ্গেই চলে আসবে টিকাকরণের ইস্যু। ২০২০-র পর গোটা বিশ্বের একটাই প্রশ্ন ছিল, কবে আসবে করোনার ভ্যাকসিন? একের পর এক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও গবেষকরা সেই ভ্যাকসিনের খোঁজে তৎপর হয়েছিল। কোভিশিল্ড ও কো-ভ্যাকসিনের জন্য হাসপাতাল, পুরসভা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে লাইন পড়েছিল বিশাল। স্বাস্থ্যকর্মীরাও সেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এখানেই ঘটে বিপত্তি। করোনার দিকে নজর রাখতে গিয়ে হাম, স্মলপক্স সহ অন্যান্য রোগগুলির কথা ভুলেই গিয়েছিল মানুষ। ছোট থেকে এই রোগগুলিকে আটকাতে বেশকিছু টিকা নিতে হয় সাধারণ মানুষকে। এটাই ছিল বরাবরের দস্তুর। করোনা এসে সেই কাজে প্রথম আঘাত হানল।

টিকাকরণের কাজে যে ঘাটতি হয়েছে, তা মেনে নিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। একই কথা বলছে বিভিন্ন জায়গার সরকারি প্রতিনিধিরাও। সরকারি অব্যবস্থার কথা স্বীকার করছেন প্রত্যেকে। দক্ষিণ সুদানের কথাই ধরা যাক। সেখানকার স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে, ২০২০ সালের পর থেকে সেখানে ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন হয়েইনি! সেই সময়ও সকলের টিকাকরণ হয়নি; ৮৫ শতাংশেরও কম মানুষের হামের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল। একই ছবি অন্যান্য জায়গায়ও। হু জানিয়েছে, ২০২১ সালে গোটা বিশ্বে প্রায় ৪০ মিলিয়ন শিশু একটিও হামের ভ্যাকসিন পায়নি। সেইসঙ্গে ক্রমশ বাড়ছে জনসংখ্যা। শরণার্থী সমস্যা বাড়ছে। আরও ঘিঞ্জি হচ্ছে বিশ্ব। ফলে হামের মতো ছোঁয়াচে রোগের বিস্তারও অত্যন্ত দ্রুত হচ্ছে।

আরও পড়ুন : করোনার পর ফের মহামারীর সামনে পৃথিবী? কারণ দেখিয়ে ভয়াবহ ইঙ্গিত বিজ্ঞানীদের

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নকেও বাদ রাখা যায় না এই তালিকা থেকে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়াও বদলে যাচ্ছে। খামখেয়ালি পরিবেশই এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। দূষণে জেরবার সাধারণ মানুষ। পরিবেশের এই বদলে যাওয়া আবহাওয়াই ভাইরাসের বিস্তারের সুযোগ দিচ্ছে। না গরম, না শীত – সাধারণত এই রকম আবহাওয়ায় বেশিরভাগ ভাইরাস নিজেদের প্রভাব বাড়ায়। সে জন্যই বছরের শেষের দিকে এসে হামের এমন উৎপাত।

তাহলে উপায়? বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রক থেকে হু – সবার বক্তব্য একটাই। যত দ্রুত সম্ভব টিকাকরণের কাজ শুরু করতে হবে। এক মুহূর্তও দেরি করা চলবে না। যত দ্রুত এবং যত বেশি সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, ততই মঙ্গল। শিশু থেকে কিশোর, তরুণ, কেউ যেন এই কর্মসূচি থেকে বাদ না যায়, স্পষ্ট নির্দেশ হু-এর। সেই লক্ষ্যেই কাজ শুরু হয়েছে সব জায়গায়। তবে ভবিষ্যতে এই ভাইরাসদের নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে, সতর্কবার্তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।

More Articles