ইন্দিরাকেও ফিরে যেতে হয়েছিল, কেন হিন্দু ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না জগন্নাথ মন্দিরে?
Puri Jagannath Temple: ১৯৮৪ সালে, সেবাইতরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেননি।
ফের প্রবল বিতর্কে পুরীর জগন্নাথ মন্দির। প্রাচীন কাল থেকেই এই মন্দিরে প্রবেশের, প্রার্থনা জানানোর একচেটিয়া অধিকার কেবল হিন্দুদের। সম্প্রতি ওড়িশার রাজ্যপাল গণেশি লাল জানিয়েছেন, পুরীর বিশ্ববিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরের ভেতরে বিদেশি নাগরিকদের প্রবেশকে সমর্থন করেন তিনি। আর এই মন্তব্যের জেরেই বহুযুগ ধরে চলা বিতর্কের আগুন ফের উসকে গিয়েছে।
ভূবনেশ্বরের উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যপাল গণেশি লাল বলেছেন, “যদি একজন বিদেশি গজপতি, সেবাইত এবং জগৎগুরু শঙ্করাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তবে তাকে জগন্নাথ দর্শনের সুযোগও দেওয়া উচিত। লোকজন এই কথা সমর্থন করবেন নাকি করবেন না জানি না তবে এটি আমার ব্যক্তিগত মতামত।” তবে বিদেশি নাগরিকদের কথা বললেও, দেশের হিন্দুধর্ম ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও, বিশেষত মুসলিম পর্যটকদের ক্ষেত্রেও একই মতামত কিনা তা স্পষ্ট হয়নি এই বক্তব্যে।
১২ শতকের প্রাচীন এই মন্দিরের সেবাইতরা এবং জগন্নাথ সংস্কৃতির গবেষকরা অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই এই পরামর্শের বিরোধিতা করেছেন। মন্দিরের ঐতিহ্য এবং অনুশীলন ভাঙার ঘোরতর বিরোধী তারা।
আরও পড়ুন- জগন্নাথের পুজোর জন্য নিজে থেকেই সরে গিয়েছিল সতীপীঠ! রহস্যে ভরা পুরীর বিমলা মন্দির
জগন্নাথ মন্দির চার ধামের মধ্যে অন্যতম (চার ধাম)। এখানে বিষ্ণুর একটি রূপ জগন্নাথ, তাঁর বড় ভাই বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রার সঙ্গে পূজিত হন। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে পুজো করার অনুমতি জোটে কেবল হিন্দুদের। মন্দিরের সিংহদুয়ারে স্পষ্টভাবেই বলে দেওয়া আছে, "কেবল হিন্দুদের অনুমতি দেওয়া হয়।"
কেন অহিন্দুদের প্রতি এই ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে এমন নিষেধাজ্ঞা? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বৈষম্যই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর কোনও সুস্পষ্ট কারণ বা ব্যাখ্যা নেই। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, অতীতে মুসলিম শাসকরা মন্দিরে একাধিক আক্রমণ চালিয়েছে। ফলে সেই ইতিহাস মাথায় রেখেই সেবকরা অহিন্দুদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অনেকে আবার বলেন মন্দির তৈরির সময় থেকেই এই প্রথা জারি ছিল।
জগন্নাথকে ভক্তরা পতিতপাবন নামেও ডাকেন, অর্থাৎ দুঃখী মানুষদের ত্রাণকর্তা। কিন্তু 'ভগবান' এখানে মানুষের রীতিকেই মান্যতা দেন। ভগবানও অহিন্দুদের দর্শন দেওয়ানোর মতো অলৌকিক কোনও ইঙ্গিত দেন না। তাই ধর্মীয় কারণে যাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ, তাঁদের সকলেই সিংহদুয়ার থেকে মনে মনে পতিতপাবনের দর্শন সেরে ফিরে যেতে হয়।
জগন্নাথ, অর্থাৎ এই জগতের নাথ, মহাবিশ্বের প্রভু, প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে নয় দিনের রথযাত্রার সময় ভাইবোনদের সঙ্গে বেরিয়ে আসেন প্রকাশ্য রাস্তায়। একমাত্র তখন অহিন্দুরাও জগন্নাথের দর্শন পান। জন্মস্থান গুণ্ডিচা মন্দিরে যাওয়ার সময় সারা বিশ্ব থেকে আগত ভক্তরা জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে এক ঝলক দেখার জন্য পুরীতে ভিড় জমান।
আরও পড়ুন- জগন্নাথের রথ এক ইসলাম সম্প্রদায়ের ভক্তের সমাধির সামনে এসে থামে আজও
১৯৮৪ সালে, সেবাইতরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেননি। কারণ দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন অ-হিন্দুকে বিয়ে করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নিকটস্থ রঘুনন্দন লাইব্রেরি থেকেই জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে থাইল্যান্ডের রাজকুমারী মহা চক্রী শ্রীনিধর্ন প্রথম ওড়িশা সফরে আসেন। তিনি বাইরে থেকেই মন্দিরটি দেখেন কারণ মন্দিরের ভিতরে বিদেশিদের প্রবেশের অনুমতি নেই। ২০০৬ সালে, সুইস নাগরিক এলিজাবেথ জিগলারকেও মন্দিরে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয় কারণ তিনি ধর্মে একজন খ্রিস্টান। যদিও এত কিছুর পরেও মন্দিরে এলিজাবেথ ১.৭৮ কোটি টাকা দান করেছিলেন।
২০১১ সালে, মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের উপদেষ্টা প্যারীমোহন মহাপাত্রের একটি প্রস্তাব দেন। তিন বলেন, ওডিশার পর্যটন সম্ভাবনাকে আরও বাড়ানোর জন্য মন্দিরে অ-হিন্দুদের প্রবেশ করার বিষয়টিতে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। রাজ্য জুড়ে বিশাল বিতর্কের জন্ম দেয় উপদেষ্টার এই প্রস্তাব। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে প্যারীমোহন মহাপাত্রকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হয় শেষ অবধি।