ঋতুপর্ণর ‘চিত্রাঙ্গদা’ একটা ইচ্ছের গল্প, কিন্তু কার?

Rituparno Ghosh: ‘চিত্রাঙ্গদা’ একটা ইচ্ছের গল্প, বলেছিলেন ঋতুপর্ণ। হ্যাঁ তাই। কিন্তু ইচ্ছেটা কার? আমার মনে হয় কেবল রুদ্রর।

আমি বহু বছর ধরে, অজস্র বার ঘুরেফিরে ‘চিত্রাঙ্গদা’ দেখেছি। এখনও দেখি। সম্পূর্ণ ছবির পাশাপাশি, কখনও কোনও পৃথক দৃশ্য, অভিনয়, কিংবা সংলাপ খণ্ডভাবে তুলে নিই মনের ভেতর। এ এমন এক ছবি, যার মধ্যে বহু স্তরে মনের গভীর সংকেত ও রহস্যের শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে। এত বছর ধরে ছবিটি দেখতে দেখতে প্রায়ই মনে হয় একটি দৃশ্যের কথা। যে দৃশ্যটি যদি এ সিনেমায় না ঘটত, তাহলে বোধহয়, ছবিটি এগোত না। বলা ভালো, অন্যরকম হতো এর সমাপ্তি।

দৃশ্যটি আপাত অর্থে জীবনের আর পাঁচটা ঘটনার মতোই সামান্য কিন্তু ছবির মূল নিয়ন্ত্রক ভাবনা এই দৃশ্যটির দ্বারা পরিচালিত। এ অনেকটা আমাদের নিয়তি মুহূর্তের মতোই। এমন ঘটনা আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই আছে, যা পরবর্তী সময়ে আমাদের জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ‘চিত্রাঙ্গদা’-র ক্ষেত্রে তেমনই একটি ঘটনা মুহূর্তের কথা আজ বলব।

যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, পুরীর সমুদ্র থেকে ফেরার পথে রুদ্র, তাঁর সহায়ক মনীশবাবুর কাছে মালা-র খোঁজ নেয়। কিছুটা আচমকাই। মালাকে দেখা করতে বলে। ছবিতে, রুদ্র আমাদের জানায়,

ফিরে আসার দু'দিন পরে মালা এল। মালা আগে নাচত। আমায় খুব ভালোবাসে। ওর সঙ্গে দু'জন এল, আর তারপরেই আমার জীবনটা কেমন আস্তে আস্তে বদলে গেল।

বদলে গেল কেন? দৃশ্যটির দিকে তাকানো যাক। ঘরে তিনজন। মালা, রুদ্র এবং মালার বাচ্চার ঘরে ঢুকে আসা, পার্থ। সংলাপ-মুহূর্তটি এমন:

রুদ্র। একটা ফোন না করলে আসতে পারিস না?
মালা। রুদ্রদা, আমি সময় পাই না।
রুদ্র। ন্যাকামি করিস না। কী রাজকাজ তোর রে? বাড়িতে বসে আছিস! কতবার বলেছি, আয়!
মালা। বিশ্বাস করো আমি সময় পাই না। আর একটা সত্যি কথা বলব তোমাকে?
রুদ্র। কী?
মালা। নেচে আমি আর কতদূর যাব বলো? বড়জোর তোমার দৌলতে দু'বার বিদেশে যাব। আমাকে ছাড়াও তো তোমার চলবে, চলছে তো! কিন্তু আমায় ছাড়া আমার সংসারটা একদম চলবে না, বিশ্বাস করো!

দরজায় কড়া পড়ল। পার্থর প্রবেশ। ওর সঙ্গে মালার বাচ্চা।

রুদ্র। এসো। এরা কারা?
মালা। আমার ছেলে।
রুদ্র। কোথায় ছিল এরা এতক্ষণ?
পার্থ। গাড়ির মধ্যে বসেছিল।
মালা। এসো, এদিকে এসো। প্রণাম করো।
রুদ্র। গাড়িতে বসেছিল কেন?
পার্থ। কেন আবার? তোমার ভয়ে।
রুদ্র। কী নাম তোমার?
মালা। ওর নাম সায়ন্তন আর ওর দাদার নাম সমন্তক।
রুদ্র। এত শক্ত নাম দিয়েছিস কেন?
মালা। তোমার ভালো লাগবে বলে।
পার্থ। সি ওয়াট আ টেরার ইউ আর!
পার্থ বাচ্চাটিকে বারান্দায় নীচে যায় এবং বাচ্চাটির সঙ্গে খোলাভাবে মিশতে থাকে।

পার্থ যে বাচ্চাদের সঙ্গ খুব পছন্দ করে, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে ভালোবাসে, এই দৃশ্যটির মধ্যে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই রুদ্রও তা বুঝতে পারে। এই দৃশ্যটির ঠিক পরের দৃশ্য, এখানে তাই গুরুত্বপূর্ণ। রুদ্রর বাড়ির বারান্দা এবং সন্ধেবেলার আলো না-জ্বালা ছায়া-অন্ধকার ঘর। এই দু'টি মিলিয়ে ছবিতে ঘটেছে এই দৃশ্যটি। নীচে রুদ্র ও পার্থর কথোপকথন তুলে দিলাম:

রুদ্র। তুমি বাচ্চা খুব ভালোবাসো না?
পার্থ। বাচ্চা তো সবাই ভালোবাসে। এটা আলাদা করে বলার কী আছে? কী হলো!
রুদ্র। লেট মি মুভ আওয়ে পার্থ।
পার্থ। কোথায়?
রুদ্র। গেট ম্যারেড, হ্যাভ চিলড্রেন। আই হ্যাভ নো রোল ইন ইওর লাইফ।

পার্থ। ওকে, ইফ ইট কামস টু দ্যাট, উই উইল অ্যাডপ্ট আ চাইল্ড।
রুদ্র। ইউ আর কিডিং?
পার্থ। নো, আই অ্যাম সিরিয়াস।
রুদ্র। তাতে, চলবে তোমার?
পার্থ। কেন? আ বেবি ইজ বেবি।
রুদ্র। না, না। হবে না। ইটস নট পসিবল।
পার্থ। কেন? তুমি সময় দিতে পারবে না?
রুদ্র। টু মেল পেরেন্টস কানট অ্যাডপ্ট আ চাইল্ড ইন দিস কান্ট্রি।
পার্থ। ওয়াট ননসেন্স?
রুদ্র। থিস ইজ দ্য ট্রুথ, দিস ইজ দ্য ল অফ দ্য কান্ট্রি। আই হ্যাভ অ্যান আইডিয়া। বকবে না?
পার্থ। শুট।
রুদ্র। আমি সেক্স চেঞ্জ করে নেব। ধরো টেকনিক্যালি আই বিকাম আ ওমেন, উই আর আ কাপল, উই ক্যান গো টুগেদার অ্যান্ড অ্যাডপ্ট আ চাইল্ড।
পার্থ। আমি পাগল, গায়ে লেখা থাকে না।
রুদ্র। আমি ঠাট্টা করছি না পার্থ, প্লিজ শোনো। ইটস আ ফিজেবল আইডিয়া।

এই কথোপকথনটিকে আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। ছবিটির শেষের পর্যায়, পার্থর সঙ্গে রুদ্রর বিচ্ছেদ আমাদের তা ভুলতে বাধ্য করে। কিন্তু এখানে একটি জিনিস লক্ষ্য করার মতো। সেক্স চেঞ্জ করার কথা কিন্তু প্রথম রুদ্র বলছে। পার্থ নয়।

আরও পড়ুন-মা আর সন্তানের নাড়ির স্বরে দেহের সংজ্ঞা লেখে ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদা

প্রশ্ন উঠতে পারে, হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু রুদ্র সেক্স চেঞ্জ করাতে চায় যাতে ও আর পার্থ সন্তান অ্যাডপ্ট করতে পারে। এমনকী ড. সোমের কাছে গিয়েও রুদ্র স্পষ্ট জানায় যে সে সেক্স চেঞ্জ করে শাড়িও পরবে না। গয়নাও পরবে না। শুধুমাত্র, সন্তান অ্যাডপ্ট করার জন্য সে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে চায়।

কেন চায়? কারণ পার্থ সন্তান ভালোবাসে। এখানে এসেই আমরা একটা ভুল করে ফেলি। সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজে সেই ভুল করেছি আগে। পার্থকে ভুল বুঝেছি। তার আগে, এই কথোপকথনের শেষ বাক্য দু'টি আমাদের মনে করে নেওয়া প্রয়োজন। যখন রুদ্র, পার্থকে সেক্স চেঞ্জের কথা বলে, তখন পার্থ একটি প্রশ্ন করেছিল। পার্থ বলেছিল:

পার্থ। আচ্ছা, সব কিছু সরিয়ে যদি ভাবি, ওয়াট অ্যাবাউট ইওর ডান্স?
রুদ্র। ওয়াট অ্যাবাউট মাই ডান্স?
পার্থ। যেখানে তোমার পুরো বডিটা একটা মেইন ইন্সট্রুমেন্ট, সেটাকে ট্যাম্পার করলে…
রুদ্র। শাট আপ, আই ডোন্ট ডান্স উইথ মাই বডি পার্থ, ইট কামস ফ্রম উইদিন!

এই সংলাপটিকে সমগ্র ছবিতে খুবি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। আমরা মনে করে নিতে চাইব, রুদ্র যখন সেক্স চেঞ্জ অপরেশন করাচ্ছে, অর্থাৎ অপরেশনটির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন একদিন পার্থকে নিজের শরীর খুলে দেখায়। পার্থ বলে, ‘(পোশাকটা) পরে ফেল।’ রুদ্র বলে, ‘পার্থ লুক প্রপারলি নাও।’ পার্থর অনড় উত্তর, ‘কভার ইট’। এখানে পৌঁছে পার্থর আচরণকে হীন ও স্বার্থপরময় মনে হয় না আমদের? হয়। এবং সেই মনে হওয়া আরও বাড়তে থাকে ছবিটির পরবর্তী অংশে। একটি দৃশ্যে দু'জনের কথোপকথন এমন:

পার্থ। আর কতগুলো অপরেশন বাকি?
রুদ্র। হ্যাভন’ট কাউন্টেড। দরকার হলে, তুমি ডাক্তারকে নিজে ফোন করো।
পার্থ। ইউ বেটার স্টার্ট কাউন্টিং। আর কতদিন এই নাটকগুলো চলবে?
রুদ্র। কী নাটক? পার্থ আই ডোন্ট থিংক দেয়ার ইজ এনি রিজিন টু বি সো রুড।
পার্থ। অ্যাম নট বিং রুড রুডি। দ্য রুডি আই নিউ ওয়াজ এনারজেটিক, ভাইভেসিয়াস, এক্সসেন্ট্রিক, আ ক্রিয়েটিভ পারসন। আ পারসন আই উড লাভ টু ডিপেন্ড অন।
রুদ্র। নাও আই নিড টু ডিপেন্ড অন ইউ পার্থ।
পার্থ। কাট দিস ক্র্যাব রুডি! ইউ মাস্ট বি জোকিং!
রুদ্র। গিভ মি ফিউ মোর ডে’স, ইটস জাস্ট আ পাসিং ফেজ। আমি ঠিক হয়ে যাব। আচ্ছা ভালো কথা, আমরা কী নিয়ে ঝগড়া করছি বলো তো?
পার্থ। জানি না।
রুদ্র। পার্থ আমি একটা জিনিস জিজ্ঞেস করছি তোমায়, তাহলে এই চেঞ্জেসগুলো কেন করলাম? কার জন্য?
পার্থ। আস্ক ইউ সেলফ রুডি। আই নেভার ওয়ান্ট ইউ টু চেঞ্জ। দ্য ম্যান, আই লাভড ওয়াজ নট দিস হাফ থিং! ইফ আই হ্যাভ টু হ্যাভ আ উমেন, আই উড র‍্যাদার হ্যাভ আ রিয়েল উমেন, নট দিস সিনথেটিক ওয়ান। সরি!
রুদ্র। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ!

এবার আর কোনও দ্বিধা নেই আমাদের যে, এইখানে এসে পার্থর আচরণ আমাদের ভাঙে। আমরা বিরক্ত হই। পার্থ যখন রুদ্রর সেক্স চেঞ্জকে ‘হাফ থিং’ এবং ‘সিনথেটিক’ বলে তাচ্ছিল্য করে, আমাদের কিছু-বা ঘেন্নাও লাগে তখন। কিন্তু আমরা সবটাই বিবেচনা করি রুদ্রর দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে স্মরণ করতে অনুরোধ করব, পার্থ কিন্তু একবারও চায়নি রুদ্র সেক্স চেঞ্জ করাক। বরং পার্থ বলেছিল, ‘ওয়াট অ্যাবাউট ডান্স?’ রুদ্র একজন নৃত্যশিল্পী। শরীর তার মেইন ইন্সটুমেন্ট। সেই শরীরকে হ্যাম্পার করা কি ঠিক হবে? এই ছিল পার্থর প্রশ্ন।

খুবই সংগত প্রশ্ন। রুদ্র যতই বলুক সে নাচে আসলে তার অন্তর দিয়ে। শরীর তুচ্ছ সেখানে। তবুও অপরেশনের পর থেকে তাকে ক্রমাগত নাচের প্র্যাকটিসে আমরা ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হতে দেখেছি। এর মধ্যে দিয়ে, কিছু-বা জেদের ভাব তার মধ্যে ভেসে থাকতেও দেখেছি। এবং ছবির শেষে গিয়ে কিন্তু সে নিজের আর্টকেই বেছে নেয়। বেছে নেয় নাচকে। সেক্স চেঞ্জ করায় না। অর্থাৎ পার্থ যে ভুল ছিল না, তা আমরা বুঝতে পারি।

আরও পড়ুন- ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদা: ফেলে আসা প্রথম প্রেমের অবিচল চরণধ্বনি

আরও একটা কথা এখানে বলার। পার্থ সন্তান ভালবাসে, ঠিক কথা। কিন্তু সে তো রুদ্রর কাছে কখনও সন্তান দাবি করেনি। সে একজন হেটেরসেক্স্যুয়াল মানুষ, রুদ্রর সংস্পর্শে এসে সে নিজের নতুন একটা আইডেন্টিটি খুঁজে পেয়েছিল। সেই নতুন জগতে, কেবল দু'জনের বাস। রুদ্র এবং পার্থর। একথা তো ঠিকই যে সন্তান চাইলে, অন্য নারীর সাহায্যে পার্থ তো নিজেই নিজের সন্তান নিতে পারত। রুদ্রর সঙ্গে সম্পর্কে এটা আর্তি ছিল না কখনও। বরং তাদের প্রান্তিকতাই তাদের মিলিয়ে দিয়েছিল একত্র ভূমিতে। এখানে বোধহয়, সামাজিকতাকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল রুদ্র। আর, রুদ্রর প্রান্তিক অবস্থান ও শিল্পীসত্ত্বাই ছিল পার্থর মূল আশ্রয়বিন্দু, যা শরীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পালটাতে থাকে।

‘চিত্রাঙ্গদা’ একটা ইচ্ছের গল্প, বলেছিলেন ঋতুপর্ণ। হ্যাঁ তাই। কিন্তু ইচ্ছেটা কার? আমার মনে হয় কেবল রুদ্রর। পার্থর সন্তান ভালো লাগে, তাই রুদ্র প্রথমে বলে আমাকে ছেড়ে চলে যাও, বিয়ে করো। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়, বাচ্চা অ্যাডপ্ট করার জন্য নিজের সেক্স চেঞ্জ করাবে। এবং শেষ অব্দি সেক্স চেঞ্জ করায় না। খুব নিবিড়ভাবে দেখলে বুঝতে পারব, এখানে কিন্তু রুদ্রর ইচ্ছের দ্বারাই সম্পূর্ণ গল্পটি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। পার্থর এখানে ভূমিকা অল্পই।

সেই অল্প ভূমিকার মধ্যে সে নিজের ইচ্ছের কথাটি তোলে, বলে বিরক্তির কথাও, তাতে আমাদের খারাপ লাগা উচিত না। কারণ, ইচ্ছে পরিবর্তনশীল। এই চিন্তার অধিকার পার্থ চরিত্রটিরও বোধহয় আছে।

এই ছবিতে এত এত স্তর ঋতুপর্ণ রেখে গিয়েছেন যে তাকে কেবল একপাক্ষিকভাবে বিচার করা, বা দেখা একেবারেই ঠিক কাজ হবে না আমাদের। পার্থ চরিত্রটির ক্ষেত্রে তো তা নয়ই।

More Articles