ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদা: ফেলে আসা প্রথম প্রেমের অবিচল চরণধ্বনি

Rituparno Ghosh: পার্থ নেশাঘোর অবস্থায় রিহার্সালের সময় ড্রাম বাজাতে ভুলে যায়। মঞ্চে উঠে, পা দিয়ে মেরে মেঝেয় ফেলে দেয় রুদ্র। তৎক্ষণাৎ উঠে, রুদ্রর পা থেকে তার ঘুঙুরটা খুলে নিয়ে বাথরুমে চলে যায় পার্থ।

আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সন্ধেবেলা। আমার দাদা, খুব সুন্দর গান গায়। সেদিন ঘুরে-ফিরে একটি গানের প্রথম একটি লাইনই কেবল গেয়ে চলেছে। আমি রয়েছি ঘরে। উড়ে আসছে সে গানের সুর। খুব সুন্দর গাইছে দাদা কিন্তু ভেতরে ঢুকছে না। কেবল কতগুলো সুরশব্দ হয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে মনে।

কিছুক্ষণ পরেই দাদা-ভাই একসঙ্গে বেরোলাম। টোটো করে। গ্রীষ্ম শুরু হওয়ার আগে এক ধরনের হাওয়া দেয়। কী যেন একটা থাকে সেই হাওয়ার ভেতর, ঠিক বুঝতে পারি না। তেমনই এক হাওয়া চলাচল। আমি বসে আছি টোটোর বিপরীতে, আর দাদা বসেছে যেদিকে আমরা যাচ্ছি সেই অভিমুখে। দাদা, তখনও গেয়ে চলেছে। সেই একটিই গান। বেশি না, সে গানের একটি মাত্র লাইন। গাইছে। থামছে। আবার কিছুক্ষণ পর গাইছে।

কী সেই গান? রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথম আলোর চরণ ধ্বনি’। যাঁরা এ-গান শুনেছেন, তাঁরা জানেন ‘ধ্বনি’ শব্দটিকে একটি জলাশয়ের মধ্যে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে যেন সামান্য চলন উপহার দেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা মনে শুধু জিজ্ঞাসা জন্মায়, প্রথম আলো কী? প্রথম আলো কে?
দাদা, টোটোতে বসে গেয়ে চলেছে। আর আমি দেখছি, একজন, অন্যমনস্ক হাতে কিছু খাবার কিনে নিয়ে হাঁটছে। এই রাস্তাতেই তার বাড়ি।

এই রাস্তাতেই তার সঙ্গে বহু বহু দিন দাঁড়িয়ে থেকেছি। কথা বলেছি। বৃষ্টি এলে ঢুকে পড়েছি পাশের দোকানের ছাউনিতে। তার সারা শরীর শান্ত সন্ধেবেলার মতো। কতদিন কথা বলিনি আমরা। দেখা হয়নি কত কত দিন।

আরও পড়ুন- স্মৃতি আসলে কার? ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এ যে উত্তর খুঁজেছেন ঋতুপর্ণ

এই দেখা হল। আমি ভাবলাম, আরে এই তো সে! ‘প্রথম আলোর চরণ ধ্বনি’। এর কারণেই তো আমার ভেতরে জেগে উঠেছিল প্রথম প্রেম! এর জন্যই, সেই প্রেমের চরণ ধ্বনি প্রথম শুনতে পেয়েছিলাম মনে-মনে!

পাশে বসে, দাদা জানতে পারেনি কিছুই কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝেছিলাম, সেদিন সন্ধ্যার ভেতর যে হেঁটে যাচ্ছে, সে-ই হলো আমার প্রথম আলো! তাকে আমি ভুলে যাই, অপছন্দ করি, তবুও সে-ই প্রথম আমার ভেতরে একদিন জাগিয়ে তুলেছিল অনুভবের বিচিত্র জগৎ। যেখানে, ভবিষ্যতে এসে বসবে আরও কত কত মানুষেরা। কিন্তু সে থাকবে, অবিচল।

‘চিত্রাঙ্গদা’-য় এমনই একজন প্রথম আলোর কথা আজ বলব। ভাবতে চাইব, ছবির তিনটি দৃশ্যকে।

ছবিতে, পার্থ নেশাঘোর অবস্থায় রিহার্সালের সময় ড্রাম বাজাতে ভুলে যায়। মঞ্চে উঠে, পা দিয়ে মেরে মেঝেয় ফেলে দেয় রুদ্র। তৎক্ষণাৎ উঠে, রুদ্রর পা থেকে তার ঘুঙুরটা খুলে নিয়ে বাথরুমে চলে যায় পার্থ। রুদ্রর অনেকবার বলা সত্ত্বেও ফেরত দেয় না। বরং ঘুঙুরটি ফেলে দেয় কমোডের জলে। এরপরই পার্থকে দল থেকে চলে যেতে বলা হয়।

সেই রাতেই রুদ্রর বাড়িতে, ওর ঘরে এসে পার্থ বলে, ‘আই ওন্ট কল ইউ রুদ্রদা।’ রুদ্র জানায়, দলে থাকতে গেলে বাকি সবার মতো পার্থকেও ‘রুদ্রদা’ই বলতে হবে। পার্থ বলে,

পার্থ। আই উইল কল্ড ইউ রুডি।
রুদ্র। ওয়াট?
পার্থ। রুডি!

‘রুডি’ কথাটি শোনামাত্র, ঋতুপর্ণ নিজের অভিনয়ের ভেতর এক লজ্জামিশ্রিত বিস্ময় নিয়ে এসেছিলেন। আপাত অর্থে মনে এই লজ্জা পার্থর প্রতি। কিন্তু এই দৃশ্যটির সংযোগসূত্রেই অন্য একটি দৃশ্য এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। আমরা দেখতে পাই, নাটকের ব্যাক স্টেজে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। পাশে একজন লোক। রোহিত। ওর প্রথম প্রেমিক। রোহিত একটি আংটি উপহার দেয় রুদ্রকে। তা নিয়েই ওদের সংলাপমুহূর্তটি এমন:

রোহিত। রুডি দিস ইজ ফর ইউ! পছন্দ হয়েছে?
রুদ্র। খুব সুন্দর! খুব সুন্দর ডিজাইনটা!
রোহিত। কী পরবে তো?
রুদ্র। কেন? না পরলে অন্য কাউকে দিয়ে দেবে?
রোহিত। (হাসি)
রুদ্র। তুমি কি সব সময় পরার কথা বলছ?
রোহিত। আপ টু ইউ
রুদ্র। এটা সব পোশাকের সঙ্গে যাবে না রোহিত!

এই সংলাপমুহূর্তটি দু'টি সংকেততথ্য দিতে চায় আমাদের। এক, রুদ্রর সেই লজ্জাবিস্ময় আসলে ছিল নিজের ফেলে আসা অনুভবকে আরেকবার দেখতে পাওয়ার দিকেই ধাবমান। কারণ, রোহিতও তাকে ‘রুডি’ নামেই ডাকত। দুই, রুদ্রকে একটি আংটি দেয় রোহিত। রুদ্র বলে, ‘তুমি কি সব সময় পরার কথা বলছ?’ রোহিত উত্তর দেয়, ‘আপ টু ইউ’। স্বাভাবিক এই কথোপকথনের ভিন্ন একটি স্তরকে খুঁজে পাওয়া যায় ছবির মধ্য অংশে পৌঁছে।

এবার বলি, ‘চিত্রাঙ্গদা’-র সেই মধ্য অংশ দৃশ্যটির কথা। কোনারকের মন্দির। পার্থ, নিজের আর রুদ্রর ছবি তোলার জন্য একজন ফটোগ্রাফারকে ডেকে আনে। রুদ্র সেই ফটোগ্রাফারকে দেখে অবাক হয়। আমরা বুঝতে পারি কেন? কারণ, সেই ফটোগ্রাফার রোহিত। ওর প্রথম প্রেমিক। ছবি তোলার সময় রোহিত পার্থকে বলে রুদ্রর কাছাকাছি যেতে। পার্থ যায়ও। কিন্তু রোহিতের সামনে পার্থর স্পর্শে একটা আচমকা অস্বস্তি হতে শুরু করে রুদ্রর। পার্থ সামান্য দূরে গেলে ওরা কথা বলতে থাকে।

রোহিত। আচ্ছা, হি অল সো কলস ইউ রুডি?
রুদ্র। হুম। কিন্তু আমি আগের মতো রুড বোধহয় নেই জানো! অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। (রোহিত ক্যামেরায় ছবি তুলতে গেলে) আর তুলো না!
রোহিত। কেন?
রুদ্র। (হাতটা রোহিতের মুখের দিকে এগিয়ে) তোমার দাড়িগুলো পেকে গেছে সব! চুল?
রোহিত। (ঘাড় নাড়িয়ে না বলে) খুব একটা না।
রুদ্র। কালো করো না প্লিজ! কালো করলে ভালো দেখাবে না!
রোহিত। বেশি দিন কালো না করলে তোমার ভালো লাগবে?
রুদ্র। ওহ্‌, চিনতে পারছ? (নিজের আঙুলে-পরা আংটি দেখিয়ে)
রোহিত। না। ওয়াট'স দিস?
রুদ্র। তোমার আংটিটা! ডিজাইনটা সোনায় গড়িয়ে নিয়েছি। পাথরটা কালো!
রোহিত। তোমার সব পোশাকের সাথে তাহলে পরতে পারবে তো?
রুদ্র। জানি না।
(এই কথোপকথন চলতে চলতেই আমরা দেখতে পাই হোটেলের ঘরে ঘুমে মগ্ন পার্থকে।)
রোহিত। কেন? তুমি তো তাই চেয়েছিলে রুডি?

‘এখনও নারীর মানে তুমি কত কত রাধিকা ফুরালো’, লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। অর্থাৎ যারা যারাই আমার জীবনে এল, তাদের সবাইকে আমি চিনতে পারলাম আমার ভেতরে একদিন তুমি যে আলো জ্বেলেছিলে, সেই আলোর মধ্যে দিয়েই। এখানে আমি চির নতমস্তক হই ঋতুপর্ণ ঘোষের সংলাপের কাব্য-ক্ষমতার পায়ে। পার্থ বলছে, ‘তোমার আংটিটা! ডিজাইনটা সোনায় গড়িয়ে নিয়েছি। পাথরটা কালো!’ এর উত্তরে রোহিত বলছে, ‘তোমার সব পোশাকের সাথে তাহলে পরতে পারবে তো?’ এই সব পোশাক আসলে কী? আর ওই আংটিটার বা কী অর্থ?

আরও পড়ুন- মা আর সন্তানের নাড়ির স্বরে দেহের সংজ্ঞা লেখে ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদা

এই সব পোশাক, আমার জীবনের এক একজন প্রেম-সম্পর্ক। আংটিটা সোনায় গড়িয়ে নিয়েছে রুদ্র। এখন সব পোশাকের সঙ্গে সে পরতে পারবে। অর্থাৎ জীবনের সমস্ত সম্পর্কের মধ্যেই ওই ফেলে আসা প্রথম প্রেম জেগে থাকবে তার। ‘প্রথম আলোর চরণ ধ্বনি’ বাজতেই থাকবে। এরপর, শেষ যে দৃশ্যটি নিয়ে কথা বলব, তা আমরা দেখতে পাই ছবি উপান্তে পৌঁছে। সমুদ্রের তীরে, শুভ আর রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে।

শুভ। আচ্ছা, সূর্য ওঠার আগের মুহূর্তটাকে কী বলে বলো তো?
রুদ্র। ঊষা?
শুভ। বা, ম্যাজিক আওয়ার! আচ্ছা, ধরো যদি মদন এসে তোমাকে একটা বর দিতে চায়। কী চাইবে?
রুদ্র। আমি ফিরে যাব।
শুভ। এই সেই বাড়ি। চিনতে পারছ?
রুদ্র। কোনটা বলো তো?
শুভ। তুমি আর পার্থ কিনবে বলেছিলে। একসঙ্গে থাকবে। যাবে? ভেতরে?

এরপরই আমরা দেখতে পাই, বাড়িটির মধ্যে রুদ্র প্রবেশ করে। বাড়ি ঠিক নয়, একটা ঘর। সেই ঘর-ভর্তি, রুদ্রর জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবির নেগেটিভ তারে তারে শুকোতে দেওয়া। ঘরে একটা লাল আলো।

রুদ্র। তুমি?
রোহিত। এসো।
রুদ্র। অ্যাম সরি। অ্যাম সো সো সরি!
রোহিত। ওয়াই?
রুদ্র। ওয়াই আই হ্যাভ টু স্পয়েল থিংস ফর ইউ অল দ্য টাইম।
রোহিত। ডোন্ট বি রুডি!
রুদ্র। শুধু শুধু আলো ঢুকিয়ে দিলাম। তোমার রাগ হচ্ছে না?
রোহিত। না
রুদ্র। কিছু বলবে না আমায়?
রোহিত। কেন? কোনওদিনও বলেছি?
রুদ্র। কেন বলোনি?
রোহিত। দেখি। আংটিটা কোথায়? খুলে ফেলেছ?
রুদ্র। হসপিটালে ওরা অ্যালাও করে না।
রোহিত। হুম্‌
রুদ্র। তুমি এখানে?
রোহিত। আমি তো এখানেই থাকি। থাকবে তুমি? আমার সঙ্গে? ডোন্ট ওয়ারি, দেয়ার’স নাথিং মাচ ইউ ক্যান স্পয়েল মোর!
রুদ্র। না গো! সরি! আমার বাবা-মা আমার ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। মা খুব সুন্দর সুন্দর পর্দা কিনে এনেছে, আমি বাড়ি যাই হুম?

পার্থ যে বাড়ি কিনতে চাইত, সেই বাড়িতেই রোহিত রুদ্রর জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবিকে টাঙিয়ে রাখছে। আমাদের তখন মনে হয়, রোহিত আর কোনও চরিত্র নয়, এখানে একটি প্রথম অনুভবের প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখা দিতে চায়। আমার জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভব, আমি যেমন সে অনুভবের মধ্যে দিয়ে সবাইকে দেখছি, সে-ও তো আমার সব কিছু দেখছে। এখানে রোহিতও ঠিক তাই।
রোহিত সেই আদি, সেই প্রথম। যে নীরব আলো হয়ে জ্বলতে থাকে। আমরা চাই বা না চাই। সেই প্রথম আলোর চরণ ধ্বনি ফুরোয় না কোনওদিন।

More Articles