১৩৪৪ বছর আগে কী ঘটেছিল কারবালায়? মহরমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে ইতিহাস
Muharram 2023 Ashura: সুন্নি মুসলিমরা আশুরাকে ইজরায়েলিয়দের মুক্ত করে মিশরের ফারাওয়ের উপর মুসার বিজয় হিসাবেই চিহ্নিত করেন।
শোকের উৎসব! শোক কীভাবে উৎসব হতে পারে? পারে, যদি তাতে মিশে যায় সমচিন্তকদের অংশগ্রহণ। আনন্দের মতোই যদি ভাগ করে নেওয়া যায় শোক, তাহলেই তা সমবেত হয়ে মিশে যায় বিশ্বব্যাপী প্রার্থনায়। যেমন মিশে যাচ্ছে, মহরমের যন্ত্রণা। বিশ্বাসীদের ভাবনায় জেগে উঠছে সন্তান হারানো পরিবারের শোক, মিলিয়ে যাচ্ছে প্রার্থনার কান্নায়। মহরমের আশুরার এই দিনে সারা পৃথিবীতেই পালিত হচ্ছে শোকের উৎসব। 'মহরম' শব্দটি কিন্তু এসেছে 'হারাম' শব্দ থেকে, আরবি ভাষায় যার অর্থ নিষিদ্ধ। দশ নম্বর আরবি শব্দ থেকে উদ্ভূত ‘আশুরা’। বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে মহরমের এই দশম দিনটিতেই জেগে ওঠে সেই সমস্ত রক্তক্ষয়, শোক, কান্না ও যন্ত্রণার কাহিনিরা। শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে শোক হয়ে ওঠে আস্ত এক উৎসব। মহরমের এই দশম দিন, মানে আশুরার দিনে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ প্রার্থনা ও শোক জানাতে জড়ো হন মসজিদে মসজিদে। সমবেত শোকের ডালা উপচে পড়ে হজরত আলির পুত্র এবং নবী মহম্মদের নাতি ইমাম হুসেনের শাহাদাতকে ঘরে। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালার যুদ্ধের সময় শিরশ্ছেদ হয়েছিল এই ইমাম হুসেনের।
মহরম কেন পালিত হয়?
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, ইরাকে এককালে ইয়াজিদ নামের এক নিষ্ঠুর বাদশাহ ছিলেন। মানবতার শত্রু এই ইয়াজিদ। ইয়াজিদ নিজেকে খলিফা মনে করতেন ঠিকই কিন্তু আল্লাহর প্রতি তাঁর কোনও বিশ্বাস ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন হজরত ইমাম হুসেন তাঁর শিবিরেই যোগ দিন। ইমাম হুসেন মোটেও এতে রাজি হননি। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইমাম। ইমাম হুসেন তাঁর পরিবার, বন্ধুবান্ধবসহ শহিদ হন কারবালায়, এই মহরমের মাসেই। মহরমের মাসে তাই শিয়া মুসলমানরা শোক পালন করেন, নিজেদের সব খুশি ত্যাগ করেন। হুসেনের উদ্দেশ্য ছিল নিজে শহিদ হয়ে ইসলাম ও মানবতার রক্ষা করা। তাই মহরম আসলে অধর্মের উপরে ধর্মের জয়ের প্রতীক।
আরও পড়ুন- সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন এই মুসলিম মহিলা! কেমন ছিলেন মুঘল যুগের প্রভাবশালী নারীরা?
কারবালার যুদ্ধ
বর্তমানে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ১২০ কিমি দূরে অবস্থিত কারবালা। মক্কা-মদিনার পর কারবালাই মুসলিম ধর্মের সবচেয়ে প্রধান ধর্মীয় স্থান। ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে, হজরত ইমাম হুসেন তাঁর পরিবার ও সঙ্গীদের সঙ্গে মহরমের দ্বিতীয় দিনে কারবালায় পৌঁছেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছোট শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধরাও।

মহরমের দশম দিন সকালে ইমাম হুসেন নামাজ পড়েন। তখনই ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তির ছুঁড়তে শুরু করে। পরিবার ও সব বন্ধুরাই ইমাম হুসেনকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। ইমাম হুসেন ওভাবেই নামাজ পড়া শেষ করেন। কিন্তু মৃত্যু ওঁৎ পেতেছিল নিকটেই। দিন শেষ হওয়ার আগেই ইমাম হুসেনের ৭২ জন সঙ্গী শহিদ হন। এর মধ্যেই ছিল ইমাম হুসেনের ছয় মাসের সন্তান আলি আসগার ও ১৮ বছরের সন্তান আলি আকবর। যুদ্ধে ইমাম হুসেনের মাথা কেটে ফেলা হয়। বলা হয়, হুসেনের মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেও, দেহ ছিল সাজদার অবস্থাতেই। কারবালার যুদ্ধে হুসেনের ছেলে জয়নাল আবেদিন ছাড়া পুরো পরিবারই শহিদ হয়। জয়নাল আবেদিন অসুস্থ ছিলেন বলে তিনি যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি।
ইমাম হুসেন হলেন তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে তৃতীয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ইমাম। সেই কোন কালের কথা, অথচ প্রতিবছর শোককে নতুন করে গড়ে তোলেন বিশ্বের মুসলিমরা। সন্তানকে হারিয়ে হজরত আলি এবং তার পরিবারের যে যন্ত্রণা হয়েছিল, সেই কষ্ট খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে নেন সকলে। সকলেই হয়ে ওঠেন শোকের আত্মীয়। সমবেত আত্মীয়তাই হয়ে ওঠে উৎসব। শিয়া সম্প্রদায়ের অনেকেই এই শোকের প্রতীক হিসাবে কালো পোশাক পরেন, রাস্তায় নামেন মিছিল করে। বুকে হাত চাপড়ে শোকের ধ্বনি তোলেন। আর সুন্নিরা?
আরও পড়ুন- ইদ সবার উৎসব হোক, কেন চান না রাজনীতিবিদরাই?
সুন্নি মুসলিমরা শোকের এই প্রদর্শনে অংশ নেন না। তারা আশুরাকে ইজরায়েলিয়দের মুক্ত করে মিশরের ফারাওয়ের উপর মুসার বিজয় হিসাবেই চিহ্নিত করেন। তবে, যেহেতু ইমাম হুসেনের মৃত্যু সুন্নি মুসলিমদের জন্যও মর্মান্তিক ছিল, তাই তারা এই দিনে রোজা রাখেন। সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্তরা মহরম মাসে ১০ দিন পর্যন্ত রোজা রাখেন। কথিত আছে যে, মহরমের একদিন অর্থাৎ ৩০ দিন। যারা এই রোজার পথে হাঁটেন, তাদের বিশ্বাস, ঈশ্বর তাদের বিগত সমস্ত পাপ ক্ষমা করবেন। আশুরার মোট তিনটি রোজা রয়েছে- আশুরার দিন, আশুরার আগে এবং আশুরার পরে।
এবছর ১৭ জুলাই মহরম। এটি ইসলামিক বা হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস। ১২টি চান্দ্রমাসের উপর ভিত্তি করে এই নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি।

Whatsapp
