প্রার্থীতালিকায় কেন নেই নুসরত, মিমি, অর্জুনরা? কী স্ট্র্যাটেজি তৃণমূলের?
Lok Sabha Election 2024: যে কেন্দ্রগুলি থেকে গতবারের ভোটে ভালো ফল করতে পারেনি তৃণমূল, সেই প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই নতুন প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। স্বাভাবিক ভাবেই প্রার্থীতালিকায় ঠাঁই পাননি বহু...
শিয়রে লোকসভা ভোট। এর মধ্যেই ঘোষণা হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা। যেখান থেকে বাদ পড়েছে বহু প্রত্যাশিত মুখই। যে কেন্দ্রগুলি থেকে গতবারের ভোটে ভালো ফল করতে পারেনি তৃণমূল, সেই প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই নতুন প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। স্বাভাবিক ভাবেই প্রার্থীতালিকায় ঠাঁই পাননি বহু পুরনো মুখই। সেই নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে দলের অন্দরে। যদিও তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থীতালিকা প্রকাশের আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, যাঁরা যাঁরা প্রার্থী তালিকায় থাকলেন না, তাঁদের কোনও না কোনও দায়িত্ব ঠিক দেওয়া হবে।
সে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় যা-ই বলুন না কেন, তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় জায়গা না পাওয়া নেতানেত্রীদের একাংশ বেশ ক্ষুব্ধ। প্রার্থী তালিকায় জায়গা না পাওয়ার খবর আসতে না আসতেই তৃণমূলের সমস্ত পদ থেকে ইস্তফা দেন তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ সায়ন্তিকা। শুধু সায়ন্তিকা নন, এবার প্রার্থী তালিকায় ঠাঁই পাননি আরও অনেক উল্লেখযোগ্য মুখই।
যতদূর জানা গিয়েছে, আরামবাগ থেকে টিকিট পাননি সাংসদ অপরূপা পোদ্দার। তার বদলে ওই কেন্দ্র থেকে লড়ছেন মিতালি বাগ। বর্ধমান পূর্ব থেকে প্রার্থী করা হচ্ছে সাংসদ সুনীল কুমার মণ্ডলকে। তাঁর পরিবর্তে প্রার্থী হচ্ছেন পেশায় চিকিৎসক ড. শর্মিলা সরকার। সময় সুযোগ মতো বহুবার দল বদলেছেন অর্জুন সিং। মধ্যিখানে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যান। সেখান থেকে ফের ফিরে আসেন তৃণমূলে। সেই অর্জুন এবার ব্যারাকপুর কেন্দ্রে টিকিট পাননি। সেই জায়গায় প্রার্থী হয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। ব্যারাকপুরে প্রার্থী হতে না পেরে যেখানে ব্যাপক ক্ষুব্ধ অর্জুন সিং, সেখানে টিকিট পাওয়া পার্থ ভৌমিককে অবশ্য আশ্বাসের সুরেই বলতে শোনা গিয়েছে, 'নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের জন্য যে লড়াই সেই লড়াইতে আমি, অর্জুন সবাই পাশপাশি থাকব। হয়তো আগে ও MP ছিল আমি MLA ছিলাম। এখন আমি লোকসভাতে দাঁড়াচ্ছি, ও নিশ্চয় অন্য কিছু সম্মান জনক, দল নিশ্চয় ওর জন্য অন্য কিছু একটা ভাববে। নিশ্চিত ভাবে ও সম্মানজনক কিছু পাবে।'
আরও পড়ুন: নির্বাচনী বন্ড: কে কত টাকা দিয়েছে কোন দলকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জানবে দেশ?
শুধু সায়ন্তিকাই নন, বসিরহাট থেকে বাদ পড়েছেন তারকাপ্রার্থী অভিনেত্রী নুসরত জাহান। অবশ্য তিনি যে টিকিট পাচ্ছেন না তা মোটের উপর স্পষ্টই ছিল। রাজনৈতিক মহলের মতে, নুসরত গত লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতলেও জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেননি। তাই নিজের সংসদীয় এলাকায় তেমন কোনও কাজ করেননি, অন্ততপক্ষে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি সেরকমই। সম্প্রতি সন্দেশখালি কাণ্ডের পরেও নিজের সংসদীয় এলাকায় দেখা যায়নি তাঁকে। পরিবর্তে সোশাল মিডিয়ায় বেশি সক্রিয়। তাই আর টিকিট পাননি নুসরত। তাঁর পরিবর্তে ভূমিপুত্র হাজি নুরুল ইসলামের উপর ভরসা রেখেছে ঘাসফুল শিবির।
মাঝখানে অভিমান, ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংসদ পদ ছাড়ার কথা জানিয়েছিলেন অভিনেত্রী সাংসদ মিমি চক্রবর্তী। রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। মিমি সম্প্রতি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন। তবে চব্বিশের যুদ্ধে দল তাঁর প্রতি আস্থা রাখেনি। মিমির পরিবর্তে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে যুবনেত্রী সায়নী ঘোষকে বেছে নিয়েছে দল। গল্ফগ্রিনের বাসিন্দা সায়নীর তারকা ইমেজ যেমন রয়েছে, তেমনই আবার দক্ষ সংগঠকও। মথুরাপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করা হয়নি সাংসদ চৌধুরী মোহন জাটুয়াকে। ওই কেন্দ্র থেকে টিকিট দেওয়া হয়েছে বাপী হালদারকে। CAA, NRC নিয়ে হইচইয়ের মাঝে এবারের লোকসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোট বড় ফ্যাক্টর। তাই বনগাঁয় মতুয়া গড় থেকে কেউ প্রার্থী হবেন বলেই মনে করা হচ্ছিল। মমতাবালা ঠাকুর বর্তমানে রাজ্যসভার সাংসদ। চব্বিশে তৃণমূলের টিকিট পেলেন বিশ্বজিৎ দাস। তিনি বর্তমানে বাগদার বিধায়ক। ২০১৯-এর তালিকায় যে সব প্রার্থীর নাম ছিল তাঁদের অনেকেই এবার আর টিকিট পাননি।
যাঁরা যাঁরা টিকিট পেলেন না ২০২৪ লোকসভা ভোটের প্রার্থীতালিকায়, তাঁদের অনেকেই বেশ ক্ষুব্ধ। টিকিট না পেয়ে আফসোসের সুর ব্যারাকপুরের তৃণমূল নেতা অর্জুন সিংয়ের গলায়। এমনটা হবে জানতে বিজেপি থেকে ফিরতেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি। ক্ষুব্ধ হয়ে দলের সমস্ত পদ ছেড়েছেন সায়ন্তিকা। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছেন, যাঁরা যাঁরা টিকিট পাচ্ছেন না, তাঁদের জন্য অন্য দায়িত্ব ভেবে রেখেছে দল। তাঁদের উদ্দেশে মমতার বার্তা, 'মনে রাখবেন আমরা যতদূর সম্ভব, প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করেছি মনের মতো। দুই একজনকে হয়তো দিতে পারিনি। তাঁদের জন্য আমি দুঃখিত। তাঁদের আমি, বিধানসভার ইলেকশন আসছে, বা দলের অন্যান্য পদে নিশ্চয় আমি দেব। কোথাও না কোথাও সুযোগ করে দেব।' একই সঙ্গে এই ভোটে প্রতিপক্ষ যে এক এবং একমাত্র বিজেপি, সে কথাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন মমতা। তাঁর কখায়,"মনে রাখবেন তৃণমূল বনাম বিজেপি। এখানে কংগ্রেস, সিপিএম ওদের সঙ্গে লড়াই চলবে। তৃণমূল কংগ্রেস বাংলায় একা লড়বে। অসমেও লড়বে। উত্তরপ্রদেশেও লড়বে। একটা সিটে অখিলেশের সঙ্গে কথা হয়েছে। মেঘালয়ে আমরা বিরোধী দল, মেঘালয়েও আমরা লড়ব। আর দেশ কোন পথে চলবে তৃণমূল কংগ্রেস ঠিক করবে, বাংলা ঠিক করবে। বাংলাই দিশা দেখাবে, বাংলাই পথ দেখাবে। বাংলাই রাস্তা দেখাবে।"
শুধু মিমি-নুসরতরাই নন, এই প্রথমবার তৃণমূলের হয়ে ভোটে লড়ছেন না অধিকারী পরিবারের কেউ। যদিও তা প্রত্যাশিতই ছিল। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলবদল করেন শুভেন্দু অধিকারী। অমিত শাহর সামনে যোগ দেন বিজেপিতে। বর্তমানে নন্দীগ্রাম বিধানসভার বিধায়ক তিনি। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। বলা চলে শুভেন্দুর দলবদলের পর থেকেই অধিকারী পরিবারে উলটো স্রোত। সাংসদ হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছে শিশির অধিকারী এবং দিব্যেন্দুকে। তাই অধিকারী পরিবারের কেউ যে ভোটের টিকিট পাচ্ছেন না, তা এককথায় নিশ্চিতই ছিল। তমলুক লোকসভা আসনে শিশিরের পরিবর্তে দেবাংশু ভট্টাচার্যতেই আস্থা রেখেছে ঘাসফুল শিবির। দিব্যেন্দুর লোকসভা কেন্দ্র কাঁথিতে তৃণমূলের চব্বিশের সৈনিক উত্তম বারিক। সুতরাং, এই প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে ভোটে লড়ছেন না অধিকারী পরিবারের কেউ। আবার মেদিনীপুর থেকে বাদ গিয়েছেন মানস ভুঁইয়াও। কারণ, বার বার যেমন বিতর্কে জড়িয়েছেন আবার তেমনই সাধারণ মানুষেরও তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভবিক্ষোভের শেষ নেই। এ বার টিকিট পেলেন না দীনেশ ত্রিবেদীও।
আরও পড়ুন:ধর্মীয় উস্কানি থেকে সিএএ-র হুঁশিয়ারি! ধর্মতলার মঞ্চ থেকে যে যে ইঙ্গিত দিলেন শাহ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের সংগঠন কিছুটা দুর্বল। মেগা ফাইটের আগে প্রায় সবকটি লোকসভা কেন্দ্রেই গতবারের প্রার্থীদের উপর আস্থা রাখতে পারল না ঘাসফুল শিবির। এবার দার্জিলিংয়ে টিকিট পাননি অমর সিং রাই। পরিবর্তে গোপাল লামার উপর আস্থা রেখেছে তৃণমূল। কোচবিহারে পরেশচন্দ্র অধিকারীর পরিবর্তে প্রার্থী জগদীশ চন্দ্র বসুনিয়া। আলিপুরদুয়ারে টিকিট পাননি দশরথ তিরকে। তাঁর বদলে শাসক দলের আস্থা প্রকাশ চিক বরাইকে। জলপাইগুড়িতে নির্মলচন্দ্র রায় প্রার্থী। বাদ গিয়েছেন বিমলচন্দ্র বর্মন। রায়গঞ্জে ‘দলবদলু’ কৃষ্ণ কল্যাণীই তৃণমূলের সৈনিক। বাদ গিয়েছেন কানাইয়া লাল। পরেশ চন্দ্র অধিকারী, দশরথ তিরকে, বিজয়চন্দ্র বর্মন, অমর সিং রাই, অর্পিতা ঘোষ, মৌসম নূর, মোয়াজ্জেম হোসেনের নাম এবার আর নেই। প্রার্থী তালিকায় জায়গা পাননি মমতাবালা ঠাকুর, রত্না দে নাগ, শ্যামল সাঁতরা প্রমুখ। বহরমপুরে বাদ গিয়েছেন অপূর্ব সরকার, রানাঘাটের রূপালি বিশ্বাস, ঝাড়গ্রামের বীরবাহা সোরেন, পুরুলিয়ার মৃগাঙ্ক মাহাতো, বিষ্ণুপুরের শ্যামল সাঁতরা, দুর্গাপুর-বর্ধমান লোকসভা মমতাজ সংঘমিত্রাকেও টিকিট দিল না দল। মনে করা হচ্ছে, বার্ধক্যজনিত কারণে এবার আর সিএম জাটুয়া, হুগলির রত্না দে নাগকেও টিকিট দেওয়া হয়নি।
তারকা মুখের বদলে ভূমিপুত্রে ভরসা, মানুষের মন বুঝে প্রার্থী তালিকা তৈরির মতো একাধিক দিক মাথায় রেখে ২০২৪ ভোটের রণনীতি ঠিক করেছে তৃণমূল। সেই সব কতটা কাজে আসে আসন্ন লোকসভা ভোটে, নাকি দলের অন্দরের ক্ষোভ আদতে বিপদে ফেলে বাংলার শাসকদলকে, সেটাই এখন দেখার।