সরকারি রক্তচক্ষুর দাস নয় আইন, মহম্মদ জুবেরের জামিন যে বার্তা দিল

সবদিক খতিয়ে দেখে তাই আদালত পরিষ্কার জানিয়েছে, জুবেরকে গ্রেফতারের সপক্ষে কোনও ন্যায্য কারণই নেই। তাঁকে আটকে রেখে, একের পর এক আদালতে ছুটিয়ে বেড়ানো অযৌক্তিক।


গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সরকার নির্বাচন হয়ে চলেছে এযাবৎ। তাই নির্বাচিত সরকারও গণতান্ত্রিক নীতি মেনেই শাসনকার্য চালাবে বলেই কাম্য। তার ব্যতিক্রম ঘটার অর্থ, স্বৈরতন্ত্রর ফাঁদে পা রাখা। কিন্তু ‘অমৃতকাল’-এ ভারত কি সেই স্বৈরতন্ত্রর দিকেই এগোচ্ছে? খবরের সত্যতা যাচাইকারী সাংবাদিক মহম্মদ জুবেরের গ্রেফতারি মামলায় উঠে আসছে এই প্রশ্নই। টানা ২৪ দিন জেলে থাকার পর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন জুবের। কিন্তু তাঁর গ্রেফতারি নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের মন্তব্য গুরুত্ব দাবি করে। গ্রেফতারির ক্ষমতা রয়েছে বলেই পাইকারি হারে তা প্রয়োগ না করে, পুলিশেরও সংযমী হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছে আদালত। কিন্তু সুধা ভরদ্বাজ থেকে ভারভারা রাও, স্ট্যান স্বামী থেকে সফুরা জারগার, দিশা রবি থেকে উমর খালিদ এবং সর্বোপরি মহম্মদ জুবের, বারবার ঠিক তার উল্টোটাই ঘটতে দেখা গিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট যে গ্রেফতারির ক্ষমতার অপব্যবহারের উল্লেখ করেছে, সরকারি রীতিনীতির সমালোচনায় মুখ খুললেই আকছার তার প্রয়োগ হতে দেখা গিয়েছে সাম্প্রতিককালে। সমাজকর্মী, সাংবাদিক, কলেজপড়ুয়া তো বটেই, নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধি জিগনেশ মেভানিও রক্ষা পাননি তা থেকে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটনাক্রম সাজানো হয়েছে কার্যত একই ছাঁচে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের, দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ‘কুখ্যাত’ বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে বছরের পর বছর জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে কাউকে। কারও বিরুদ্ধে আবার দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতায় ইন্ধন, ধর্মীয় ভাবাবেগে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ। তবে গ্রেফতারির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঝাড়াইবাছাই হয় বইকি! প্রকাশ্যে নিয়মিত দাঙ্গা, হাঙ্গামায় ইন্ধন জুগিয়ে গেলেও, শুধুমাত্র শাসক দলের প্রতিনিধি হওয়ার দরুন ছাড় পেয়ে যান কিছু মানুষ। আর সামান্য ব্যাঙ্গাত্মক ট্যুইটের জন্য জেলে যেতে হয় কাউকে।

জুবেরের মতো মানুষ এই দ্বিতীয় গোত্রে পড়েন। তাই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির সারবত্তাহীন অভিযোগের ভিত্তিতে হাতে হাতকড়া পড়ানো হয় তাঁর। মামলার ধরন দেখে মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য যে, শুধুমাত্র হেনস্থা করতে, ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে, রাজনৈতিক আক্রোশ মেটাতেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে কি না। কারণ গ্রেফতারির সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ এবং প্রশাসনের তরফে কার্যত লখিন্দরের বাসরঘর গড়ে তোলা হয়, যাতে কোনওভাবেই ছিদ্র গলে বেরিয়ে না যেতে পারেন অভিযুক্ত। তাই মন্ত্রবলে রাতারাতি এক ডজন মামলা তৈরি হয়ে যায়, যাতে এক মামলায় জামিন পেলেও, অন্য মামলায় জেলেই আটকে রাখা যায় অভিযুক্তকে। হাতে সময় নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিদেশি শক্তির সংযোগ, মোটা টাকা লেনদেনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় জনমানসে, যাতে সব কাটিয়ে বেরোতে বেরোতে জনতার আদালতে আপনাআপনিই দোষী সাব্যস্ত হয়ে যান অভিযুক্ত।

আরও পড়ুন: নুপুর বিতর্কের মাঝেই মহম্মদ জুবেরের গ্রেপ্তারি কোন বার্তা দিচ্ছে?

সম্প্রতি জিগনেশের ক্ষেত্রেও তা লক্ষ করা গিয়েছিল। এক মামলায় গ্রেফতার করে রাতারাতি গুজরাত থেকে অসম তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। তারপর সেই মামলায় জামিন পেলেও, নতুন একটি মামলা আচমকাই উড়ে এসে জুড়ে বসে। সেই দ্বিতীয় মামলার অজুহাত দেখিয়ে আটকে দেওয়া হয় জামিন। জুবেরের ক্ষেত্রেও একই রীতি লক্ষ করা যায়। প্রথমে ভুঁইফোড় সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডলের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর গ্রেফতারি। তার পর উত্তরপ্রদেশে দায়ের আরও ছয়টি মামলা দেখিয়ে হেফাজত চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। সব কাটিয়ে বেরোতে ২৪ দিন লেগে গেল জুবেরের। তবে এর মধ্যেই বিদেশি শক্তির সঙ্গে তাঁর সংযোগ, ৫০ লক্ষ টাকার লেনদেন জুড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর নামের সঙ্গে। অথচ যে ভুঁইফোড় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় জুবেরকে, তার আর অস্তিত্বই নেই নেটদুনিয়ায়। সেই ছায়ামূর্তির খোঁজ নেওয়ার কোনও গরজও দেখা যায়নি পুলিশের তরফে।

সবদিক খতিয়ে দেখে তাই আদালত পরিষ্কার জানিয়েছে, জুবেরকে গ্রেফতারের সপক্ষে কোনও ন্যায্য কারণই নেই। তাঁকে আটকে রেখে, একের পর এক আদালতে ছুটিয়ে বেড়ানো অযৌক্তিক। তাই উত্তরপ্রদেশের হাথরস, গাজিয়াবাদ, মুজফ্ফরনগর, লখিমপুর খেরি এবং সীতাপুরে দায়ের হওয়া ছ’টি মামলা থেকেও জুবেরকেও জামিন দিয়েছে আদালত। সেখান থেকে সমস্ত মামলা দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশের উদ্দেশে সাফ বার্তা আদালতের, “গ্রেফতারির ক্ষমতার অস্তিত্বকে গ্রেফতারির ক্ষমতা প্রয়োগের থেকে পৃথক রাখা উচিত। এক্ষেত্রে সংযমী হওয়া প্রয়োজন।” জুবেরের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশ সরকারের গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দলকেও বাতিল করেছে আদালত। চার বছর আগের ট্যুইটের জন্য ভবিষ্যতে এই ধরনের কোনও মামলায় জুবেরকে গ্রেফতারও করা যাবে না বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

খবরের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত বলে জুবেরের গ্রেফতারিতে অবধারিতভাবেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িয়ে, ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সরকারের আমলে বারবার তা পদদলিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েইছে। তাই জুবেরের গ্রেফতারি এবং জার্মানিতে বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সওয়াল, সরকারের দ্বিচারিতাকেই তুলে ধরে। সরকারি দাবি-দাওয়াকে বেদবাক্য বলে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে, সরকারকে প্রশ্ন করার ‘স্পর্ধা’ দেখাক সংবাদমাধ্যম, তা না-পসন্দ সরকারের। তাই জুবের যাতে আগামী দিনে ট্যুইট না করতে পারেন, আদালতের কাছ থেকে সেই নির্দেশ আদায় করতে চেয়েছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার।

কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত উত্তরপ্রদেশ সরকারের সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। আদালতের সাফ যুক্তি, “ওঁর ট্যুইট করা আটকাতে পারি না আমরা। ওঁর বাকস্বাধীনতার অধিকার খর্ব করার নির্দেশ দিতে পারি না। আইনজীবী তর্ক করতে পারবেন না বলার মতো ব্যাপার। সাংবাদিক লিখতে পারবেন না, এমন নির্দেশ কীভাবে দেওয়া সম্ভব!” যদিও উত্তরপ্রদেশ সরকার আদালতে জুবেরকে সাংবাদিক বলেই মানতে চায়নি।এর পর বন্ড জমা দিয়ে সন্ধেয় জেল থেকে বেরিয়ে আসেন জুবের। কিন্তু তাঁর এই ‘মুক্তি’ কতদিন স্থায়ী হবে, আগামী দিনে আরও কী কী অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে সংশয় কাটছে না। জুবের যদিও বা জামিন পেলেন, প্রায় দু’বছর ধরে জেলবন্দি উমর, শার্জিল ইমামদের ভবিতব্য কী, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। জুবেরের বাকস্বাধীনতা আদালতে বৈধতা পেয়েছে যেমন, উমরদের ‘সত্য’ কি গৃহীত হবে, সংশয় কাটে না।

 

More Articles