রামধনু আলোর বশবর্তী হয়ে
Kolkata Pride Walk : ডিসেম্বরে শীতের মিছিলের মাঝখানে হাঁটতে শরীরে ঘাম ঝরে। দম নিতে ভিড়ের বাইরে ফুটপাথে এসে দাঁড়াতে হয়।
জীবনের ত্রিশ বছরের অধিক সময় ধরে আবহমান অনধিকার যে নৈরাশ্য সৃষ্টি করে, তার ভিতর আলোর প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই নতুন করে এ বছরেও বিশেষ কোনও আশায় বুক বাঁধিনি। বছরের প্রথমার্ধে তবু সমপ্রেম বিবাহ সংক্রান্ত আইন ও অন্যান্য তৎসংলগ্ন আইনের পরিমার্জন বিষয়ে যখন আলোচনা শুরু হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে, তখন গায়ের ধুলো ঝেড়ে মাটি হতে উঠে দাঁড়াই করপ্রদানকারী, দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। দ্বিতীয় শ্রেণি বলছি কেন? জন্ম হতে আজ অবধি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা যা অধিকার পেয়ে থাকেন, আমাদের তা দেওয়া হয়নি─বিবাহ, দত্তক নেওয়া সন্তানের যুগ্ম দায়িত্ব, বিবাহিত দম্পতির প্রাপ্য যাবতীয় অধিকার। যতদিন না আইন ও সমাজের চোখে আমরা আর পাঁচজন মানুষের সমান হচ্ছি এবং সমস্ত অধিকার পাচ্ছি ততদিন আমি আমায় এবং আমার মতো মানুষদের তাই মনে করব।
ঘটনাচক্রে পেশাগত কাজে এপ্রিল মাসে আমায় দিল্লি যেতে হয়েছিল, এবং ১৮ তারিখ দেখলাম সেখানে সবাই নিরুত্তাপ, জনমানসে সুপ্রিম কোর্টের এত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কোনও ঢেউ তোলে না। এ ব্যর্থতা আমাদের প্রত্যেকের। সামাজিকভাবে এখনও প্রান্তিক যৌনতার মানুষকে এক সারিতে হেটেরোসেক্সুয়াল জনগোষ্ঠীর পাশে বসতে দেখা যাচ্ছে না। দোষ নয়, দায় সকলের। কেবলমাত্র সংবাদ মাধ্যমে আমরা পর্যায়ক্রমে জানতে পারি প্রধান বিচারপতি বিষয়টি আলোচনার ভার আরোপ করলেন পাঁচ বিচারকের এক বেঞ্চকে।
আরও পড়ুন: বড়দিন : অলোকপর্ণা
এরপর যা হয়─সামাজিক মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যমে দু' তিনদিন কিছু আলোচনা চলার পর প্রত্যেকে বিষয়টি বিস্মৃত হলেন। সংবাদ মাধ্যমে বহু খুঁজেও নতুন কোনও তথ্য আর পাওয়া গেল না। বছরের শেষদিকে বিচারকমণ্ডলী ফিরলেন আদালতে, আমরা প্রমাদ গুনলাম, আশায় বুক বেঁধে। প্রধান বিচারপতি জানালেন তিনি প্রান্তিক যৌনতার মানুষের সমানাধিকারের প্রশ্নে সংবেদনশীল, তবু বিবাহ-সংক্রান্ত আইন পরিমার্জন করার মতো ক্ষমতা প্রধান বিচারালয়ের নেই, দায় ন্যস্ত হল লোকসভার উপর। প্রসঙ্গত, দেশের শাসকদল প্রান্তিক যৌনতার মানুষের বিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের বিরোধিতায় প্রথম থেকেই সোচ্চার। অতএব ত্রিশাধিক বছরের নিরবচ্ছিন্ন নিরাশায় ঘাটতি হল না কোনও।
তেইশ সালের শেষ মাসে তবু শহরের বুকে মিছিল নামে। কলকাতা প্রাইড। প্রতিবছরের মতো এবছরও মিছিলের দাবি বদলায় না। প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার চেয়ে পার্ক সার্কাস থেকে পার্ক স্ট্রিট ছুঁয়ে মিছিল চলে ময়দানের দিকে। নিরাশার আরও একটা বছর কাটিয়ে টের পাই মিছিলে মানুষের মাথা যেন সংখ্যায় বেড়েছে। ডিসেম্বরে শীতের মিছিলের মাঝখানে হাঁটতে শরীরে ঘাম ঝরে। দম নিতে ভিড়ের বাইরে ফুটপাথে এসে দাঁড়াতে হয়। দেখি ‘Love is love’, ‘We want equality’ পাশাপাশি মানুষ প্যালেস্টাইনে নির্মম গণহত্যার বিরূদ্ধেও স্লোগান তুলছেন। অর্থাৎ লড়াইটা কেবল প্রান্তিক যৌনতার মানুষের নয়, ধীরে ধীরে তা হয়ে পড়ছে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তিক মানুষের নিজেদের।
আরও পড়ুন: ডিসেম্বরের শহরে রামধনু যাত্রা! কলকাতা কি সত্যিই সাবালক হয়েছে আজও?
বলিউডের দৌলতে আজকাল সমপ্রেম বৈঠকখানায় অনধিকার প্রবেশ করেছে। জনপ্রিয় অভিনেত্রী রূপান্তরিত নারীর ভূমিকায় অভিনয় করে তারিফ পাচ্ছেন। তবু প্রান্তিক যৌনতার মানুষের বিবাহের সামানাধিকারের প্রশ্নে দেখি হোমোফোবিক মানুষের বক্তব্য─আবার বিবাহ কেন? আমি প্রতিপ্রশ্ন করি─কেন নয়? একই জমিতে দাঁড়িয়ে, বছরের পর বছর একই দেশের মাটিতে বেড়ে উঠে, নিয়মিত ভোট এবং কর দেওয়ার পরেও কেন কিছু মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হবে? প্রতিবেশী দেশ নেপাল, যেখানে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই দেশও এই বছর সমপ্রেম বিবাহ আইনভুক্ত করে এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেখানে কেন আমার ধর্মনিরপেক্ষ দেশ পিছিয়ে থাকবে? আমরা কেন পিছিয়ে থাকব?
তবু আলো কি ক্রমে আসিতেছে না? অস্বীকার করব না। কিঞ্চিৎ লেখালেখির সূত্রে এই অতিসামান্য আমিও এখন প্রকাশকের কাছ থেকে উৎসাহ পাই ভিন্ন যৌনতা বিষয়ক শিল্প নিয়ে চর্চা করার। বাঙালি পাঠক পূর্বেও 'হলদে গোলাপ’, 'ব্রহ্মভার্গবপুরাণে'র মতো অনেক বইকে আপন করে নিতে পেরেছেন। পুরুষের শাড়ি পরা, অলংকার পরাকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে প্রকাশ্যে। আবার এর বিপরীত স্বর যে পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে তা নয়, তবে আগের তুলনায় তা সংখ্যায় কমেছে। এবং ভবিষ্যতে প্রাথমিক সামাজিক শিক্ষায় প্রান্তিক যৌনতা এবং সেই সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আমি আশা রাখি।