যোগ্যতা সত্ত্বেও রূপান্তরকামীকে চাকরি দিতে গাফিলতি! রাজ্যকে কড়া নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের
Calcutta High Court: মৃণাল বারিক একজন রূপান্তরকামী মহিলা। প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে দু-দুবার পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করার পরেও মেলেনি চাকরি। সেই ব্যাপারটি নিয়েই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন মৃণাল।
তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরকামীদের অধিকার স্বীকৃত হলেও আজও সমাজের সব ক্ষেত্রে তাঁদের তেমন করে গ্রহণযোগ্যতা নেই। এমনকী চাকরিক্ষেত্রেও। সম্প্রতি সেই ব্যাপারটি নিয়েই মামলা গড়িয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত। সেখানে মৃণাল বারিক বনাম রাজ্য সরকার— এই সংক্রান্ত একটি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ রায় দিল কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ। রাজ্য সরকারি চাকরিতে অন্তত ১ শতাংশ সংরক্ষণ রূপান্তরকামী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য রাখতেই হবে, সাফ জানিয়ে দিল হাইকোর্ট।
২০১৪ সালে নালসা রায় কার্যত বদলে দিয়েছিল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সামাজিক অবস্থাটা। দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানের পাশাপাশি মিলেছিল ভোটাধিকার। সমাজের বাকি সকলের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটার জোর। কিন্তু সংবিধান স্বীকৃতি দিলেও বাস্তব ক্ষেত্রে কি অবস্থাটা বদলেছে? এখনও তো রাস্তার মোড়ে মোড়ে, সিগন্যালে, ট্রেনে-বাসে হাতে তালি দিয়ে মাধুকরী করতে দেখা যায় অসংখ্য তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনকে। তাঁদের মাথা তুলে রুজি রোজগারের অধিকারটুকু সংরক্ষণ করতে পারেনি সরকার।
আরও পড়ুন: শিলিগুড়িতে এলজিবিটিকিউ ফ্যাশন শো: রঙিন বার্তা রূপান্তরকামীদের
মৃণাল বারিক একজন রূপান্তরকামী মহিলা। মেদিনীপুরে জন্ম। ছোট থেকেই তাঁর ইচ্ছা শিক্ষক হওয়ার। ২০১৪ ও ২০২২ সালের টেট পরীক্ষায় সফলও হন তিনি। তবে শিক্ষক হিসেবে চাকরি পাওয়া সহজ ছিল না। বাধ্য হয়ে লকডাউনের সময় পেট চালানোর টানে রাস্তার মোড়ে ভিক্ষা করেছেন মৃণাল। পরবর্তীকালে শুরু করেন প্রাইভেটে ছাত্রপড়ানো, যাকে বলে টিউশনি। প্রথম প্রথম ভয় ছিল, আদৌ তাঁর কাছে ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাবেন বাবা-মায়েরা? বাবা-মায়েরাও ভয় পেতেন, পাছে শিক্ষকের কাছে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায় ছেলেমেয়েরা। দিশাহারা মৃণাল সেক্স-রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির কথাও ভেবেছেন একসময়। কিন্তু টাকার ব্যবস্থা কোথা থেকে হবে? মৃণালের আর্থিক পরিস্থিতি তো তেমন স্বচ্ছল নয়। সেখান থেকে লড়াই শুরু হয় মৃণালের।
প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে দু-দুবার পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করার পরেও মেলেনি চাকরি। সেই ব্যাপারটি নিয়েই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন মৃণাল। সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, ইমতিয়াজ আখতার-সহ একাধিক আইনজীবী একত্রে লড়েন মৃণালের মামলাটি। তাঁরা আদালতে জানান, মৃণাল রূপান্তরকামী। ২০১৪ এবং ২০২২ সালে প্রাথমিক টেট পাশ করার পরেও ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পাননি মৃণাল। সেই মামলা ওঠে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার একক বেঞ্চে।
সেই মামলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন বিচারপতি মান্থা। হাইকোর্টের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে অবিলম্বে মৃণালের ইন্টারভিউ নিতে হবে এবং কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ হলে যথাযথ চাকরিতে বহাল করতে হবে।
বিচারপতি মান্থা ওই মামলার রায় দিতে গিয়ে রূপান্তরকামীদের সাংবিধানিক অধিকার প্রসঙ্গে ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের নালসা রায়ের কথাও তুলে ধরেন। তাতে পিছিয়ে থাকা বা সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণি হিসাবে রূপান্তরকামীদের জন্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে একটি পরিসর তৈরির কথাও বলা হয়েছিল। বাস্তবে এ দেশের বিভিন্ন রাজ্য কর্নাটক, তামিলনাডু, কেরল, মহারাষ্ট্র থেকে বাংলার পড়শি রাজ্য ওড়িশাও রূপান্তরকামীদের জন্য সরকারি চাকরিতে এক শতাংশ সংরক্ষণ কার্যকর করেছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা তো দূরের, বিষয়টি নিয়ে কোনও মাথাব্য়থাও নেই বলে অভিযোগ। হাইকোর্ট জানায়, এর আগে রূপান্তরকামীদের চাকরির ক্ষেত্রে সমানাধিকার নিয়ে রাজ্যের নারী এবং শিশুকল্যাণ দফতর একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। সেই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে রাজ্যের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি বৈঠকও হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কমিটিতেও এক জন রূপান্তরকামী সদস্য আছেন। কিন্তু রূপান্তরকামীদের অস্তিত্বটুকু খাতায়-কলমে স্বীকার করা ছাড়া তাঁদের জন্য কাজের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক পরিসর তৈরি করতে রাজ্য এক কদমও এগোয়নি বলে দাবি করেছেন সমাজকর্মীদের অনেকেই।
আরও পড়ুন: রূপান্তরকামী হিসেবে মোক্ষম জবাব সমাজকে, আলাপচারিতায় উচ্চমাধ্যমিকে সপ্তম স্মরণ্যা ঘোষ
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সুপ্রিম কোর্টের নালসা রায়ের পরে সবার প্রথম পশ্চিমবঙ্গেই ট্রান্সজেন্ডার ডেভলপমেন্ট বোর্ড গড়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে রূপান্তরকামীদের জন্য কোনও উদ্যোগ বা কাজের কোনও নজির নেই। সরকারি চাকরির সুবিঘা তো দূরে থাক, রূপান্তরকামীদের পরিচয়পত্রের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি নথিটুকু বের করতেও কালঘাম ছুটে যায়। অথচ এ ব্যাপারটি নিয়ে নড়েচড়ে বসে না রাজ্যের সরকার। এ বার সে বিষয়টি নিয়েই কড়া নির্দেশ দিল হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের রায় সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামায়নি সরকার। হাইকোর্টের এই রায়ের পরে আদৌ কি পরিস্থিতি পাল্টাবে? চাকরি পাবেন রূপান্তরকামী মৃণাল? সামাজিক সম্মান নিয়ে আদৌ জুটবে তাঁদের ভাগ্যে? ফের সেই প্রশ্নই তুলে দিয়ে গেল এই মামলা।