কালো জলের কুয়োর নিশির ডাক! দিল্লির এই প্রাচীন স্থাপত‍্য ঘিরে আজও দানা বাঁধে রহস্য

Agrasen ki Baoli: আধুনিকতার মোড়কের আড়ালে চুপিসারে দাঁড়িয়ে রয়েছে 'অগ্রসেন কি বাওলি' নামে এই ধাপ-কুয়ো।

রাজধানীর অভিজাত এলাকার উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর আড়ালে প্রায় লুকিয়ে রয়েছে একটি ধাপ-কুয়ো। কুয়োটি বহু পুরনো এবং সেটা কে তৈরি করেছিল, তা নিয়ে আজও মানুষের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। শোনা যায় যে, এককালে কুয়োটি স্বচ্ছ কালো জলে পূর্ণ ছিল। কালো জল শুনে আপাতভাবে অপরিষ্কার জল মনে হলেও তা সত্যি নয়। কুয়োর জলের রংটাই কালো ছিল, কিন্তু সেই জল বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের উপযোগী ছিল। যদিও মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া বহু গল্পে এই কুয়োর চরিত্র আসলে তার জলের রঙের মতোই কালো। সেইসব গল্প অনুযায়ী কুয়োর কালো জলে এবং তার আশপাশে এমন কিছু বসবাস করত, যা এই জগতের নয়। কুয়োর জল যেন মানুষের গল্পে পড়া নিশির ডাকের মতো একাকী সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করত। মানুষ সেই আকর্ষণ উপেক্ষা করতে না পেরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেত।

বর্তমানে সেই ধাপ-কুয়োতে কোনও জল নেই। কালো জলের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে মানুষের সেই গল্পকথা। বহু মানুষ প্রত্যহ এখানে ঘুরতে আসে। এই কুয়োর সিঁড়িতে বসে গল্প করে। বলিউডের সিনেমা, বিদেশি টিভি শো থেকে ফর্মুলা ওয়ান-এর ফোটোশুট অবধি নানা ক্ষেত্রে পর্দায় এই ধাপ-কুয়োকে দেখা গিয়েছে বহুবার। মানুষের কাছে এই ধাপ-কুয়ো অগ্রসেন কি বাওলি নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন: তিলোত্তমা কলকাতাকে নাকি বলা হত ‘ব্ল্যাক টাউন’! নেপথ্যে কোন কারণ

দিল্লি-র কনট প্লেসের নাম শুনলেই মানুষের মনে আসবে নামী-দামি ব্র্যান্ডের বিভিন্ন জিনিসের দোকান, ঝাঁ-চকচকে উঁচু উঁচু বাড়ি। যদিও এই আধুনিকতার মোড়কের আড়ালে চুপিসারে দাঁড়িয়ে রয়েছে 'অগ্রসেন কি বাওলি' নামে এই ধাপ-কুয়ো। 'বাওলি' শব্দ কিন্তু বাঙালির মুখে মুখে ঘোরা 'বাওয়ালি' শব্দের সঙ্গে কোনও ভাবেই যুক্ত নয়। বাওলি মানে ধাপ-কুয়ো। ধাপ-কুয়োর অস্তিত্ব সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই রয়েছে। ধাপ-কুয়ো আসলে এক ধরনের জলাধার, যার তিনদিক আবদ্ধ এবং একদিকে পরপর সিঁড়ি গভীর জলের মধ্যে নেমে গিয়েছে। যারা কোনও দিন ধাপ-কুয়ো দেখেনি, তাদের কাছে এই জলাধার অনেকটা পাতকুয়ো এবং বাঁধানো ঘাটযুক্ত পুকুরের মিশ্রণ মনে হতে পারে। যদিও এই ক্ষেত্রে সিঁড়ি ছাড়া বাকি তিনটে আবদ্ধ দিকের বিভিন্ন রকমের কারুকার্য এবং বসার জায়গা ওপরের প্রথম সিঁড়ি থেকে গভীর জলের মধ্যে অনেকটা অবধি বিস্তৃত রয়েছে। গভীরতার ক্ষেত্রে সাধারণ পুকুরের থেকে ধাপ-কুয়ো অনেক বেশি গভীর হয়। অগ্রসেন কি বাওলি নামে পরিচিত এই ধাপ-কুয়োতে একশোর বেশি সিঁড়ি রয়েছে। এই সংখ্যা থেকেই কুয়োর গভীরতা সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। যদিও ধাপ-কুয়োতে কখনওই ওপরের প্রথম সিঁড়ি থেকে জল থাকে না; বরং মোট সিঁড়ির প্রায় অর্ধেক অথবা তার বেশি কখনও কখনও জলের ওপরে থাকে। দিল্লি এবং সমগ্র উত্তর পশ্চিম ভারতে বহু ধাপ-কুয়ো দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত, এইসব এলাকায় বৃষ্টির অভাব দেখা দিলে জলের কষ্ট থেকে বাঁচতে এই ধাপ কুয়োগুলি তৈরি করা হয়েছিল।

অগ্রসেন কি বাওলি-র নামকরণের পিছনে প্রধানত দুটো কাহিনি রয়েছে। প্রথম কাহিনি অনুসারে মহাভারতের সময়কালে সূর্যবংশের রাজা অগ্রসেন (মতান্তরে উগ্রসেন) এই ধাপ-কুয়ো নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি অগ্র (মতান্তরে অগ্রহ) রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে চতুর্দশ শতাব্দীতে ওই এলাকায় বসবাসকারী আগরওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই ধাপ-কুয়োর পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। দ্বিতীয় কাহিনী অনুযায়ী চতুর্দশ শতাব্দীতে নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসকারী আগরওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষরাই এই কুয়োর নির্মাণ এবং দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ করেছিলেন। এই ধাপ-কুয়োর বর্তমান স্থাপত্যের সঙ্গে চতুর্দশ শতাব্দীর অন্যান্য স্থাপত্যের অনেক মিল পাওয়া যায়। যদিও অগ্রসেন আসলে মহাভারতের সময়কালের কোনও রাজা না কি আগরওয়াল সম্প্রদায়ের কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি, সেই নিয়ে আজও মতভেদ রয়ে গিয়েছে।

অগ্রসেন কি বাওলি নিয়ে মানুষের মধ্যে যেসব গল্প ছড়িয়ে পড়েছে, তার মধ্যে প্রায় সব গল্পই অশরীরী-সংক্রান্ত। বলা হয়, এই কুয়োর কালো জল একাকী মানুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করত। বহু মানুষ সেই আকর্ষণ উপেক্ষা না করে জলে ঝাঁপ দিত। জলে ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হতো এবং মৃত্যুর সংবাদ জানাতেই যেন সেই কালো জল লালচে কালো বর্ণ ধরে সিঁড়িতে ছড়িয়ে পড়ত। যদিও এই ঘটনার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন নথিপত্র ঘাঁটলে কেবলমাত্র একটি আত্মহত্যার ঘটনা জানা যায়। যদিও সেই আত্মহত্যার সঙ্গে কোনও অশরীরী যোগসাজশের কথা জানা যায় না। সেই কালো জল না-থাকার কারণে একদিকে যেমন কোনও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি, অন্যদিকে সেই জলের সঙ্গে কোনও অশরীরী যোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বহু মানুষ এই ধাপ-কুয়োতে ঘুরতে এসে বলেন যে, তাদের মনে হয়, কেউ তাদের পিছু নিয়েছে।

এই ধরনের ঘটনার খুব সহজ একটা কারণ থাকতে পারে। একশোর বেশি সিঁড়ি এবং আশপাশের ফাঁকা অথচ বদ্ধ প্রকোষ্ঠ থাকায় অনেক সময় মানুষের নিজের পায়ের আওয়াজের প্রতিধ্বনি হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় শান্ত পরিবেশে হঠাৎ পায়রার ডাক অথবা বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ এবং এই পরিস্থিতিতে ধাপ-কুয়োর অশরীরী সংক্রান্ত কোনও ঘটনা মনে এলে নিজের পিছনে কারও থাকার কথা মনে হতে পারে। যদিও বহু মানুষ রোজ সকাল ন'টা থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে এই ধাপ কুয়োতে ঘুরতে আসে এবং তাদের মধ্যে বহু মানুষ কোনওরকম ভয়াল অভিজ্ঞতা ছাড়াই এখানে সময় কাটাতে পারে। কুয়োর এই সিঁড়িগুলোতে বহু সিনেমার শুটিং হয়েছে। আমির খান, সুশান্ত সিং রাজপুত এবং অনুষ্কা শর্মা অভিনীত 'পিকে' সিনেমায় আমির খানের অভিনীত চরিত্রটি বলে যে, সে এই ধাপকুয়োতে রাতে থাকে। সলমন খান, রণদীপ হুডা, অনুষ্কা শর্মা-অভিনীত 'সুলতান' সিনেমায় একটি গানের দৃশ্যে সলমন খান এবং রণদীপ হুডার অভিনীত চরিত্রদু'টিকে এই কুয়োর সিঁড়িতে দেখা যায়।

মানুষের মধ্যে এই ধাপ-কুয়োর নামকরণ থেকে কুয়োর জলের মতো রহস্য ঘিরে বহু গল্প থাকলেও আর্কিওলজিক‍্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তত্ত্বাবধানে থাকা এই ধাপ-কুয়োর আকার থেকে স্থাপত্য মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

তথ্য ঋণ: দিল্লি ট্যুরিজম, থার্ড আই ট্রাভেলার

More Articles