বন্ধু হাসিনার বিদায়! ভারতে আবার উদ্বাস্তু সঙ্কট? কী পরিকল্পনা করছেন মোদি?
Narendra Modi Sheikh Hasina: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসা বাড়লেই ভারতের উদ্বেগ বাড়বে। হিংসা থেকে বাঁচতে শরণার্থীদের ভারত আটকাবে না আশ্রয় দেবে?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশ ত্যাগ করে সেনার বিশেষ বিমানে তিনি ভারতে, দিল্লিতে প্রথম এসে উপস্থিত হন। সোমবার সকাল থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাটকীয় পটপরিবর্তন ঘটেছে। সোমবার ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা লং মার্চ। সেই মিছিল চলাকালীনই বাংলাদেশের সেনা প্রধান জানিয়ে দেন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন আর সেনা জানিয়ে দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে দেশে। এরই মাঝে বাংলাদেশ ও ভারতের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকেন এদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ডাকা ওই বৈঠকে হাজির ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, ক্যাবিনেট সচিব রাজীব গৌবা, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রিন্সিপাল সচিব পিকে মিশ্র, ‘র’-এর প্রধান রবি সিন্হা এবং গোয়েন্দা বিভাগের (আইবি)-র ডিরেক্টর তপন ডেকা।
হাসিনা ভারতে আসার পরেই গাজিয়ায়াবাদের হিন্ডন বায়ুসেনা ঘাঁটিতে গিয়ে ভারতের মুখ্য নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সাক্ষাৎ করেন তাঁর সঙ্গে। বোন রেহানার সঙ্গে হাসিনা দেশ ছাড়তেই তাঁর সরকারি বাসস্থান ‘গণভবন’, সংসদ ভবন, আওয়ামী লীগের ছোট-বড় দফতরে ব্যাপক হামলা, লুঠপাট চালায় বিক্ষোভকারীরা। এমনকী বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মুজিবের মূর্তি! ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধির নামাঙ্কিত ‘ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’-ও হামলায় বিপর্যস্ত।
আরও পড়ুন- বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি! বাংলাদেশ আবার মৌলবাদীদের হাতেই?
ছাত্রদের আন্দোলনকে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। কোটা সংস্কারের দাবির ফাঁক ধরে এই আন্দোলনে বিএনপি এবং জামাতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলেই ধারণা। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তেই খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া ও বিএনপি, জামাতের সদস্যদের ভূমিকাকে মোটেই সহজ চোখে দেখছে না ওয়াকিবহাল মহল। নিষিদ্ধ কট্টরপন্থী সংগঠন জামাতে ইসলামি নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে। এর আগে বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ-সহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর একাধিক বার হামলার অভিযোগ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী এই সংগঠনের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় ভারত মনে করছে, অশান্তির এই আবহে বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ ভারতে আশ্রয় চাইতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই শুধু না, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীও ভারতে নিরাপদ আশ্রয় চাইতে পারে। হাসিনা এদেশে আসার পর এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বিস্তারে জানান। লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা, কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধিও জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলেছেন।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন শেখ হাসিনা। গত জুলাইয়ের শুরু থেকেই বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন শুরু হয়। হাসিনা সরকার নির্মমভাবে সেই আন্দোলন দমন করতে যথেচ্ছ গুলি চালায়। বাংলাদেশ জুড়ে এক সপ্তাহে ৩০০ জনের মৃত্যু ঘটে। এরপর আদালত কোটা সংস্কারের পক্ষে রায় দিলেও বিক্ষোভ থামেনি। গত রবিবার নতুন করে অস্থিরতা ছড়ায়। রবিবারই বাংলাদেশ আরও ১০০ জনের মৃত্যু দেখে। সোমবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান হাসিনা। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকের-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ঘোষণা করেন, হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং সেনাবাহিনী এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবে।
ভারত বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি এবং বিরোধীদের মিত্রশক্তিদের বিপজ্জনক ইসলামিক শক্তি হিসেবেই দেখে। তবে বাংলাদেশে নতুন করে ধর্মীয় সঙ্কটের যে হাওয়া উঠছে তার গতিপ্রকৃতি আপাতত অনিশ্চিত। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা ছাড়া এই মুহূর্তে ভারতের কাছে খুব বেশি বিকল্পও নেই।
ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্কের ইতিহাস যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঢের আগে, ১৯৭৫ সালে যখন তাঁর বাবা মুজিবুর রহমান সহ তাঁর পুরো পরিবারকেই হত্যা করা হয়, তখন ইন্দিরা গান্ধির সরকার হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছিল। এই মুহূর্তে মোদি সরকারের সঙ্গেও সখ্য রয়েছে তাঁর। ২০০৯ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নয়াদিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে উন্নতি হয়। সড়ক ও রেল যোগাযোগ থেকে শুরু করে সীমান্ত নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা সহ নানা বিষয়েই ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এই সময়ে দৃঢ় হয়।
আরও পড়ুন- আন্দোলনের চরিত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা রুখে দিতে হবেই
বাংলাদেশের এই নতুন বিক্ষোভকে সরাসরি সমর্থন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং জামায়াতে ইসলামী। তারা অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকারে কী ভূমিকা পালন করবে তা স্পষ্ট নয়। এই দু'টি দলই ভারতের বন্ধু নয়। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মেয়াদে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক ছিল খুবই দুর্বল। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসা বাড়লেই ভারতের উদ্বেগ বাড়বে। হিংসা থেকে বাঁচতে শরণার্থীদের ভারত আটকাবে না আশ্রয় দেবে? ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটারের সীমান্তে একাধিক জায়গা এমন রয়েছে যা দিয়ে বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটবেই।
বাংলাদেশের এই অস্থিরতার মাঝে সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী বা বিএসএফ আন্তর্জাতিক সীমান্তে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। ত্রিপুরার টিপরা মোথার নেতা প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য দেববর্মা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, কোনও অনুপ্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।
জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির সঙ্গে চিনের সম্পর্ক ভালো। ভারতের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক তলানিতে। বেইজিং এই ঘোলাজলে মাছ ধরার সুযোগ যে ছাড়বে না, তা শিশুও জানে। ফলে ভারতের সীমানা সঙ্কট ক্রমেই বাড়ছে। শ্রীলঙ্কা হোক বা মায়ানমার বা আফগানিস্তান, বা বাংলাদেশ- বিগত কয়েক বছরে ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা গেছে। চিন এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। মালদ্বীপও এই জোটের দিকেই ঝুঁকে। আফগানিস্তানেও তালিবানি সরকার ফিরে আসায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ। এর মধ্যে, ঢাকার সঙ্গে এই কূটনৈতিক টানাপড়েনে ভারতের ভূমিকা কী, তা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়।