নিচু জাতের বলে বারবার অপমানিত! নিজের কাজেই নিজের পরিচয় গড়েছিলেন মেঘনাদ সাহা
Meghnad Saha: মেঘনাদ সাহার সঙ্গে জড়িত অনেক অজানা ইতিহাস।
অবিভক্ত বাংলার এক অপরিচিত গ্রামের একটি ছেলে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিবিদ। মেঘনাদ সাহার নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এইরকম বহু পরিচয়। বর্তমান সময়ে জন্মগ্রহণ করলেও হয়তো পুজোর চাঁদা না দেওয়ার কারণে তাকে বিদ্রুপের মুখেই পড়তে হতো। তার কড়া মেজাজ এবং কিছু ক্ষেত্রে ঠোঁটকাটা উত্তরের জন্য হয়তো সমাজ তাকে বদমেজাজি মানুষ বলত। আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেলেও নিজের বেশভূষার দিকে নজর না রাখার কারণে হয়তো তাঁর প্রতি অনেকেই একটা বাঁকা হাসি দিতেন। এমনকী, দেবরাজ ইন্দ্রর নাম অনুসারে দেওয়া তাঁর পিতৃদত্ত নাম বদলে ফেলে মহাকাব্যে রাক্ষস বলে পরিচিত ইন্দ্রজিতের নাম অনুসারে নিজের নাম রাখার কারণে হয়তো তিনি কিছু মানুষের কাছে নিন্দিত হতেন। তাও আমাদের পরিচিত অধ্যাপক সাহা হয়তো নিজের খেয়ালেই নিজের জীবনযাপন করতেন।
মেঘনাদ সাহার বড় ছেলে অজিত সাহা নিজের লেখা একটি চিঠিতে তাঁর বাবার নামকরণের কারণ সম্পর্কে লিখেছিলেন। মেঘনাদ সাহার জন্মদিনে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। সেই প্রবল ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাতের কারণে দেবরাজ ইন্দ্রর নাম অনুসারে তার নামকরণ হয় মেঘনাথ। নামকরণ দেবতার নাম অনুসারে হলেও সমাজের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল নিচু জাতের একটি ছেলে হিসাবে। সেই কারণে কখনও পড়াশোনার কারণে আশ্রয়দাতার বাড়িতে বৈষম্যমূলক আচরণ, কখনও সরস্বতী পুজোর অঞ্জলির সময় উপস্থিত থাকার কারণে জাতিগত বিদ্বেষ তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। সম্ভবত বিভিন্ন সময়ের এই গঞ্জনার কারণেই নিজের নাম দেবতার বদলে তথাকথিত রাক্ষসের নাম অনুসারে রাখেন। 'মেঘনাথ' হয়ে উঠেছিলেন মেঘনাদ।
আরও পড়ুন: কোয়ান্টাম মেকানিক্সে সাড়া জাগানো এই আবিষ্কারই নোবেল এনে দিল তিন পদার্থবিজ্ঞানীকে
নিজের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তী পর্যায়ের অধ্যয়নের জন্য বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে দূরের এক স্কুলে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে রোজ স্কুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এই সময় মেঘনাদ সাহার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর দাদা জয়নাথ। ভাইয়ের পড়াশুনার প্রতি ঝোঁক দেখে জয়নাথ, ডাক্তার অনন্ত দাসের কাছে তাঁর ভাইকে বাড়িতে থাকতে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। সেই অনুরোধে ডাক্তার অনন্ত দাস নিজের বাড়িতে মেঘনাদ সাহাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বাড়ির বিভিন্ন কাজ করে দেওয়ার বদলে খাবার এবং আশ্রয় মেঘনাদের প্রাপ্য ছিল। যদিও নিচু জাতের মানুষ হওয়ার কারণেই খাবার এবং আশ্রয়ের সঙ্গে জুটেছিল প্রতিদিনের গঞ্জনা। বাড়ির নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া তাঁর চলাচলে বাধা দেওয়া, এক জায়গায় তাঁর খাবার বাসন না রাখতে দেওয়ার মতো আরও বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছিলেন।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসে কলেজজীবনেও তিনি বৈষম্যর শিকার হয়েছেন। একবার কলেজের সরস্বতী পুজোর অঞ্জলির সময় তাঁর উপস্থিতি উচু জাতের ছাত্রদের অস্বস্তি এবং আপত্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। মেঘনাদ সাহা কলেজে পড়ার জন্য মেধাবৃত্তি পেয়েছিলেন। সেই কারণে বহু ছাত্র তাঁর প্রতি ঈর্ষাকাতর মনোভাব পোষণ করত। নিচু জাতের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও পুজোর স্থানে উঁচু জাতের ছাত্রদের সঙ্গে উপস্থিত হওয়া অথবা মেধাবৃত্তি পাওয়া অথবা দুটোর সম্মিলিত কারণেই হয়তো পুজোর অঞ্জলির সময় তাঁর উপস্থিতির বিরোধিতা হয়েছিল।
এই ঘটনা যে তার মনে দাগ কেটেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মেঘনাদ সাহার পরবর্তী জীবনের এক ঘটনায়। সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে আসা কিছু ছেলেকে তিনি নিজের সংগ্রহে থাকা বিপুল পরিমাণ বই দেখিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি এইভাবেই দেবীর আরাধনা করা পছন্দ করেন। নিচু জাতের মানুষ হিসেবে সমাজের বহু মানুষের থেকে গঞ্জনা পেলেও মেঘনাদ সাহা কোনওদিন সমাজের নিচু জাতের মানুষের জন্য কোনও বিশেষ সুযোগ দেওয়ার কথা বলেননি। তিনি সমাজের সকল মানুষের শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলেছিলেন, যার ফলে যোগ্য মানুষ নিজের সুযোগ পাবে। ১৯১৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের এক উত্তরপত্রে বছর কুড়ির মেঘনাদ সাহার এই বক্তব্য তাঁর পরবর্তীকালের বিভিন্ন বক্তব্য এবং লেখাতেও দেখতে পাওয়া যায়। শিক্ষক মেঘনাদ সাহার প্রসঙ্গে জানা যায় যে, তাঁকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে কঠোর মনোভাবের মানুষ বলে মনে হলেও ছাত্রদের প্রতি তিনি যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। একদিকে যেমন কঠোর অধ্যাবসায়ের প্রশংসা করতেন, তেমনই ছাত্রদের সমস্ত প্রয়োজনের দিকে তাঁর নজর ছিল। যুদ্ধের সময় নিজের বাড়িতে ছাত্রকে আশ্রয় দেওয়া থেকে নিজের হাতে চা বানিয়ে ছাত্রকে দেওয়া অবধি সবকিছুই নিজের দায়িত্ব মনে করেই পালন করেছিলেন।
১৯৫১ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে মেঘনাদ সাহা জয়লাভ করেছিলেন। যদিও তার আগেও বারংবার রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিকল্পনা তার একটা উদাহরণ মাত্র। বহু মানুষের মতে, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে তার একনিষ্ঠ বিজ্ঞান-গবেষণা ক্ষতির মুখে পড়েছিল। সেই কারণেই তিনি তাঁর প্রাপ্য নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। যদিও বহু মানুষ এই ক্ষেত্রেও বঞ্চনার অভিযোগ তোলেন। তাঁদের মতে তাপ আয়নন বিষয়ক গবেষণার ফলে নোবেল পুরস্কার তার প্রাপ্য ছিল, কিন্তু পরাধীন দেশের বিজ্ঞানী হওয়ার অপরাধে মেঘনাদ সাহা সেই পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। মানুষ যাই বলুক, বঞ্চিত মানুষকে সাহায্য করা নিজের কর্তব্য মনে করা মেঘনাদ সাহা যে নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার কারণে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন- এইরকম কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। সমাজের সব মানুষ সমান সুযোগ পাবে, এই লক্ষ্যপূরণে তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন অবধি কাজ করে গিয়েছেন।
১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর, অর্থাৎ আজকের দিনে, অবিভক্ত বাংলার শেওড়াতলি গ্রামে মেঘনাদ সাহা জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তথ্য ঋণ: আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য বেটার ইন্ডিয়া