কালো বা নীল নয়! অবাক করবে বাংলার এই তিন অঞ্চলের সাদা কালীর কাহিনি
White Kali Puja 2022: মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ তামাক সেবনের ইচ্ছাও হয় দেবীর। তাই মন্দিরের এক কোণেই প্রস্তুত রাখা থাকে গড়গড়া।
সচরাচর কালী মূর্তি হয় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বা শ্যাম বর্ণের। পুরাণ মতে কালী হলেন মহামায়ার কালিকা শক্তিরূপ। অসুরদের অত্যাচারে যখন মানবকুল অতিষ্ঠ, চারিদিকে ধ্বংসের লীলা খেলা, তখন মহামায়া ভয়ঙ্কর ক্রোধ ধারণ করেন। সেই সময় তাঁর শরীর থেকে তীব্র জ্যোতি বের হতে থাকে। তখনই কালো রূপ ধারণ করেন মহামায়া, তাঁর সেই রূপকেই পুজো করা হয় কালী রূপে। সাধারণত কালীর যে মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় সেটি কালো রংয়ের বা গাঢ় নীল রঙের অর্থাৎ শ্যাম বর্ণের হয়। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বর্ণনা মতেও দেবীর গাত্রবর্ণ হওয়া উচিত কালো। এই কারণেই তাঁর এমন নামকরণ। কিন্তু কখনও শুনেছেন সাদা রঙের কালী প্রতিমার পুজোর কথা? আজ এমন তিনটি জায়গার খোঁজ রইল যেখানে পূজিত হন শ্বেত কালী।
কুলটির ফলহারিণী কালী
কুলটির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের লালবাজার এলাকায় ফলহারিণী কালীর রং শ্বেতশুভ্র বা সাদা। কালী এখানে শ্বেতশুভ্র রূপে পূজিত হন। ২০০৫ সাল থেকে এই পুজো শুরু করেন মধুময় ঘোষ। দেবীর প্রতিষ্ঠাতা এবং পুরোহিত মধুময় ঘোষ জানান, এই রূপে ভবতারিণী প্রথম দর্শন দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে। রামকৃষ্ণও স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজো শুরু করেছেন। মধুময় জানান, তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন এবং সেই আদেশ অনুসারেই পুজো করছেন। তিনি জানান, আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে কালী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন নিত্য পুজো করার জন্য। আর এই শ্বেতশুভ্র রূপের কথা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন কালী। এই নির্দেশ পাওয়ার পর মধুময় চলে যান বাঁকুড়ায়। সেখানে শুশুনিয়া পাহাড় থেকে এই পাথরের মূর্তি নিয়ে আসেন। তারপর থেকে নিয়মিত পুজো হয়ে চলেছে কুলটির ফলহারিণী কালীর।
মধুময় নিত্য পুজো করেন। তবে তাঁর পাশাপাশি গ্রামের মানুষও কালিকার সাধনায় মেতে ওঠেন। প্রত্যেক অমাবস্যায় জাঁকজমক সহকারে হয় পুজো। মধুময় জানান, আগে দেবীর মন্দির ছিল না। কিন্তু স্থানীয় মানুষদের সাহায্যে তিনি মন্দির তৈরি করতে পেরেছেন। প্রতি বছর কালীপুজোয় ধুমধাম করে পুজো হয় এখানে। স্থানীয় মানুষজনও সেই পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠাতার বাড়ির পাশেই এক চিলতে মন্দিরে পুজো হয়। এবছরও কুলটির ফলহারিণী কালী মন্দির দীপান্বিতা অমাবস্যা উপলক্ষ্যে সেজে উঠছে মহাসমারোহে। গোটা লালবাজার-সহ স্থানীয় এলাকার মানুষজন এখানে পুজো দিতে আসেন। তবে কালীপুজো ছাড়াও প্রত্যেক অমাবস্যায় বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয় এখানে। এছাড়াও বার্ষিক পুজোতেও মহা ধুমধাম করে পুজো হয় ফলহারিণী কালীর।
আরও পড়ুন- দশ মাথা, দশ পা! বিপ্লবীদের হাতে পূজিত হতেন মালদহের মহাকালী
অজয়পুরের দেবী শ্বেতকালী
বীরভূমের সদর শহর হল সিউড়ি। এই সিউড়ির থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি গ্রাম হল অজয়পুর। গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে ময়ূরাক্ষী নদী। ১৯৭৮ সালে হয়েছিল এক মারাত্মক প্লাবন। সেই প্লাবনে অজয়পুরের পার্শ্ববর্তী গোটা একটি গ্রাম ভেসে যায়। গ্রামটির নাম ছিল ব্রজরপুর। ভিটেমাটিহীন মানুষরা ব্রজরপুর ছেড়ে আশ্রয় নেন অজয়পুরে। সেই সময় গৃহহীনদের দলের সঙ্গে অজয়পুরে আসেন জ্বালাতন সাধু নামে এক সাধু। শোনা যায় তিনিই নাকি এই পুজোর সূচনা করেন। গাত্রবর্ণ ছাড়াও এই শ্বেত কালীর পুজোর তিথিও আলাদা। কার্তিক মাসের অমাবস্যা নয়, অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই কালীপুজো হয়।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, কেন এমন সিদ্ধান্ত? এর পিছনে জ্বালাতন সাধুর যুক্তি ছিল একদম সাফ। তাঁর মতে, অমাবস্যার রাতে অন্ধকারের মধ্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজো করা বেশ কষ্টসাধ্য। অন্ধকারে সঠিক নিয়ম রীতি মাফিক পুজো করাও কঠিন। সুতরাং পুজো করার শ্রেষ্ঠ সময় হল পূর্ণিমা। তাই জ্বালাতন সাধু পূর্ণিমা তিথিতে এই পুজোর প্রচলন করেন। এই সন্ন্যাসী সঙ্গে কোনও শিষ্য বা আত্মীয়কে আনেননি। ফলত শেষ জীবনে ঠিক করেন অজয়পুর গ্রামের কোনও একনিষ্ঠ ভক্তকেই পুজোর দায়িত্ব দিয়ে যাবেন। মৃত্যুর আগে সাধু এই পুজোর ভার দিয়ে যান অজয়পুরের হৃষিকেশ মাহারাকে। তার পর থেকে তাঁরই বংশধর এই পুজো করে আসছেন। বর্তমানে মহেশ্বর মাহারা এই পুজো করেন। নির্দিষ্ট তিথিতে পুজোর সময় এই গ্রামে ভিড় হয় উপচে পড়ার মতো। কালীপুজোর দিনেও মহাসমারোহে পুজো হয়। প্রতি অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমায় নব কলেবরে সেজে ওঠে এই গ্রাম।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের কালীমূর্তি চুরি হয়ে রাজস্থানের দুর্গে! যেভাবে পুজো হয় যশোরেশ্বরী কালীর
রাজবলহাটের দেবী রাজবল্লভী
হুগলি জেলার অন্তর্গত রাজবলহাটের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল দেবী রাজবল্লভীর মন্দির। ঐতিহাসিকদের মতে, এই রাজবল্লভী মন্দিরটি প্রায় আটশো বছর পুরনো। অবশ্য এই মন্দিরটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। অনেকে বলেন, ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রাজপুর এবং বর্তমানের রাজবলহাটের রাজা সদানন্দ রায় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার অপর পক্ষের মতে, ষোড়শ শতকে ভুড়িশ্রেষ্ঠর রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের দেবী রাজবল্লভী দেবী নামে পরিচিত। স্থানীয় পুরোহিতের মতে এটি আসলে দুর্গা, সরস্বতী এবং কালীর এক মিশ্ররূপ। তবে জনগণের মধ্যে দেবী রাজবল্লভী দেবী শ্বেতকালী নামেই বেশি পরিচিত।
মন্দিরের প্রবেশপথ পেরোলেই চোখে পড়বে এক বিরাট নাটমন্দির। এই নাটমন্দিরকে ঘিরে রয়েছে চারটি শিবমন্দির। নাটমন্দির পেরিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে শ্বেতকালীর মূর্তিটি। প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার দেবী মূর্তির পরণে রয়েছে স্থানীয় তাঁতিদের বোনা শাড়ি। ঢুকলেই দেখা যায় দেবীর এক হাতে রয়েছে ছুরি, আরেক হাতে রয়েছে পাত্র। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এখানে কালীর পায়ের নিচে একটি নয় বরং দু’টি শিব মূর্তি রাখা রয়েছে। কালীর ডান পা রয়েছে কালভৈরবের বুকের উপরে। আর বাম পা রাখা আছে বিরূপাক্ষ শিবের মাথার উপরে। কথিত আছে, এই মন্দিরে পঞ্চমুণ্ডির আসনের ওপর বসেই তন্ত্র সাধনা করতেন রাজবলহাটের রাজা সদানন্দ রায়। রাজবল্লভী দেবীর স্বভাবও কিন্তু রাজকীয়। শোনা যায়, তিনি প্রতি রাত্রে কাঠের পালঙ্কে নিদ্রা যান। মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ তামাক সেবনের ইচ্ছাও হয় দেবীর। তাই মন্দিরের এক কোণেই প্রস্তুত রাখা থাকে গড়গড়া। তবে ভোগের ক্ষেত্রে কালী সিদ্ধ ভোগই বেশি পছন্দ করেন। সারা বছর ভিড় থাকলেও, প্রতি বছর কালীপুজোর সময় ভিড় হয় লাগাম ছাড়া। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন দেবী রাজবল্লভীর দর্শন করতে।