সংকেতে গড়া জাদু-মুহূর্ত! আদিত্য বিক্রমের মায়ানগর যে মুগ্ধতার ছবি আঁকে

Mayanagar Review: স্প্রে-তে সাদা এক কুয়াশার মতো আবহাওয়া তৈরি হয়। এই সাদা কুয়াশার মধ্যে দু'টি ক্রিয়া ঘটমান। এক, কুকুরদের মেটিং। দুই, এলার বসের কাছে যাওয়া।

জীবনের মধ্যে এমন কিছু আশ্চর্য মুহূর্ত থাকে, যা সারাজীবন মাথার ভেতরে বারংবার জেগে উঠতে চায়। জেগে ওঠেও। যে ব্যক্তির দ্বারা আমরা সেই জাদু-মুহূর্তকে একদিন দেখতে পেয়েছিলাম, সেই ব্যক্তির চেয়েও বেশি সেইসব মুহূর্তদের সঙ্গে বোধহয় ক্রমেই নিভৃতে একটা সম্পর্ক আমাদের মধ্যে জন্ম নেয়। শিল্পও এমনই। ‘মায়ানগর’ দেখার পর থেকে মাথার ভেতরে খণ্ড খণ্ডভাবে ফিরে আসছে ছবিটির বহু দৃশ্য। তার মধ্যে থেকে কয়েকটি আলো-অন্ধকারময় মুহূর্তের কথা বলতে চাই।

ছবির প্রথমদিকের একটি দৃশ্য। বন্ধ, পুরনো থিয়েটার। ভাঙা স্টেজ। ফাঁকা সিট। এইসবের মধ্যে দিয়ে বাড়ির দীর্ঘদিনের পরিচারকের ছেলে রাজা সারাদিনের কাজ সেরে, ফিরে আসছে। সাইকেলটা হাঁটিয়ে নিয়ে বাড়িতে ঢুকছে রাজা। সাইকেলের চাকাটা ঘুরছে। আস্তে-আস্তে ঘুরছে। দৃশ্যটিতে, যেই উপস্থিত হলো বৃদ্ধ পরিচারক রাজার বাবা, আমরা দেখলাম সাইকেলের চাকাটি দাঁড়াল কিন্তু চাকার কেন্দ্র-অংশ ঢেকে রইল, বৃদ্ধ পরিচারকের মুখশ্রী।

সিনেমা হলে দেখামাত্র এই দৃশ্যভাবনাকে খুব বাহবা দিতে ইচ্ছে করেছিল। তখন হয়তো সেই ভাবনার পেছনে কার্যকর হয়েছিল টেকনিক আর স্মার্টনেসের প্রতি আমার সমর্পণবোধ। কিন্তু এখন মনে হয়, ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা হয়তো মনে করতে পারবেন, রাজার বাবা, ওই বৃদ্ধ পরিচারক ওই বাড়ি ও থিয়েটারের স্বর্ণযুগ দেখেছেন। আর আজও, বাড়িটির ভগ্ন-অবস্থা এবং সেই বাড়ির সন্তান বুবুকে আগলে বেঁচে আছেন। পুরনো বাড়িটির ওপর দিয়ে চলে যাওয়া সময়ের প্রবাহকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই হয়তো, ছবিতে বৃদ্ধ চরিত্রটির সঙ্গে পরিচালক আমাদের আলাপ করিয়ে দিলেন সময়ের এক ঘূর্ণনময় চাকার মধ্যবিন্দু দিয়েই। এই প্রয়োগ অতুলনীয়!

আরও পড়ুন-মানিকবাবুর মেঘ আসলে অন্য রকম যৌনতার কথা বলে

মুগ্ধতার এখানে সবে শুরু। এই দৃশ্যের সংলগ্ন আরও দু'টি দৃশ্যের কথা বলব। ‘মায়ানগর’-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র এলা (অভিনয় করেছেন শ্রীলেখা মিত্র), একমাত্র সন্তান মারা যাওয়ার পর স্বামীগৃহ ছেড়ে নিজের মতো করে থাকতে চায়। কিন্তু তার কাছে ফ্ল্যাট কেনবার জন্য যথেষ্ট টাকা নেই। এলার মা ছিলেন একজন থিয়েটার অভিনেত্রী, এলার বাবা বিবাহিত অবস্থায় এলার মায়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ফলে, বুবু আর এলা একই পিতার সন্তান। শুধু তাদের মাতৃ-পরিচয় আলাদা।

এলার জন্য রাজা চাকরি পেয়েছে। ফলে, রাজা ওর প্রতি কৃতজ্ঞ। যখন ফ্ল্যাটের জন্য টাকার জোগাড়ের অন্য সব রাস্তা বন্ধ, এলা বাবার পুরনো বাড়িটা বিক্রির জন্য রাজাকে বুবুর কাছে কথা বলতে পাঠায়। দু'জনের সংলাপ-মুহূর্তটি এখানে বুবু চরিত্রে ব্রাত্য বসুর অভিনয়ের কারণে এক অনবদ্য প্রাচুর্যকে স্পর্শ করে আছে। বাবার সঙ্গে অন্য নারীর সম্পর্কের কথা জানতে পেরে আত্মহত্যা করে বুবুর মা। তারপর থেকেই কিছুটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে বুবু। সেই ভারসাম্যহীনতার মধ্যে ছিল এক ধরনের শিশুসুলভ নির্ভরতার আচরণ। বুবু যখন রাজার সঙ্গে কথা বলতে বসে, তখন তার দু'হাত পর্যন্ত নেমে আসা ওভারসাইজ পোশাক, সেই শিশুসুলভতাকে যেন প্রশ্রয় দেয়। এখানে ব্রাত্য বসু তাঁর সম্পূর্ণ শরীরকে একক বৃক্ষের মতো স্থির রেখে, আকাশময় ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর অভিনয়ভাষা, কেবল তাঁর দুটো চোখ দিয়েই। তিনি পুরো সংলাপটি বলেছেন, চোখের সাহায্যে।

এখানে, আরও একটি বিষয় মুগ্ধ হওয়ার মতো। ছবিটা যখন দেখছি, তখন তো আমরা বুবু চরিত্রটির মানসিক-ইতিহাস জানি না। ব্রাত্য বসুর অভিনয়ের আপাত কয়েক সেকেন্ড, বুবু চরিত্রটিকে তাঁকে বেশ গম্ভীর ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মনে হয়। রাজা বলছে, প্রোমোটাররা এই বাড়িটি কিনতে চাইছে, বুবুদা তুমি বিক্রি করবে কিনা। বুবু জিজ্ঞেস করছে, ওরা তোমাকে কেন বলছে? এই সংলাপে ব্রাত্য সেই দৃঢ় ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখছেন। রাজাকে তাই আমরা এখানে কিছুটা যেন ভীত-ইতস্তত দেখতে পাই।

তারপর, ব্রাত্য বলেন, ‘বিক্রি করে দেব, বিক্রি করে দেব’। ঠিক এই পর্যন্ত, ব্রাত্য ধরে রাখেন সেই গম্ভীর ব্যক্তিত্বকে, যেন একটি জলধারা। যা এরপর হঠাৎই একটা ঢালুপথে, সম্পূর্ণ নতুন এক পরিচয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে নীচে, ঝরনা হয়ে। বুবু জিজ্ঞেস করে, তাদের থিয়েটার হলের ভেঙে যাওয়া স্টেজটা প্রোমোটাররা কি সারিয়ে দিতে পারবেন? সামান্য সময়ের মধ্যে, এই প্রশ্ন-উচ্চারণে ব্রাত্য বসু যে অভিনয়প্রাচুর্যকে প্রতিস্থাপন করেছেন, তা চরিত্রটির পূর্ব ব্যক্তিত্বকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে বাধ্য করে আমাদের। আমরা জানি প্রোমোটাররা বাড়িটি কিনতে চাইছে, ভেঙে ফেলে ফ্ল্যাট বানাবে বলে, তারা কী করে স্টেজ সারিয়ে দেবে? এই বিচারশক্তি বুবু চরিত্রটির মধ্যে নেই। কিন্তু সেই না-থাকাকে কোনও উচ্চস্বরের অভিনয়ের বদলে এক অপূর্ব সংযত ও সংহত উপায়ে চরিত্রটির মধ্যে বহন করেছেন ব্রাত্য।

শুধু তাই নয়, ছবিতে, উকিলের নির্দেশে বৃদ্ধ পরিচারককে বুবুর বলা, ‘তোমরা চলে যাও, তোমরা ভালো লোক নও’ এই সংলাপ অথবা পারিবারিক উকিলের সঙ্গে কথা বলার সময় বুব-র ঘেমে যাওয়া উদ্বিগ্ন আশ্রয়-উন্মুখ আচরণ— সবই বুবু চরিত্রটির স্থায়িত্বভারকে ছবিটিতে জোরালো করেছে।

‘চালচিত্র’-র ভুবন হালদার, ‘মানিক বাবুর মেঘ’-এর ডক্টর সাধন কিংবা ‘ঝরা পালক’-র জীবনানন্দ দাশের চরিত্রে ব্রাত্য বসু যে ভিন্ন-ভিন্ন অভিনয়ের চিহ্ন আমাদের সামনে রেখেছেন, বুবু চরিত্রটি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বহু কারণে, ‘মায়ানগর’ একবার নয়, বারবার ফিরে দেখার ছবি। তবে আমি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে, সিনেমাটি ফিরে দেখার সেই বহু কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো, এই ছবিতে ব্রাত্য বসুর অভিনয়ের নিস্তব্ধ সংকেতগুলি, যার কোনও তুলনা নেই।

প্রসঙ্গে ফিরি। বুবু চরিত্রটির সঙ্গে রাজার কথোপকথনের পর দেখা যায়, রাজা সেই কথোপকথন বিষয়ে এলাকে ফোনে জানাচ্ছে। এই দৃশ্যটি সাধারণ। অথচ এই দৃশ্যটি কী মারাত্বক! কেন? রাজা যখন এলাকে ফোনে বলছে বুবুর সঙ্গে ওর কথাবার্তার সারমর্ম, তখন নীচ থেকে পরিচালক রাজার ঝুলন্ত পা দুটোকে এমনভাবে দেখান, যেন কেউ আত্মহত্যা করে ঝুলে আছে। রাজার শব্দগুলির সঙ্গে দৃশ্যটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য সংঘর্ষ তৈরি করে, আমাদের সামনে থেকে চলে যায়। মনে হতে থাকে, আচমকা এমন এক ঝুলে থাকা দেহের ছায়ারূপ দেখতে পেলাম কেন? দৃশ্যটি যখন সম্পূর্ণ ভুলে গেছি, তখনই সেই প্রশ্নের উত্তর পাই। জানতে পারি, বুবুর মায়ের আত্মহত্যার কথা। যার পরেই বুবু মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। যে বুবুর সঙ্গে কথা বলে এসে রাজা এলাকে সব জানাচ্ছে, সেই অসংলগ্ন বুবু কিন্তু আসলে তার মায়ের আত্মহত্যার ফলাফল। তাই হয়তো এক ঝলকে, ওই ঝুলন্ত দেহের সংকেতটি আমাদের সামনে রেখে, ছবিটি নিয়ে এগিয়ে গেলেন পরিচালক!

আরও পড়ুন-ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদা: ফেলে আসা প্রথম প্রেমের অবিচল চরণধ্বনি

এরকরম অজস্র সম্পদ ছড়িয়ে রয়েছে এই ছবিতে। যেমন, ছবিতে দেখতে পাই এলার স্বামী একজনের কাছে তার পালিত কুকুরকে মিট করানোর জন্য অন্য ভালো কুকুরের সন্ধান-উপায় জানতে চায়। এর পাশে, অপছন্দ থাকা সত্ত্বেও, নতুন ফ্ল্যাটের বিনিময়ে, এলা তার অফিসের বসের সঙ্গে 'কম্প্রমাইজ' করতে রাজি হয়। ছবিতে দেখি, এলা যখন বসের কাছে যাবে বলে বেরচ্ছে তখন মশা মারার স্প্রে হাতে কর্পোরেশনের লোক ঢুকে আসে। সকলেই জানেন, এই ধরনের স্প্রে-তে সাদা এক কুয়াশার মতো আবহাওয়া তৈরি হয়। এই সাদা কুয়াশার মধ্যে দু'টি ক্রিয়া ঘটমান। এক, কুকুরদের মেটিং। দুই, এলার বসের কাছে যাওয়া।

কুয়াশার মধ্যে একটা শব্দ লুকিয়ে থাকে, স্বপ্ন। আর স্বপ্ন তো মিলনের প্রতিশব্দই। কিন্তু এক্ষেত্রে ‘মিলন’ শব্দটিকে কি আমরা প্রয়োগ করতে পারি? কুকুরদের দৃশ্যটিতে দেখা যায়, মেয়ে কুকুরটি, ছেলে কুকুরটির সামনে প্রথমে ইতস্তত, নীরব। আসলে পুরো বিষয়টিই একটি যান্ত্রিক যৌনপ্রক্রিয়া। এলার ক্ষেত্রেও তাই। কুকুরদের মেটিংয়ের ফলে ওই ব্রিডের নতুন কুকুর পাবে এলার স্বামী। আর এলা পাবে, নতুন ফ্ল্যাট।

আমাদের মনে থাকবে, পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর প্রথম ছবি ‘আসা যাওয়ার মাঝে’-র শেষ দৃশ্যে কুয়াশাময় এক জঙ্গলের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর দেখা হয়। সেই দেখা হওয়াটুকু এক অপূর্ব মিলনের সৌহার্দ্য জাগিয়ে তোলে আমাদের মনে। ‘মায়ানগর’-এও সাদা কুয়াশার এফেক্টটা পরিচালক আনলেন কিন্তু তাঁকে ব্যবহার করলেন সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে। এই সাদা কুয়াশা, আসলে মশা মারার স্প্রে থেকে তৈরি। সেই কুয়াশার মধ্যে স্বপ্ন নেই, আছে মৃত্যু। পুরো ঘটনার ক্রুয়েলিটিকে ওই মৃত্যুময় কুয়াশার আশ্চর্যভাবে প্রকাশ করেছে।

আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত

এই ছবিতে এলা চরিত্রে, শ্রীলেখা মিত্রের অভিনয় আজীবন মনে রাখার মতো এবং ইতিমধ্যেই বহুলভাবে তা সমাদৃত, পুরস্কৃতও। পাশাপাশি, এলার স্বামীর চরিত্রে সত্রাজিৎ সরকারের অভিনয়ও আমরা কোনওদিন ভুলতে পারব না। বিশেষত এই চরিত্রটিকে যে ধৈর্য দান করেছেন পরিচালকের ঈশ্বর-মন, তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। ‘মায়ানগর’ আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর তৃতীয় ছবি। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ এবং ‘জোনাকি’-র পাশাপাশি এই ছবিটিতেও আদিত্য নীরব ভদ্রতায় প্রমাণ করে দিলেন কলকাতায় বসে, এখনও এমন উচ্চতার ছবি বানানো যায়। একজন বাঙালি পরিচালক তা পারেন। ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কত সাধারণ দ্রব্যকে পরিচালক নতুন সংকেতে ব্যবহার করেছেন এখানে। হুমায়ুন কবিরকে জীবনানন্দ দাশ একটি চিঠিতে লিখেছিলেন:

আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু। ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে, আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।

আমাদেরও ভয় হয়, ‘মায়ানগর’-এর মতো ছবি যেন বহুল স্তরে অস্বীকৃত না হয়ে থাকে। বরং ‘আসা যাওয়ার মাঝে’, ‘জোনাকি’, ‘মায়ানগর’ যিনি বানিয়েছেন, সেই আশ্চর্য পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত যেন আরও নতুন ছবির বিস্ময় আমাদের উপহার দিয়ে চলেন! দর্শক হিসেবে এটুকুই আমরা আশা করব।

More Articles