স্মৃতি আসলে কার? ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এ যে উত্তর খুঁজেছেন ঋতুপর্ণ

Rituparno Ghosh: ঋতুপর্ণ ঘোষ যখন ছবিটির স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন, তখন ছবিটির নাম ছিল ‘পারাপার’।

‘Who does memory belong to?’ এই এক প্রশ্ন নিয়ে ২০১১ সালে উপস্থিত হয় ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’, ঋতুপর্ণ ঘোষ অভিনীত দ্বিতীয় ছবি। এখানে যদিও একটি তথ্যের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ছবি রিলিজের নিরিখে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-র পরের ছবি ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’। ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার ও তাঁর নিজের লেখা একটি সম্পাদকীয় থেকেও এই কথা মনে হয় যে ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ ছবিটিই অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষের দ্বিতীয় অভিনয়-পর্ব।

তাহলে সমস্যাটা কী? পরিচালক অনুরাগ বসুর সঙ্গে একটি কথোপকথনে ঋতুপর্ণ স্পষ্টত বলছেন যে, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-র আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এর অভিনয় পর্ব। এখন, যেহেতু ছবি দু'টির রিলিজের সময়-পরিধি কাছাকাছি, তাই আমাদের মন এই তথ্যের দিকেও সাড়া দিতে চায়। ফলে প্রশ্ন জাগে, অভিনয়পর্ব অর্থে কী বলতে চাইছিলেন ঋতুপর্ণ? শুটিং নাকি শুটিংয়ের ওয়ার্কশপ? আর তাই যদি হয়, তাহলে কিন্তু হিসেবটিকে খানিকটা সরিয়ে এনে এই ক্রমেও হয়তো ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনয় জীবনকে দেখা যায়- ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ তারপর ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’।

আরও পড়ুন- নিষিদ্ধ জন্মের অভিজ্ঞতাভূমিতে মিশে যান ঋতুপর্ণ ও চপল ভাদুড়ী

‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-তে ঋতুপর্ণ অভিনয় করেছিলেন একইসঙ্গে দু'টি চরিত্রে। চপল ভাদুড়ীর যৌবন বয়স এবং অভিরূপ। এই দুই ভিন্ন সময়ের পৃথক চরিত্রের মধ্যে যেমন ভিন্ন যৌনচেতনার সমতা রয়েছে, তেমনই দু'টি চরিত্রের মধ্যে ভাবনা ও আচরণের বৈপরীত্য সহজেই জাগিয়ে তুলেছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনেতা-মন। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এ ঋতুপর্ণ অভিনীত চরিত্রটির নাম অর্ণব। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-র থেকে এক ভিন্ন ভূমিতে দাঁড়িয়ে কীভাবে ভেবেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এর কথা? একটি ইংরেজি সাক্ষাৎকারে তারই চিহ্নসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়:

It was while working on ‘Arekti Premer Golpo’ that I thought of exploring the subject of the film further. After an overdose of cross-dressing in ‘Arekti Premer Golpo’, I wanted to focus on the closeted gay person, who is non-flamboyant, quiet, and unassuming. ‘Arekti Premer Golpo’ started off on the assumption that Roop (Rituparno Ghosh) and Basu (Indraneil Sengupta) were a couple. So a surrogate femininity had already been established. In both my roles in ‘Arekti Premer Golpo’, as Roop and as Chapal (Bhaduri), it was a performance of femininity. There was a time when people who were effeminate were not considered gay, but now the two words are synonymous. People who have come out of the closet and unabashedly flaunt their sexuality deal with a certain set of problems. But people who have not been able to come out of the closet do have some behavioral signs that give it away. I thought of dwelling on this issue and started writing the script of ‘Parapaar’… I had thought of it in Bengali back then.

হ্যাঁ, ঋতুপর্ণ ঘোষ যখন ছবিটির স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন, তখন ছবিটির নাম ছিল ‘পারাপার’। তখন বাংলায় ছবিটি হওয়ার কথা ছিল। পরে, ইংরেজিতে হওয়ার সময় ছবিটির নাম হয় ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’। এই সাক্ষাৎকারেরই পরবর্তী অংশে দেখতে পাওয়া যায় ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-র রূপ (অভিরূপ) চরিত্রটি থেকে ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এর অর্ণব-কে কোন উপায়ে ভিন্নতা দান করবার চেষ্টা করেছিলেন ঋতুপর্ণ, সেই প্রসঙ্গটি:

Well, Arnab had to be different from Roop and both Bunty (Sanjay Nag, director) and I were cautious that Arnab didn’t become either Roop or Chapal. Arnab is very quiet and unassuming. Bunty wanted me to look the way I did when I was in advertising. A head of curly hair... my costume was very regular clothes, nothing fashionable, and the moment I slipped on those clothes I knew what kind of acting was required of me.

এবার, ঠিক এখান থেকেই প্রবেশ করতে চাইব এই ছবিতে ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনয়ের বিশেষত্বের দিকে। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ ছবিটিকে আসলে দু-ভাবে দেখা যায়। কেন? যাঁরা ছবিটি দেখেছেন তাঁদের স্মরণ করতে অনুরোধ করব, প্রথম থেকেই ছবিতে মৃত ছেলের শোকে মুহ্যমান থাকতে দেখেছি আমরা আরতি চরিত্রটিকে। অপরদিকে, অর্ণব চরিত্রটির সঙ্গে যখন দর্শকের দেখা হয়, তার মধ্যে শোকের থেকেও ক্লান্তি বেশি। সে বেশ কিছুটা ভদ্রতার মান্য উপায়ে ব্যবহার করে চলেছে আরতির সঙ্গে।

এখানে কয়েকটি কথা বিশেষভাবে বলতে চাইব। অনেক ক্ষেত্রেই এমন হয়, সিনেমায় কোনও একটি চরিত্রকে নির্ভর করে, সেই নির্দিষ্ট চরিত্রের চারপাশের ঘটনা ও ব্যবহারের নিরিখে তার অনুভূতির প্রতিক্রিয়াকে আমরা ছবিটি দেখতে দেখতে নিজেদের অনুভূতির সঙ্গে মিশিয়ে নিই। ভাবি, তার দেখা জগৎ-অভিজ্ঞতাই প্রকৃত সত্য। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এর ক্ষেত্রেও তেমনই হয়তো ঘটেছে। ছবিটি অনেকক্ষণ নিজেকে ব্যক্ত করে চলে আরতির দৃষ্টিকোণ থেকে।

আরও পড়ুন- ঋতুপর্ণের ‘আবহমান’: শিল্পীর মুহূর্ত, শিল্পের সত্য

চলচ্চিত্র পণ্ডিত চিদানন্দ দাশগুপ্ত তাঁর বিভিন্ন ভাবনায় এ-কথা বারংবার লিখেছেন যে, একটি ছবিকে বুঝতে গেলে ফিরে ফিরে তাকে দেখতে হয়। কারণ, সিনেমা অনেকটা মানুষেরই মতো। তার সঙ্গে যত মেশা যায়, তত তার চরিত্রধর্মের নানান সংকেত উন্মোচিত হতে থাকে। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ সম্পূর্ণ একবার দেখার পর, আরও একবার ফিরে দেখলে আলাদাভাবে বোঝা যায় অর্ণব চরিত্রটিকে।

এই সিনেমার মৃত চরিত্র ‘সিড’, যে কিনা আরতি-র সন্তান এবং অর্ণবের প্রেমিক, তার মৃত্যু অর্ণব কাছ থেকে দেখেছে। সব সময় সঙ্গে থেকেছে। তাই, আরতির মতো, অর্ণবের মধ্যে আচমকা বিচ্ছেদের উচ্চস্বর অনুপস্থিত। ঋতুপর্ণ ঘোষ, অর্ণব চরিত্রটিকে এক শান্ত, রুচিশীল ভদ্রতার পোশাকে খুব সুন্দরভাবে মুড়িয়ে রেখেছিলেন। অর্ণবের এই আচরণের সঙ্গে তাই কোনওভাবেই আমরা মিল খুঁজে পাই না ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এর চপল ও অভিরূপ চরিত্র দু'টির। 

‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এ অভিরূপ ছিল প্রায় সব সময় প্রখরভাবে তেজস্বী, প্রতিবাদী। অথচ, অর্ণব চরিত্রটির অভ্যন্তরীণ তেজকে ঋতুপর্ণ একবারই প্রকাশ্যে এনেছিলেন। মনে করতে অনুরোধ করব, সিড-এর অফিসের জিনিসপত্রগুলি তার অফিসের কাছ থেকে মা হিসেবে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আরতি। অর্ণব বলেছিল, তাঁকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিতে, সে নিজে দিয়ে যাবে। অর্ণব যখন সিড-এর জিনিসগুলি দিতে এসেছে, তার আগেই আরতি জেনে গেছে সিড-এর বিকল্প যৌনতার কথা। জেনেছে, সিড ও অর্ণবের প্রেম সম্পর্কের বিষয়েও। এখানে তাদের কথোপকথনের অংশটি তুলে দিলাম:

Arnab : I have packed up all this stuff in here, you can keep the one you chose.
Deepti : No, I don’t need it, you can keep it. আচ্ছা, there were so many others, why did you have to pic on my son? Seduce him?
Arnab : Seduce him? Who told you?
Arti : don’t pretend. I know about it and don’t ask me how!
Arnab : So, you think I seduced your son?
Arti : yeah, but just tell me why? He was no hunk, no muscle builder!
Arnab : What if it was the other way around?
Arti : Meaning?
Arnab : The opposite of which you are saying.
Arti : What! Do you mean he seduced you?
Arnab : yeah!
Arti : For what?
Arnab : For the raise, for the desk beside the window, for this apartment, for the car…
Arti : And you fell for it?
Arnab : Now make up your mind Arti, what is more unacceptable - the act of seduction or the relationship per se.

এই সংলাপ-মুহূর্তে একইসঙ্গে দেখা যায় অর্ণবের ভাঙন এবং তীব্রতা। ঋতুপর্ণ খুব নিপুণ দক্ষতায় এখানে নিজের অভিনয়কে আগের ছবির আবেগ ও ভেঙে-পড়ার মুহূর্তগুলির থেকে আলাদা করেছেন। শুধু তাই নয়, এই সংলাপের পরবর্তী অংশে নিজের তীব্রতাকে বেদনার জ্যোৎস্নায় ঋতুপর্ণ ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। আরতির ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট একটি ছবি, যা অর্ণবের অফিসের ডেস্কে ছিল, আরতি সেই ছবিটি নিয়ে যেতে যায়। অর্ণব তাতে বাধা দেয়। সেই সংলাপ-মুহূর্তটি এখানে তুলে দিচ্ছি।

Arti : I will keep this.
Arnab : No, this is mine.
Arti : I don’t understand that.
Arnab : This is mine. I am not giving it back to you. I know Sid’s mother through this picture. Sid’s mother who is ever smiling, ever happy, always positive. She used to look lot like you but she is not you.

এই সংলাপটি থেকে অর্ণব চরিত্রটির মনের সংগঠনকে যেমন বুঝতে পারি আমরা, তেমনই তার নীরব কান্নাও শুনতে পাই।
এখানে একটি বিষয় বলতে চাই। এতক্ষণ কথা বলছি, ঋতুপর্ণের অভিনয়ের অন্তর্গত সূক্ষ্মতা বিষয়ে। কিন্তু এর বাইরেও, চরিত্রের বহিরঙ্গ ‘তৈয়ারি’ সম্পর্কে যে-কোনও অভিনেতারই নানা চিন্তামন কাজ করে। এই যে সংলাপটি এক্ষুনি উদ্ধৃত করলাম, খাওয়ার টেবিলের সেই দৃশ্যটি বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ বলেছিলেন:

প্রশ্ন। Earlier you had said that your directorial eye is always present when you are acting...

উত্তর। The Telegraph 23th march 2011 Here it came in only one scene. There was a shot involving me and Deepti in the boy’s house where I am fetching food from the kitchen, laying the table and then serving it. Directorially, I knew that was the only place where I had to prove [to the mother and also the audience] that I was more familiar with her son’s house than she.

এই সাক্ষাৎকার আমাদের জানিয়ে দেয় কত নিবিড়ভাবে ঋতুপর্ণ নিজের অভিনীত চরিত্রগুলি সম্পর্কে ভাবতেন। এবং চিত্রনাট্যের কাহিনি ও সংকেতকে অভিনয়ের মধ্যে এনে দর্শকের সামনে খুলে দিতেন এক নতুন আকাশ!

More Articles