জগন্নাথের পুজোর জন্য নিজে থেকেই সরে গিয়েছিল সতীপীঠ! রহস্যে ভরা পুরীর বিমলা মন্দির

Puri Vimala Shaktipeeth: আমিষ ভোগ নিবেদন জগন্নাথের চোখের সামনে হয় না। জগন্নাথ মন্দির খোলার আগেই এই ভোগের সমস্ত উপাচার মিটে যাওয়াই রীতি।

উড়িষ্যা বা পুরীর কথা উঠলেই প্রথমেই মাথায় আসে জগন্নাথ দেবের কথা। এমন বাঙালি কমই আছেন যাঁরা একবার হলেও পুরী যাননি। পুরীকে এক কথায় বাঙালির সেকেন্ড হোম বলা হয়। পুরী বহু অপার্থিব লীলার এক পার্থিব স্থান। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি হিন্দুভক্তের এক এবং অদ্বিতীয় মোক্ষতীর্থ এই পুরী। বৈষ্ণবদের কাছে পুরীর মুখ্যমন্দিরে অধিষ্ঠিত জগন্নাথ স্বয়ং বিষ্ণু, শৈবদের কাছে জগন্নাথ আসলে শিবেরই রূপান্তর; আর শাক্তদের কাছে জগন্নাথ হলেন দেবী আদ্যাশক্তি বিমলার ভৈরব। জগন্নাথ মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যেই দেবী সতীর একান্নপীঠের অন্তর্গত দশতম পীঠটি রয়েছে। কিন্তু অনেকেই বিমলার এই মন্দির সম্পর্কে তেমনভাবে অবগত নন।

ইতিহাস

ইতিহাস অনুযায়ী, বিমলার আদিমূর্তিটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত। বর্তমান মন্দিরটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজত্বকালে আগের মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত হয়েছে। জগন্নাথ মন্দির চত্বরের মুক্তিমণ্ডপের কাছে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে নির্মিত যে নৃসিংহ মন্দিরটি আছে তার সঙ্গে বিমলা মন্দিরের স্থাপত্যগত মিল দেখা যায়। মাদলা পাঁজি অনুসারে, দক্ষিণ কোশলের সোমবংশী রাজবংশের রাজা যযাতি কেশরী এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজা প্রথম যযাতি (খ্রি. ৯২২-৯৫৫) ও দ্বিতীয় যযাতি (খ্রি. ১০২৫-১০৪০) উভয়েই ‘যযাতি কেশরী’ নামে পরিচিত ছিলেন। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী বিশেষত পার্শ্বদেবতাদের মূর্তি ও মূল মূর্তিটির পিছনের প্রস্তরখণ্ডটি সোমবংশী শৈলীর নিদর্শন বহন করে। এগুলি সম্ভবত সেই প্রথম মন্দিরের অংশ ছিল, যার ধ্বংসাবশেষের উপর বর্তমান মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। এই মন্দিরটিকে মন্দির চত্বরের প্রধান মন্দির অর্থাৎ জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও পুরনো বলে মনে করা হয়। মনে করা হয়, হিন্দু দার্শনিক ও সন্ত আদি শঙ্কর (খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী) বিমলাকে প্রধান দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পুরীতে গোবর্ধন মঠ স্থাপন করেছিলেন। প্রাচীনকালে জগন্নাথ মন্দির ছিল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব-এই ত্রিমূর্তি পুজোর কেন্দ্র। উক্ত তিন দেবতার শক্তি তথা হিন্দু দেবমণ্ডলীর তিন প্রধান দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতীও (বিমলার মূর্তিতে) এখানে পূজিত হতেন। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এখানে শাক্ত শ্রীবিদ্যা-উপাসকদের ভাল প্রভাব ছিল। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্ম এই মন্দির চত্বরে প্রাধান্য অর্জন করলে শ্রীবিদ্যা ও শৈব-তান্ত্রিক প্রভাব কমে যায়। তবে এই প্রভাব একেবারে লুপ্ত হয়নি।

কিংবদন্তি

কিংবদন্তি অনুযায়ী, জগন্নাথ মন্দিরের যে চৌহদ্দি এখন দেখা যায়, অতি প্রাচীনকালে সেই বিস্তৃত অংশ জুড়েই ছিল দেবী বিমলার পীঠ। শবর বিশ্বাবসুর অরণ্যগুহা থেকে নীলমাধবের ইচ্ছে হয়েছিল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের নগরে এসে অধিষ্ঠিত হওয়ার। রাজা এবং প্রজাসাধারণের পুজো পাওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল তাঁর মনে। সেই ইচ্ছে পূরণ করবার ভার পেয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন কৃতার্থ হন। বিদ্যাপতি নামের এক ব্রাহ্মণকে দিয়ে অনুসন্ধান করিয়ে নীলমাধবকে হরণ করিয়েছিলেন। তারপর নীলমাধবেরই ইচ্ছায় দারুমূর্তিতে তাঁর নবরূপ গড়েন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। সেই দারুমূর্তির নাম হয় ‘জগন্নাথ’৷ কিন্তু জগন্নাথ দেবের নগরের যে অংশে অধিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে তাঁকে অধিষ্ঠিত করতে গিয়ে রাজা পড়লেন মুশকিলে কারণ সেখানে অধিষ্ঠিত আছেন স্বয়ং দেবী বিমলা। তা এক সিদ্ধ সতীপীঠ। রাজা এরপর ধ্যানে বসে দেবীকে স্মরণ করলে দেবী রাজার সামনে আবির্ভূত হন। রাজা তাঁর মুশকিলের কথা জানালে দেবী হেসে বলেছিলেন, “স্বয়ং জগন্নাথ এখানে অধিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, এর চেয়ে আহ্লাদের কথা আর কী হতে পারে! আমি আমার পীঠমন্দির নিয়ে একপাশে সরে যাব, তুমি ধুমধাম করে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করো এখানে।” দেবী শর্ত দিয়েছিলেন, জগন্নাথের মন্দির প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ দেবকে যে ভোগ দেওয়া হবে তার উচ্ছিষ্ট যেন দেবীকে দেওয়া হয়। তাহলেই তিনি খুশি। শোনা যায়, রাজা দেবীর এই শর্তে রাজি হয়ে বলেছিলেন, “যতদিন এই মন্দির থাকবে ততদিন এই শর্তের অন্যথা হবে না।” তারপরই ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা। পীঠপ্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যে পবিত্র ‘রোহিণী কুণ্ড’ নামের জলাশয় রয়েছে, ঠিক তার পশ্চিম তীরে সতীপীঠসহ সরে গেল দেবীর মন্দির।

আরও পড়ুন- স্বয়ং জগন্নাথের লীলা না কি অন্য অলৌকিক— পুরীর মন্দিরে যে রহস্যের উত্তর পাওয়া যায়নি আজও 

গঠন

দেবী বিমলার মন্দির জগন্নাথ দেবের মন্দির চত্বরের ভিতরের দিকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং জগন্নাথের মিনারের পশ্চিম কোণের ডান দিকে অবস্থিত। এই মন্দিরের পাশে ‘রোহিণী কুণ্ড’ নামে একটি জলাধার রয়েছে। এটিকে হিন্দুরা পবিত্র মনে করেন। মন্দিরটি বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইটে নির্মিত। বিমলা মন্দির ‘দেউল’ স্থাপত্যশৈলীর একটি নিদর্শন। এই মন্দিরের চারটি অংশ দেখা যায়: বিমান (যে অংশে গর্ভগৃহ অবস্থিত), জগমোহন (সভাকক্ষ), নাট-মণ্ডপ (উৎসব কক্ষ) ও ভোগ-মণ্ডপ (ভোগ নিবেদনের কক্ষ)।

বিমানের মধ্যে ‘গর্ভগৃহ’ অংশটি রয়েছে। এই অংশের উপরিভাগ ‘পঞ্চরথ’ শৈলীতে নির্মিত। শীর্ষভাগ খাঁজবিশিষ্ট। বিমলার মূর্তি রাখা আছে কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে। এটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে নির্মিত একটি কক্ষ। এখানকার দেওয়ালে কোনও ছবি দেখা যায় না। পৌরাণিক কালে দেবী সতীর নাভিমণ্ডল বিষ্ণুর সুদর্শনের আঘাতে পতিত হয়েছিল এখানে। তারপর সেই নাভিমণ্ডল রূপান্তরিত হয়েছে শিলায়। কিন্তু দেবী পূজিতা হন মূর্তিতে। দেবীর গায়ের রঙ জোছনার মতো সাদা। সাদা ফুলের মালা, উজ্জ্বল সাদা বস্ত্রে তিনি সুসজ্জিতা। বিমলার কেন্দ্রীয় মূর্তিটির উপরের ডান হাতে একটি জপমালা এবং নিচের ডানহাতে বরদামুদ্রা; অন্যদিকে নিচের বাঁ হাতে একটি কুম্ভ (সম্ভবত অমৃতকুম্ভ) আছে। উপরের বাঁ হাতের বস্তুটি নিয়ে তীব্র মতভেদ আছে। এছাড়া একটি নারীমূর্তি, একটি নাগিনী, একটি মৎস্যকন্যা, একটি নাগ-পাশ ও অন্যান্য কয়েকটি বস্তু রয়েছে। বিমলার হাতে এমন কোনও অস্ত্র নেই যেগুলি সচরাচর দুর্গার হাতে দেখা যায়। মূর্তিটি একটি সিংহাসনে রাখা থাকে। মূর্তির দুই পাশে বিমলার দুই সখি জয়া ও বিজয়ার মূর্তি রয়েছে। দেবী পূর্বমুখে বসে রয়েছেন শবাসনে। মূর্তির উচ্চতা চার ফুটের মতো। দেবী পূজিতা হন তন্ত্রমতে। তাঁর এই পীঠে তাই তান্ত্রিকদের নিত্য আনাগোনা চলে চলে। চলে নিত্য সাধনা।

গর্ভগৃহের দরজাটি থেকে একটি সিঁড়ি উঠে যাচ্ছে জগমোহনে। এখানে বেদীর গায়ের ফ্রেমে অপ্সরা-পরিবেষ্টিত গজলক্ষ্মী-মূর্তি দেখা যায়। বেদীর উপরের ফ্রেমে নবগ্রহ অঙ্কিত আছে। দরজার দু’পাশের পাটাতনে পুঁথিচিত্র, লতাপাতা, ফুল ও ক্রীড়ারত বালকের ছবি দেখা যায়। দরজার ধারে দু’টি দ্বারপাল মূর্তি দেখা যায়।

ভোগ এবং উচ্ছিষ্ট মহাপ্রসাদ নিয়ে কাহিনি

ভোগ মণ্ডপে দেবীরই ইচ্ছানুসারে জগন্নাথকে নিবেদিত প্ৰসাদ নিবেদন করার প্রথা আজও বহমান রয়েছে। জগন্নাথের প্রসাদ তাঁকে নিবেদন করা হলে, তারপর তা ‘মহাপ্রসাদ’ হয়। দেবীর এই উচ্ছিষ্ট ভোগের পেছনেও আছে কাহিনি। কিংবদন্তি অনুযায়ী, একবার মহাদেব বৈকুণ্ঠ থেকে শ্রীবিষ্ণুর অন্নভোগ এনে নিজেই সবটা খেয়ে নিয়েছিলেন। এতে পার্বতী খুব দুঃখিত হন। কারণ তিনিও বিষ্ণুর প্রসাদ খেতে চেয়েছিলেন। বিষ্ণু সব জানার পর দেবীকে বর দেন, কলিযুগে দেবী বিমলা রূপে দেবী পার্বতী রোজই বিষ্ণু অর্থাৎ জগন্নাথ দেবের ভোগ পাবেন। কারণ বাকি সতীপীঠে মহাদেব দেবীর ভৈরব রূপে থাকলেও পুরীতে জগন্নাথরূপী বিষ্ণু দেবীর ভৈরব হবেন। এরপর থেকে তাই হয়ে আসছে।

এছাড়াও আলাদা করে দেবীকে ক্ষীর ও দই নিবেদন করা হয়। এই দু’টি নৈবেদ্য বিমলার পরমপ্রিয়। ভক্তদের বিশ্বাস, আরাধনায় তুষ্ট করতে পারলে দেবী ভক্তকে সম্পদ দান করেন, আয়ু বৃদ্ধি করেন। তবে সাধারণত জগন্নাথ মন্দিরে নিবেদিত নিরামিষ ভোগই দেবীকে নিবেদন করা হয়। ভোগে নারকেল বাটা, পনির ও মাখন সহ শুকনো ভাত দেওয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী, পুরীর গোবর্ধন মঠের পুরীর শঙ্করাচার্য গোবর্ধন মঠ ও জগন্নাথ মন্দিরের এক পাত্র মহাপ্রসাদ ও এক থালা খিচুড়ি পান।

আরও পড়ুন- উলঙ্গ হয়ে ষাঁড় ধরা, ঠোঁট কেটে চাকতি বসানো, অবাক করবে আফ্রিকার আদিবাসীদের যেসব রীতি

আবার অন্যদিকে, একান্ন সতীপীঠের অন্যতম প্রধান এই দেবী বিমলার মন্দির। এখানে তাই শাক্ত পীঠের নিয়ম মেনে মাছ মাংসের ভোগও নিবেদন করা হয় দেবীকে। বৈষ্ণব ক্ষেত্রের শ্রেষ্ঠ তীর্থের মধ্যে আমিষ ভোগ শুনে অবাক হওয়ারই কথা, তবে এই আমিষ ভোগ নিবেদন জগন্নাথের চোখের সামনে হয় না। জগন্নাথ মন্দির খোলার আগেই এই ভোগের সমস্ত উপাচার মিটে যাওয়াই রীতি। বলা হয়, নবরাত্রির সময় বিমলা পূজিতা হন উগ্র মহিষমর্দিনীরূপে। তাঁর ক্রোধ প্রশমিত করতেই এই কয়েক দিন তাঁকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। পবিত্র মার্কণ্ড কুণ্ডের মাছ দেওয়া হয় ভোগে। আর দুর্গাষ্টমী এবং দুর্গানবমীর দিন উৎসর্গ করা হয় একটি পুরুষ পশু। আগে মহিষ বলি দেওয়া হত, এখন মূলত ছাগল বলি দেওয়া হয়।

এই বলিদানেরও রয়েছে কিছু নিজস্ব প্রথা। বৈষ্ণব মন্দিরে বলির জন্য পশুটিকে সরাসরি নিয়ে আসা হয় না, তাতে বৈষ্ণব লোকাচার ক্ষুণ্ণ হবে বলে! তাই ভোররাত্রে মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে একটি ভারা বাঁধা হয়। সেই ভারায় উঠে বলির পশুটিকে নামিয়ে দেওয়া হয় মন্দিরের ভিতরে। অতঃপর, বলিদান! সেই বলিদানও সেরে ফেলতে হয় জগন্নাথের ঘুম থেকে ওঠার আগে। ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় জগন্নাথের গর্ভগৃহের দরজা, শুরু হয় প্রভাত আরতি। তার আগেই অন্ধকারে সম্পন্ন করতে হয় এই বলিদান প্রথা। শতাব্দী ধরে এই প্রথা চলছে। এভাবেই শাক্ত আর বৈষ্ণব মতের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে নীলাচলধামের দেবজীবন।

বিমলার মন্দিরটি জগন্নাথ দেবের মন্দির চত্বরের একটি ছোটো মন্দির হলেও শাক্ত ও তান্ত্রিকদের কাছে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ। তাঁরা মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও এই মন্দিরটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তান্ত্রিক মতে, বিমলা জগন্নাথের শক্তি এবং মন্দির চত্বরের রক্ষয়িত্রী। ভক্তরা মূল মন্দিরে জগন্নাথকে পুজো করার আগে বিমলার পুজো করেন। তন্ত্রগ্রন্থ কুব্জিকাতন্ত্র মতে, বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধি নামে একধরনের অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা যায় বলে তান্ত্রিকরা বিশ্বাস করেন।

 
 

More Articles