রামচন্দ্রকে নরকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত
Michael Madhusudan Dutt: রামচন্দ্রের নরকদর্শনের কোনও প্রসঙ্গই কোনও রামায়ণের পাঠে সাধারণভাবে আমরা পাই না। রামায়ণী গানের অজস্র পুঁথিতেও এ বিষয়ের কোনও উল্লেখ নেই।
১
জীবনানন্দ দাশ ‘বোধ’ কবিতায় সেই কবে লিখে গেছেন, ‘বলি আমি এই হৃদয়েরে;/ সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?’ – আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, হৃদয় নয়, ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয় স্মৃতি। এক-একজন মানুষের এক-একটি দিন-বছর বা অভিজ্ঞতার সূত্রে কত মানুষ, কত ঘটনা আসে আর চলে যায়, মনটা হু-হু করে ওঠে। স্মৃতিপট শব্দটা এসব দিক থেকে বেশ লাগসই অভিব্যক্তি। পটের শিল্পরূপ সেই কোন অনাদি যুগের প্রকল্পনা। লোক পরম্পরায় দেখা যাবে পটের নানা রূপবৈচিত্র্য পূর্ব ভারতের নানা অঞ্চলে। মোদ্দা রূপায়তনটা মোটামুটি এক। পটশিল্পীরা নিজেরাই নানা বিষয়ে ছবি এঁকে তারপর গানে গানে তাদের উপস্থাপন করেন। একদিকে চলে ছবির পর ছবি যাওয়া-আসা, আর অন্যদিকে চলে নানা কাহিনি পয়ারে বাঁধা বা পালা গানে। কথার ধারাভাষ্য আর ছবির সূত্র। এই দুইয়ের পারস্পারিকতায় এগোতে থাকে পটচিত্রের প্রদর্শনী। লক্ষ্য করে দেখবেন, ফ্রেমের কঠোর কাঠামোয় বাঁধা ছবিগুলি সুরের সংস্পর্শে এক মায়া তৈরি করে। পটচিত্রের সঙ্গে কোথাও একটা, ছবি-কথকতার মিশ্রণেই হয়তো, চলচ্চিত্রের আভাস আসে। স্মৃতিও খানিকটা তাই। এক একটা দৃশ্য এবং তার অনুষঙ্গ, বর্ণ-স্পর্শ, অবশ্যই শব্দ, কখনও বা স্বাদ – সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা যেন দপ্ করে জ্বলে ওঠে।
স্মৃতির কথা লিখতে বসে চলে গেলাম পটচিত্রে। এই এক মুশকিল! কথার টানে নানা দিকে ছুটতে থাকে মন। মন বলতেই অবশ্য তার দু'দিক নিয়েই পুরো অবয়ব। একদিকে যদি বারবার ফেলে আসা দিনের গল্প, তাহলে অন্যদিকে আগামীর আশ্চর্য হাতছানি। ভবিষ্যতের এই উজ্জ্বল সম্ভাবনার প্রতি আকর্ষণকেই হয়তো আশা বলে। আশার সঙ্গেই থাকে আকাঙ্খা। আগামীতে অতৃপ্ত যত মনস্কামনা – তার পরিপূর্তির আশ্বাস কোথাও থাকে। সেইজন্যই অমোঘ বেগে সেদিকে আমরা ছুটে চলি। অল্প বয়সে আমাদের এই আকর্ষণ দুর্দমনীয়, এক রোখা, না জানি কত সম্ভার নিয়ে ভবিষ্যৎ অপেক্ষারত – এই বিশ্বাসে ছুটে চলা। বয়স বাড়ে। ক্রমশ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে বোঝা যায়, মোটামুটি অবিশ্বাস্য কোনও প্রাপ্তি আর ভবিষ্যতের গর্ভে অপেক্ষা করে নেই। তখনই তারুণ্যের উল্টো এক প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনাবিল অনিঃশেষ অতীতচারিতা। তখন ফেলে আসা দিনের সুখস্মৃতি চারদিকে ভিড় করে আসে। স্মৃতিপটের প্রদর্শনী। তখন মানুষ ফিরে যায় অতিবাহিত দিনের কাছে। শরীর তখন ধীরে ধীরে অবসন্ন হতে থাকে, কমে যায় দৃষ্টিশক্তি, দৌড়ঝাঁপ করার ক্ষমতা, মানুষ বুঝতে শেখে, খুব বেশি কোনও ঘটনা আর অপেক্ষা করে নেই তার জন্য। এখন শুধু অন্তিম অবসানের জন্য প্রস্তুতি। দান্তে তাঁর ‘ডিভাইন কমেডি’-র ইনফেরনো তৃতীয় ক্যানেটায় বর্ণনা করেছিলেন নরকের। গুরু তথা পথপ্রদর্শক ভার্জিলের সঙ্গে ভয়ংকর সেই নরকের দিকে তাঁর যাত্রা। মৃত্যুর জন্য প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ মানুষের ধীর অথচ নিশ্চিত যাত্রার প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল বাংলা কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই অত্যাশ্চর্য ইঙ্গিত –
‘এখন সেই বয়েস, যখন/ দূরেরটা বিলক্ষণ স্পষ্ট -/ শুধু কাছেরটাই ঝাপ্সা দেখায়।’
আবার সরে গেছি মূল প্রসঙ্গ থেকে। বলছিলাম দান্তের কথা। বীতস্পৃহ মানুষের জরাগ্রস্ত জীবনের কথাও। সেই যে মহাতমসায় ঢাকা ভীতিপ্রদ নরকের দ্বার। তার সামনে এসে দেখা গেল তোরণে লেখা আছে – ‘Through me the way into the Grieving city…’। আরও অনেক কথাই লেখা ছিল, আমি তার দুটো অংশ, অবশ্যই ইংরেজি অনুবাদে, মনে করাব – ‘Through me the way into eternal sorrow’ আর ‘Abandon every hope you who enter here’। আশা নেই, অনন্ত দুঃখের সেই নরক। উনিশ শতকের এক বাঙালি মহাকবি, রামচন্দ্রকে পৌঁছে দিলেন, সমস্ত মহাকাব্যের ঐতিহ্য ভেঙে নরকের সামনে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) পড়লে দেখা যাবে অষ্টম সর্গে নরকের মুখোমুখি রামচন্দ্র। মনে রাখা ভালো, অষ্টম সর্গের নাম ‘প্রেতপুরী’। মধুসূদনের কলমে যেন ঝলসে উঠলেন দান্তে। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের অভূতপূর্ব এক মিলন গঠিত হল মধু কবির হাতে। রামচন্দ্র দেখলেন, প্রবেশদ্বারে লেখা,
‘… এই পথ দিয়া/ যায় পাপী দুঃখ দেশে চির দুঃখ ভোগে; -/ হে প্রবেশি, ত্যজি স্পৃহা, প্রবেশ এ দেশে।’
প্রায় হুবহু তর্জমা করেছেন মাইকেল। রামচন্দ্রের নরকদর্শনের কোনও প্রসঙ্গই কোনও রামায়ণের পাঠে সাধারণভাবে আমরা পাই না। রামায়ণী গানের অজস্র পুঁথিতেও এ বিষয়ের কোনও উল্লেখ নেই। বোঝা যায়, মধুসূদন সম্পূর্ণত, এই বিষয়টি প্রতিগ্রহণ করেছেন দান্তের কাছ থেকে। দান্তের সূত্রে এভাবেই নরকদর্শন করলেন রাম। ‘ত্যজি স্পৃহা, প্রবেশ এদেশে’। লক্ষ্য করুন আশা নয়, স্পৃহা। মধুসূদন সেই বীতস্পৃহার কথাই বলছেন।

দান্তে
আরও পড়ুন- ‘জীবনের নোংরা দিকটা আমার ছবিতে যথেষ্ট উঠে এসেছে’: সত্যজিৎ রায়
স্মৃতি কত আশ্চর্য মোড় নেয়। মনে পড়ে গেল, ইতালি-ভাষাবিদ শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। তিনি এক বিরল মানুষ। ধুতি পাঞ্জাবি পরা ইতালিয়ান ভাষা পারদর্শী সাহিত্য ভাবুক। দীর্ঘদিন তর্জমায় মগ্ন ছিলেন। নীরবে নিঃশব্দে অনুবাদ করে চলতেন দান্তে এবং অন্যান্য মহাস্রষ্টার রচনা। বাংলা তর্জমায় তাঁর হাত ধরে ডিভাইন কমেডির স্বাদ এসেছিল সাত সাগর পেরিয়ে। থাকতেন রাজবল্লভ পাড়ার মুখে, জগৎ মুখার্জি পার্কের কাছে। কতবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে কত গল্প শুনেছি কিন্তু সাহিত্যের অলিন্দ আর প্রাঙ্গন স্পর্শ করে। তিনি কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন। দীর্ঘায়ু এই মানুষটি চলে যাওয়ায় বাংলা সাহিত্যচর্চা এবং চিন্তার এক জানলা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। নীরবে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম চালিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তও হারিয়ে গেল। স্বাগত বিষাদ!
২
মে মাস এসে গেল। এই মাস একই সঙ্গে স্মৃতি আর উদযাপনের। বাঙালির জীবনে এরকম মাস আর নেই। মে মাসেই ২ তারিখ জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ১৯২১ সালে। চার বছর আগেই হৈ-হৈ করে হয়ে গেল তাঁর শতবার্ষিকী। চলচ্চিত্রকার এবং শিশু-কিশোর সাহিত্যিক হিসেবে তো বটেই, সংগীত, চিত্রকলা, ফটোগ্রাফি এবং মুদ্রণ বিষয়ে তাঁর চর্চা এবং জ্ঞান ছিল বিস্ময়কর।
মে মাস মানেই বৈশাখ। আর বৈশাখ মানেই রবীন্দ্রনাথ। জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালের ৬ মে। ইদানীংকালে অবশ্য সাধারণত সাত বা আট তারিখে পড়ে তাঁর জন্মদিন। নিজের হাতের লেখায় রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন তাঁর জন্মতারিখ – ৬ মে। কিন্তু, এমন এক যুগপুরুষ এবং বাংলা সাহিত্যের সূর্যপ্রতিম ব্যক্তিত্বের জন্মতারিখ গুগ্ল সার্চে গিয়ে দেখবেন। অবশ্যম্ভাবী, আপনি দেখবেন ভুল তারিখ – ৭ মার্চ দেওয়া আছে। যেমন দুর্ভাগা দেশ, তেমন দুর্ভাগা জাতি। এমন ঘটনা কি শেক্সপিয়র বা গ্যোয়েটে কিংবা টলস্টয়ের ক্ষেত্রে ঘটতে পারত? এলিয়ট, পিকাসো থেকে ব্রেখ্ট বা মোৎসার্টের কথা না হয় বাদই রাখলাম। অবশ্য যে দেশে গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতো মহানাট্যকার তথা নির্দেশকের নাম দশকের পর দশক ধরে মেট্রো স্টেশনে ভুল বানানে (গিরীশ, যার অর্থ ভিন্ন) লেখা থাকে, সেই অসাড় বাঙালি জাতিকে নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। আবার আমি বিষয় থেকে সরে এসেছি। ইংরেজিতে এই অসুখকে বলে ‘Digression’। এই সমস্যা থেকে নাকি সহজে মুক্তি মেলে না।
কথা হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ নিয়ে। মনে রাখা এক্ষেত্রে সমীচীন, পঁচিশে বৈশাখ ছিল জন্মকালে ৬ মে। আর তাঁর প্রয়াণদিবস বাইশে শ্রাবণ ছিল ৭ অগাস্ট, ১৯৪১ সালে। কে জানে, এই ৭ অগাস্টের চাপেই ইন্টারনেটে জন্ম তারিখ আর মৃত্যুর তারিখ দুই-ই সাতে চলে এসেছে কিনা! যদি এখানেও শেক্সপিয়রের সঙ্গে একটা সমীপতা আনা যায়। শেক্সপিয়রের জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ একই, অন্তত সেরকমই স্বীকৃত, কয়েকদিন আগেই তাকে ফেলে এলাম আমরা, ২৩ এপ্রিল।
মে মাসে বাংলা আর বাঙালির একদম নিজস্ব দুই চিরপ্রণম্য ব্যক্তিত্বের জন্ম। আমি ভাবছিলাম দু'জনের মধ্যে সংযোগ বিন্দু একটা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। অবশ্যই, সকলেই জানেন, সত্যজিৎ রায়ের নিজের হাতে তৈরি ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক তথ্যচিত্রটি। রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সেই ছবিটি তৈরি হয়েছিল ১৯৬১ সালে। সেই ছবিতে ভাষ্যপাঠ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ৫৪ মিনিট দীর্ঘ সেই তথ্যচিত্রটি সকলেরই চেনাজানা।
আরও পড়ুন-তরুণ কবিদের মধ্যে আদৌ জেগে আছেন রবীন্দ্রনাথ?
হঠাৎই মনে পড়ল, সত্যজিৎ রায়ের ছেলেবেলার নানা স্মৃতি নিয়ে লেখা ‘যখন ছোট ছিলাম’ (১৯৮২) বইটির কথা। সেখানে ‘বছর দশেক’ বয়সে তিনি পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন, তার বর্ণনা আছে। সেই প্রসঙ্গেই আছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে আট লাইনের সেই কবিতা অটোগ্রাফ খাতায় পাবার গল্প। তারপর, সত্যজিৎ সেই শান্তিনিকেতনের সূত্রেই বলেন,
‘সেই বারই দেখলাম যুযুৎসু বা জুডোর নমুনা। প্রাচীন যুগে চিনের বৌদ্ধ লামারা দস্যুদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার জন্য হাতিয়ার ছাড়া লড়াই ও আত্মরক্ষার এই কৌশলটা উদ্ভব করেছিল। চিন থেকে যায় জাপানে, তারপর জাপান থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে জুডো।’
মজার কথাটা হলো, জুডো আর যুযুৎসু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ রায় চিত্তাকর্ষক এক সমীকরণ পরস্পরের কাছাকাছি এসে গেছেন। সেই গল্পই, আগামী কিস্তিতে বিশদে বলব। সেই গল্পেও মোটামুটিভাবে ১৯৩০ যুগের। যদিও শুধু শান্তিনিকেতনে নয়, সেই গল্পের রেশ ধরে আমরা ঢুকে পড়ব কলকাতায়। তৎকালীন কলকাতায়।
শুরু করেছিলাম স্মৃতি আর স্মৃতিপটের নানা প্রসঙ্গ দিয়ে। এই যে, রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের গল্প, সেও তো আসলে স্মৃতি রোমন্থনের এক আয়োজন। স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে আমরা হঠাৎ হঠাৎ এমন সব তথ্য পেয়ে যেতে পারি, যা আমাদের তাক্ লাগিয়ে দিতে পারে। ব্যক্তিস্মৃতি বা ব্যক্তিস্মৃতিকথার নানা প্রসঙ্গ তখন জাতিগত বা জাতি আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত বা গৃহীত হবে। সেখানেই স্মৃতিমূলক লেখালেখির মূল গুরুত্ব। সব সময় যে নামী বা উদযাপিত ব্যক্তির স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনীই হতে হবে, তারও কোনও মানে নেই। একেবারে অতি সাধারণ পুরুষ বা মহিলার দিনযাপন এবং বিশেষ স্থান কালের কথাও আমাদের কম সমৃদ্ধ করে না। এই জন্যই যে কোনও আত্মজৈবনিক গ্রন্থ, সে স্মৃতিকথাই হোক বা আত্মজীবনী খুঁটিয়ে পড়াটা খুব জরুরি। কত ধরনের প্রসঙ্গ বা পরিসরই সেসব লেখায় যে ধরা থাকে, তার হদিশ বাইরে থেকে পাওয়া বেশ কঠিন।
আপাতত রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন চমৎকার আয়োজনে পালন করা যাক। পরের কিস্তিতে আমাকে শোনাতেই হবে, যুযুৎসু শেখা – শেখানোর কাহিনিতে কেমনভাবে জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ রায়!