এবার সমকামীদের জন্য ম্যাট্রিমনি অ্যাপ! ভারতের আইনে স্বীকৃতি মিলবে কবে?

Same Sex Matrimony App: সমকামের অধিকার ছিল আন্দোলন। এখন সেই আন্দোলনকে বিবাহের প্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়ে ‘মেইনস্ট্রিম’ করতে পারলেই আম্মিজানের আরাম।

“আম্মিজান কেহতি থি কোই ধান্দা ছোটা নেহি হোতা, অউর ধান্দে সে জ্যাদা কোই ধরম নেহি হোতা”!

ধরা যাক, এই আম্মিজানের নাম মুনাফা। সুতরাং আম্মিজানের কথামতোই ধান্দা করতে গেলে কোনও এমন কোনও জমিই ছাড়া চলবে না যা আবাদ করে টাকা ফলানো যায়। বিশেষ করে ভারতীয় উর্বর আচার-নির্ভর জমিতে জীবনের ‘সবচেয়ে বড়’ ইভেন্ট থেকে আয় বাড়ানোর কৌশল কোনওভাবেই হাতছাড়া করা যায় না। সবচেয়ে বড় ঘটনা, উৎসব কী? দুর্গাপুজো? ইদ? বড়দিন? আলোর উৎসব? রঙের উৎসব? এসব পার্বণকে যুগে যুগে গোল দিয়ে এসেছে বিবাহ উৎসব। নিছক উৎসব নয়, বিয়ে একটা আস্ত কারখানা, যার ছায়ায় গড়ে উঠেছে বিবিধ অনুসারী শিল্পও! পাত্রের সঙ্গে পাত্রীকে মিলিয়ে দেওয়া হোক বা ইতিমধ্যেই মিলিজুলি পাত্রপাত্রীর বিগ ইভেন্টকে আজীবন স্মরণীয় করে রাখা- প্রতিটি ভাগের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট শিল্পসমিতি। তবে শুধু পাত্রপাত্রীতে আটকে গেলে তো ধান্দা আউটডেটেড। দীর্ঘকালের বাসনাকে এখন আস্তে আস্তে ডানা মেলতে দিচ্ছেন সমকামী মানুষও, সমপ্রেমের মানুষদের বিবাহ-মাল্যদান-ওয়েডিং অ্যালবাম আস্তে আস্তে চোখ সওয়া হচ্ছে সমাজের। এই মোক্ষম বাজারটি না ধরতে পারলে আম্মিজানের বাণীই মিথ্যা। তাই এবার এক সমকামীর সঙ্গে অন্য সমকামীর ঘটকালি সুযোগ হাতছাড়া করছে না ভারতের ম্যাচমেকিং সাইট Matrimony.com লিমিটেড।

LGBTQIA+ মানুষদের জন্য একটি নতুন অ্যাপ তৈরি করেছে এই সংস্থা। সংস্থার দাবি, সমাজের এক বড় অংশকে ধরার জন্যই এই বিশেষ শাখার প্রসারণ। তাহলে প্রশ্ন তিনটে। যাবতীয় ট্যাবু কাটিয়ে সমাজের বড় অংশ বলে কি তবে স্বীকৃত হচ্ছেন সমকামীরা? দুই, যদি হয়েই থাকেন তাহলে ম্যাচ মেকিংয়ের জন্য এখনও কি ম্যাট্রিমনিয়াল অ্যাপই ভরসা? তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভারতে তো সমকামের বিয়ে এখনও স্বীকৃতই নয়, তাহলে কীসের জীবনসঙ্গী নির্বাচন? ম্যাট্রিমনি.কম কোম্পানি যে অ্যাপটি তৈরি করেছে তার নাম রেইনবো লাভ! কোম্পানির দাবি, এই অ্যাপের ভোক্তা হবেন প্রায় ১১ মিলিয়ন থেকে ১৩ মিলিয়ন সমকামী। যদিও ভারতে LGBTQIA+ মানুষদের জনসংখ্যার কোনও সরকারি তথ্যই নেই।

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামীদের আরাধ্য মোরগবাহন বহুচরা দেবী, অচেনার তালিকায় এক রহস্যময় সংযোজন

ভারতে বিবাহ অন্যতম বড় লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছে বেশ কয়েক বছরে। ছাপোষা-ঘরোয়া নয়, সম্পূর্ণটাই গ্র্যান্ড। নেপথ্যে বলিউডের প্রদর্শন প্রভাব যে রয়েছে এই তথ্য এতদিনে সকলেরই জানা। কিন্তু সমকামী বিবাহের মার্কেট ঠিক জনপ্রিয় হয়ে উঠল কবে থেকে? ৩৭৭ ধারার অবলুপ্তি কি সমকামী বিবাহের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকেও বাড়িয়েছে? ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে বিচারপতি রোহিংটন নরিমান, এএম খানউইলকর, ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ও ইন্দু মালহোত্রা সহ পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের রায়ে বাতিল হয়ে যায় ভারতীয় সংবিধানের ব্রিটিশ আমলের ৩৭৭ ধারা। ব্যক্তিগত অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে মেনে নেয় শীর্ষ আদালত। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা নিয়ে ২০১৩ সালে সু্প্রিম কোর্টের রায় যে ‘ভুল’ ছিল, তাও স্বীকার করে নেয় ভারতীয় বিচারব্যবস্থা। বিচারপতি এসকে কউল এবং বিচারপতি এসএ বোবদেও যৌন স্বাধীনতার পক্ষে রায় লেখেন।

LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে জীবনসঙ্গী খুঁজে পান, সেই লক্ষ্যেই Matrimony.com ‘RainbowLuv’ চালু করেছে। সংস্থার লক্ষ্য আগামী তিন বছরে এই সম্প্রদায় থেকে ১.৩ কোটি সদস্যকে এই অ্যাপে নথিভুক্ত করাতেই হবে। সমকাম স্বীকৃত হলেও ভারতে সমকামী বিবাহ এখনও আইনি নয়। তাহলে চতুর্দিক থেকে যে সমলিঙ্গে বিবাহের ছবি ভাইরাল হচ্ছে তার কী? সেই সমস্তটাই আসলে আনুষ্ঠানিক বিবাহ। অর্থাৎ রাষ্ট্র সেই বিয়েকে কোনও মান্যতা দেয় না। রেইনবো লাভ জানিয়েছে, LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপদ এবং বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী খোঁজার প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করতে চেয়েছেন তাঁরা। তাহলে এই জীবনসঙ্গীর সঙ্গে বিয়ে যে পথে এগোবে তা শুধুই আনুষ্ঠানিক। হেটেরোসেক্সুয়াল বিয়ের রীতিনীতি, আনন্দ, হইহুল্লোড়ই সেখানে ভরপুর থাকবে। অর্থাৎ সমাজের চোখে ছেলে এবং মেয়ের প্রেম-যৌনতার অভ্যাসকে সজোরে ঘা দেওয়া যাবে। সমস্ত সম্ভাব্য প্রেমের পরিণতিই যে বিয়ে হতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো অভ্যাস করা যাবে।

আরও পড়ুন- ধূমধাম করে প্রথম সমকামী পুরুষের বিয়ে, কলকাতা সাবালক হল?

Matrimony.com এর চিফ মার্কেটিং অফিসার অর্জুন ভাটিয়া জানিয়েছিলেন, “এক বছরেরও বেশি সময় আগে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপরে, আমরা একাধিক আলোচনা এবং কর্মশালার পরে এই পরিষেবাটি নিয়ে আসি।” এই কথা থেকে স্পষ্ট, ঘটা করে বিয়ের রীতিনীতি পালন, এবং দীর্ঘ যৌন সম্পর্কে-সামাজিক সম্পর্কে প্রবেশের জন্য বিয়েই যে পথ- এই আস্থা রূপান্তরকামী, সমকামীদেরও বদ্ধমূল।

কীভাবে এই অ্যাপটি ‘মনের মানুষের’ সন্ধান দেবে? ৪৫টিরও বেশি লিঙ্গ পরিচয় রয়েছে এই অ্যাপে। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন যৌনপরিচয়ের আওতায় মানুষ নিজেদের ফেলতে পারেন, ১২২টিরও বেশি ওরিয়েন্টেশন ট্যাগ অর্থাৎ সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি প্রেফারেন্স এবং ৪৮ টিরও বেশি সর্বনাম অ্যাপটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানেই শেষ না, প্রোফাইলে ছবির পাশাপাশি সেলফি আপলোড করে নিজেদের প্রোফাইল যাচাইও করতে হবে। সত্যিকারের প্রোফাইলগুলি খুঁজতে সরকারি বৈধ পরিচয়পত্রও লাগবে। যে বিবাহ-প্রেম-যৌনতার ইচ্ছাকে অপরাধ বলেছিল আইন ও সমাজ, যার বিরুদ্ধে গিয়ে শুরু হয়েছিল আইনি স্বীকৃতির লড়াই, সমাজের সেই বিবাহবন্ধনকেই জনপ্রিয় ও প্রেমের একমাত্র পরিণতি ভাবাতে তৎপর সমস্ত কর্পোরেটই। সমকামের অধিকার ছিল আন্দোলন। এখন সেই আন্দোলনকে বিবাহের প্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়ে ‘মেইনস্ট্রিম’ করতে পারলেই আম্মিজানের আরাম।

More Articles