কেন আজও অস্বীকৃত সমলিঙ্গ বিবাহ? ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে প্রান্তিকদের লড়াই?
Same Sex Marraige in India: অসমবয়সী বিবাহ বলি কি? নিদেনপক্ষে নারী-পুরুষ বিবাহ কথাটি কি কোথাও আলাদা করে উল্লিখিত হয়? তাহলে কেন 'সমকামী বিবাহ' শব্দবন্ধের প্রয়োজন রয়ে গেল আমাদের সমাজে?
প্রথমেই আপত্তি জানাই ‘সমকামী বিবাহ’ শব্দবন্ধটিতে। এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের মানুষদের আলাদা ভাবে দাগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাও কম নয়। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে এ ধরনের বিবাহকে কী তকমা দেওয়া যেতে পারে? এ পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কই আসলে তকমাকেন্দ্রিক। সে তুচ্ছ বা অতিতুচ্ছ হলেও তকমার আওতায় আসতে ভালোবাসে। তকমার বাইরে যে বহির্জগৎ, যে আলোকময় পৃথিবী, তা যেন নিষেধের বেড়াজাল। ‘লোকে কী বলবে’— সেটাই যেন এক ও একমাত্র চিন্তার বিষয়। কেন একটি বিবাহকে শুধুমাত্র ‘বিবাহ’ হিসেবে দেখতে চাইছি না আমরা? অসমবয়সী বিবাহ বলি কি? কিংবা বলি অসবর্ণ বিবাহ? নিদেনপক্ষে নারী-পুরুষ বিবাহ কথাটি কি কোথাও আলাদা করে উল্লিখিত হয়? যদিও হিন্দু-মুসলিম বিবাহ এখনও সমাজচ্যুত হয়নি। তাহলে কেন 'সমকামী বিবাহ' শব্দবন্ধের প্রয়োজন রয়ে গেল আমাদের সমাজে?
আমি একটা বিয়ে করতে চাই– সেখানে কেন বিচার্য হবে আমার সঙ্গীর বর্ণ, লিঙ্গ, জাত? দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক/মনস্ক স্বাধীন মানুষ স্বাধীন দেশে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এতে রাষ্ট্র বা সমাজ কেন নাক গলাবে? সেখানে কতটুকু তাদের অবদান? এখানেই মূল সমস্যাগুলি রয়ে গেছে। যেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। শুধুমাত্র ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ নয়, গোড়ায় গলদ রয়েছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতেও। অবস্থা আরও শোচনীয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মায়ানমার, ইরাক, ইরানের মতো দেশে। অথচ আমাদের আরেক প্রতিবেশী দেশ নেপাল কিন্তু এই বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, এই মুহূর্তে যদি এলজিবিটিকিউ+ মানুষদের বিবাহকে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তবে তা নেপালের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা হবে। লড়াই ভারতেও কম হয়নি। কিন্তু স্বীকৃতি এখনও অধরাই। ভারতের একেক প্রদেশে আনুষ্ঠানিক বিবাহের আচার একেক রকম। ম্যারেজে ইকুয়ালিটিকে মান্যতা দেওয়াই প্রথম শর্ত। ছেলে-মেয়ে বিবাহের বাইরে ছেলে-ছেলে এবং মেয়ে-মেয়ে বিয়ে করলে আটকায় কোন জায়গায়? বিয়ের প্রাথমিক শর্ত শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের মধ্যে সীমিত থাকতে পারে না। বিয়ের হাজার একটা বৈচিত্র্য রয়েছে। দু'টি মানুষ কাকে বিয়ে করবেন বা কার সঙ্গে এক ঘরে থাকবেন, তা বিচার করার অধিকার শুধুমাত্র ওই মানুষ দু'টিরই রয়েছে, রাষ্ট্রের ভূমিকা সেখানে আগ বাড়িয়ে নাক গলানো ছাড়া আর কিছুই না।
আরও পড়ুন: পরিবার-সমাজ উপেক্ষা করে বিয়ে, যে উদাহরণ তৈরি করল কলকাতার এই সমপ্রেমী যুগল
অনেকেই মনে করেন বিবাহ নামক প্রথা সামাজিক অনুষ্ঠানের মোড়কে পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা বই কিছু নয়। কথাটি আংশিক ভাবে সত্য। যৌতুক, সিঁদুর দান, কন্যাদানের মতো বিবাহের নানান রীতির মধ্যে পুরুষতান্ত্রিকতা ও একপেশে চিন্তাভাবনা রয়েছে। তবুও বিবাহ উদযাপিত হয়। আর যাই হোক না কেন, এটা মনে করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, বিয়ে নিছক সন্তান উৎপাদন করার মূল কারণ। এ কথা উনিশ শতকের জন্য প্রযোজ্য হলেও আজকের একবিংশ শতকের পৃথিবী বহু ঘাত-প্রতিঘাতে আধুনিক হয়েছে। ধীরে ধীরে পুরুষতন্ত্রের খোলস থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছে। আইন হয়েছে নারীকেন্দ্রিক। কিন্তু সমপ্রেমীদের জন্য সামাজিক পরিকাঠামো বা আইন আজ কোন পথে? এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।
সমপ্রেমী সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিলেও সমলিঙ্গের বিবাহের স্বীকৃতি দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। তবে এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষিত করার বিষয়টিতে বিচারপতিরা সকলেই একমত হয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, ব্যক্তিবিশেষের কোনও সম্পর্কে প্রবেশের অধিকার তাঁর যৌন চাহিদা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। কেন্দ্রকে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে সমলিঙ্গে বিবাহের বিষয়ে অগ্রসর হতে বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সমলিঙ্গ যুগলের রেশন কার্ড, পেনশন, উত্তরাধিকার সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ওই কমিটির মাধ্যমে। ২০২৩ সালের ৩ মে সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছিল, সমলিঙ্গ যুগলেরা প্রশাসনিক যে সব সমস্যার মুখোমুখি হন, সেগুলি সমাধানের জন্য মন্ত্রীপরিষদের একজন সচিবের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গড়ার ভাবনা রয়েছে তাঁদের। প্রশ্ন, সেই কমিটি কি গঠন করা হয়েছে? হলেও কী কী কাজ করতে অগ্রসর হয়েছে তারা? সেখানে কি এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিনিধি আছেন? সামাজিক মাধ্যমে বা সংবাদ মাধ্যমে কেন এ সংক্রান্ত কোনও খবর উঠে আসেনি?
সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ জন বিচারপতি সেদিন একটি বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেছিলেন। সমলিঙ্গ যুগল সন্তান দত্তক নিতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে তাঁরা সকলে একমত হতে পারেননি। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কউল সমলিঙ্গ যুগলের সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভট্ট, বিচারপতি হিমা কোহলি এবং বিচারপতি এস নরসিংহ এ বিষয়ে সম্মতি জানাননি।
সমকামী কিংবা এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের যে কোনও মানুষকেই হেনস্থা বন্ধ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। বলা হয়েছিল, এই সম্প্রদায়ের কাউকে তাঁদের যৌন পরিচয় জানার জন্য থানায় তলব করা যাবে না। তাঁরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলে তাঁদের সেখানে জোর করে ফেরানো যাবে না। এই সম্প্রদায়ের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করার আগে পুলিশকে প্রাথমিক ভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। বলা হয়, জীবনসঙ্গী নির্বাচন করা প্রত্যেকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সম্পর্ককে স্বীকৃতি না দেওয়ার অর্থ এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়কে অসম্মান করা। প্রশ্নোত্তরে ঘুরপাক খেতে থাকে, সমকাম কি শহুরে বা নাগরিক জীবনের বিষয়? যা আদতে অপ্রাসঙ্গিক। সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে আইনি পরিকাঠামো গঠনের বিষয়টি আইনসভাকেও দেখতে বলা হয়। এই বিবাহে আইনি স্বীকৃতি দিতে হলে বিশেষ বিবাহ আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। যা বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভব নয়। তাই আইনসভাকেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ করতে হবে বলে জানানো হয়।
সমগ্র রায় ঘোষণায় কিঞ্চিৎ আশার আলো থাকলেও প্রদীপের তলায় নিকষ অন্ধকার। ভারতে সমলিঙ্গে বিবাহ সামাজিক ও আইনিভাবে অস্বীকৃত। নানান মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, যেখানে বিবাহ পুরুষতন্ত্রের বহু কাঠামো দিয়ে তৈরি এবং এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের মানুষ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাহলে বিবাহে এত আস্থা বা জোর দেওয়া হচ্ছে কেন! লেখার একদম শুরুতে যে কয়েকটি কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান বিষয় ছিল যে কোনও বিবাহকে ‘বিবাহ’ হিসেবে মান্যতা দেওয়া। কার্যত এ কথা বললে ভুল হয় না, যে পৃথিবীতে যে কোনও জিনিস বর্জনের জন্য তা আগে অর্জন করতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমশ এলজিবিটিকিউ+ মানুষদের বঞ্চিত করেছে। এক্ষেত্রে বিবাহ আন্দোলন আরও জোরদার হওয়া উচিত, বুঝিয়ে দেওয়া উচিত স্বাধীন দেশে যে কোনও মানুষেরই সমস্ত কিছুতে অধিকার আছে।
এ প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বলা জরুরি। কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়ে বলেছিল, আইন তৈরির কাজ পার্লামেন্টের, বিচারালয়ের না। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সমকামিতাকে ‘এলিট’ তকমা দিয়েছিল বহু আগেই। শুধু বিজেপি সরকার কেন, একসময় গোঁড়া বাম আইকনরাও তাই মনে করতেন। মনে করতেন সমকামিতা একধরনের অসুস্থতা। ‘আমেরিকার ষড়যন্ত্র’ বলেও দাগিয়ে দিয়েছিলেন কেউ কেউ। সমপ্রেমী মানুষেরা বিয়ের অধিকার চাইছেন স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা মানা হল না। কারণ সেখানে লেখা ‘ম্যান ও উওম্যান’। সমকামিতায় কে নারী আর কে পুরুষ তা অবধারিত বা জরুরি কোনওটাই নয়। বিষমকামী নারীর মধ্যে যেমন থাকতে পারে সুপ্ত পুরুষত্ব, তেমন বিষমকামী পুরুষও ধারণ করতে পারেন নারীর কোমলতা। এখান থেকেই তৈরি হয় জেন্ডার ফ্লুইডিটি।
আদালতে একসময় উপরমহল থেকে প্রশ্ন উঠেছিল এ দেশে কত শতাংশ মানুষ সমকামী? কাদের জন্যই বা এই বিচারবিভাগীয় আয়োজন? তাদের কি আদৌ দেখা যায়? তখন প্রখ্যাত আইনজীবী মেনকা গুরুস্বামী ভরা আদালতে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেছিলেন, “দেখা যায় না কারণ তাঁরা আত্মপ্রকাশ করতে ভয় পান। কিন্তু চাইলেই তাঁদের দেখা যেতে পারে। এই আমি সমকামী। আমি আর আইনজীবী অরুন্ধতী কাটজু একে অপরকে ভালোবাসি। আপনাদের চেনা গণ্ডির মধ্যেই ছিলাম, অথচ আপনারা জানতেন না। কারণ আপনারা আমাদের দেখতে চান না।” — এই হচ্ছে একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের বক্তব্য। মনে রাখতে হবে, আগে তিনি সর্বাগ্রে এ দেশের নাগরিক, পরে আইনজীবী। মেনকা নানা সময় গুরুত্বপূর্ণ সব মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছিলেন, “সমতার আদর্শ-টাদর্শ এগুলো সব তাত্ত্বিক কথা।” এমন নয় যে সমকামীরা কেবল তাত্ত্বিক কারণে বিয়ে করতে চান। মেনকা বলছেন, “আমি বিয়ে করতে চাই, কারণ বৈবাহিক বা রক্তের সম্পর্ক ছাড়া আমরা যৌথভাবে মেডিকেল ইনশিওরেন্স করতে পারছি না। আমি আমার সঙ্গীকে আমার লাইফ ইনশিওরেন্সের নমিনি করতে পারছি না। শুধু একসঙ্গে থাকার কারণে সেটা করতে দেওয়া হয় না এ দেশে।” তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? বিবাহ মানে এক ও কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদন নয়। বিবাহের আরেক অর্থ পারস্পরিক ভরসা ও পরস্পরের উত্তরাধিকারী। সমলিঙ্গ বিবাহে আইনি মান্যতা না দিলে এই অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হবে।
ইন্টারনেটে সমকামিতা বিষয়ে আগ্রহের শেষ নেই। গুগলে বাংলায় ‘সমকামিতা’ লিখে অনুসন্ধান করলে কয়েকটি সূচক শব্দ পাওয়া যায় — পুরুষ পুরুষ মিলন করলে কী হয়, নারী নারী মিলন করলে কী হয়, গে মানে কী, টপ বটম মানে কী, গে মডেল, পুংমৈথুন ইত্যাদি। আমার কাছে মানুষের এই অনুসন্ধানগুলি মোটেই হাস্যকর নয়, বরং যত বেশি মানুষের খোঁজ থাকবে, ততই ফোবিয়ামুক্ত হবে সমাজ। খাজুরাহোর মতো এ দেশের বেশ কিছু মধ্যযুগীয় মন্দির স্থাপত্যের দেওয়ালে খোদাই চিত্রের মধ্যে গে এবং লেসবিয়ান উভয় সম্পর্কই প্রকাশ্যে আসে। এই চিত্রগুলি থেকে অনুমান করা যায়, অতীতে ভিন্ন যৌনতার বিষয়ে সমাজের কিছু অংশ এর আগে অপেক্ষাকৃত উন্নত ও উন্মুক্ত ছিল। যাদের মধ্যে প্রাচীনকালেও জেন্ডার ফ্লুইডিটি ছিল।
এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় ৩৪টি দেশে বৈধ সমলিঙ্গে বিবাহ। এ বিষয়ে পথ দেখিয়েছিল নেদারল্যান্ড। ইউরোপের এই দেশে ২০০১ সালে স্বীকৃতি পায় ‘সমকামী বিবাহ আইন’। তারপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমকামী অধিকার রক্ষায় বিবাহ স্বীকৃতির দাবি ওঠে। কোথাও জনতার আন্দোলনের চাপে আইন আনতে বাধ্য হয় সংশ্লিষ্ট দেশের প্রশাসন, কোথাও আবার জনতার ভোটাভুটির মাধ্যমে সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও আদালতের নির্দেশের পর সমলিঙ্গ বিবাহে সিলমোহর দিতে বাধ্য হয়েছে সে দেশের প্রশাসন। অ্যান্ডোরা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলোম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, ডেনমার্ক, ইকুয়েডর, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, মালটা, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তাইওয়ান, ব্রিটেন, আমেরিকা এবং উরুগুয়ে। বর্তমানে সমলিঙ্গে বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠেছে ভারত, জাপান, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিলিপিন্স, তাইল্যান্ডের মতো দেশগুলিতে।
হিন্দুত্ববাদী দলগুলির কথা ছেড়েই দিলাম। আপনারা ইতিমধ্যে অনেকেই জানেন যে, ফ্রান্সের নতুন প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আটাল শুধুমাত্র যে একজন সমকামী, তাই নয়। একইসঙ্গে নাস্তিকও। মাত্র ৩৪ বছর বয়সী এই যুবক নিয়ন্ত্রণ করছেন পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছর দশেক আগে একটা সমীক্ষায় ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কী ধরনের রাষ্ট্রপতি সবচেয়ে বেশি অনাকাঙ্ক্ষিত? সেখানে দেখা গিয়েছিল মানুষের সবচেয়ে অপছন্দ হল নাস্তিক, তারপরে সমকামী। তবে আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে তফাৎ আছে। গ্যাব্রিয়েল সম্বন্ধে জানা যায়, পিতৃসূত্রে তিনি মাগরিবী ইহুদি, তাঁর মা অর্থোডক্স ক্রিশ্চান। এই দুই সম্প্রদায়ই ফ্রান্সে সংখ্যালঘু। গ্যাব্রিয়েল নির্দিষ্ট কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নন। সমকামিতা, জাতি পরিচয়, ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস — সব দিক থেকেই গ্যাব্রিয়েল সংখ্যালঘু। শুধুমাত্র ফ্রান্স নয়, পৃথিবীর সমস্ত দেশের প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু যুবসমাজকে আশার আলো দেখান তিনি। ভবিষ্যতে তাঁর পন্থা কী হবে, কীভাবে তিনি নিজের দেশ-শহরকে দেখতে চাইবেন তা সময় বলবে। তবে এই মুহূর্তে অনেকেই অন্তত তাঁর কাছে সেই আশা খুঁজে পান।
আরও পড়ুন: সমপ্রেমে সমস্যা নেই, সমকামের বিয়েতে কেন ‘না’ সুপ্রিম আদালতের?
ভারতের মতো দেশে জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে কেউই প্রায় মুখ খোলেন না। তার কারণ কি সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয়? কোনও রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টোতে এলজিবিটিকিউ+ মানুষদের কথা লেখা থাকে না। কোনও নির্বাচনেই এলজিবিটিকিউ+ প্রতিনিধিদের টিকিট দেওয়া তো দূরের, প্রচারেও রাখা হয় না। রাজনৈতিক দলগুলিতে যে সমস্ত সমপ্রেমী মানুষ লুক্কায়িত আছেন, ভয়ে মুখ খোলেন না। অর্থাৎ বলাই বাহুল্য নিজেদের অধিকার নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে। লড়াই যত কঠিন হবে, ভিত ততই পোক্ত হবে। মেনকা, অরুন্ধতীর মতো আইনজীবীরা এই অধিকার আন্দোলনের স্তম্ভ। তাঁদের প্রতি বিশ্বাস হারালে চলবে না। ঊর্মিলা শ্রীবাস্তব-লীলা নামদেও কিংবা অভিষেক রায়-চেতন শর্মারা এই সমাজকে পথ দেখাবেন। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক বিবাহ নয়, আইনের সম্মতিতেও বিবাহ — এ দিন দেখার জন্য পথ হাঁটতে হবে আরও। স্যাফো লিখেছিলেন, “What cannot be said will be wept.” না বলতে দেওয়া কথাগুলো কান্না হয়ে যত ঝরবে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ততখানি জারি থাকবে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই। শেষের সে দিন আসন্ন।