নেপালে পূজিত সতীর 'যোনি' নিঃসৃত তরল! বৌদ্ধদের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ গুহ্যেশ্বরী শক্তিপীঠ
Guhyeshwari Temple: এই মন্দিরে দেবীর বেদীর নীচে যে জলধারা বয় তাকেই বৌদ্ধরা বারাহীর যোনি নিঃসৃত তরল বা গর্ভতরল বলে মনে করে থাকেন।
নেপালের কাঠমান্ডুর কথা উঠলেই সকলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুরম্য বাগমতী নদীর তীরে অবস্থিত পশুপতিনাথ মন্দিরের কথা। এখানে এসে শিবের অতি মনোরম আরতি দর্শন করেননি এমন ভক্ত বিরল। কিন্তু অনেকেই খবর রাখেন না, এখানেই রয়েছে সতীর অষ্টম পীঠ। দেওঘরের সতীপীঠ যেমন ভৈরব বৈদ্যনাথের জন্য জনপ্রিয় ঠিক তেমনই কাঠমান্ডুর এই পীঠভূমিও ভৈরব পশুপতির নামে বিখ্যাত। সতীর পীঠ ভৈরবের মহিমায় কিছুটা উপেক্ষিত হলেও তার মাহাত্ম্য কিন্তু কোনও অংশে কম নয়। তান্ত্রিক এবং সাধকদের কাছে এই পীঠ আকর্ষণের কেন্দ্র।
সতী দক্ষ রাজার অমতে মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন দক্ষ রাজা। যজ্ঞের আগুনে আত্মঘাতী হন সতী। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন মহাদেব। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ভয়ে ভগবান বিষ্ণু প্রলয় থামাতে সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে দেন। সতীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে। এই সব ক’টি জায়গাকে সতীপীঠ বলা হয়। সতীর ৫১ পীঠের মধ্যে অন্যতম হল সতীপীঠ গুহ্যেশ্বরী। জানা যায়, এখানে দেবীর দু’টি হাঁটু পড়েছিল। আবার, শিবচরিত মতে এখানে সতীর দক্ষিণ জঙ্ঘা পতিত হয়েছিল। সতীর নাম মহাশিরা, ভৈরবের নাম কপালী। এই দেবীর ভৈরব হিসাবে পশুপতিনাথের কথাও বলা হয়।
অন্নদামঙ্গল কাব্যে এই পীঠ সম্বন্ধে বলা হয় –
“নেপালে পড়িল জঙ্ঘা কপালী ভৈরব।
দেবী তার মহামায়া সদা মহোৎসব।।”
দেবী ভাগবত পুরাণে বলা হয় –
“গুহ্যকাল্যা মহাস্থান নেপালে যৎ প্রতিষ্ঠিতম।”
এটি আদিশক্তি বা মহাশক্তির মন্দির। কথিত আছে, গুহ্যেশ্বরী মন্দিরটি পশুপতিনাথ মন্দিরের শক্তি। মন্দিরের দেবী গুহ্যকালী নামেও পরিচিতা। এটিই গুহ্যেশ্বরী দেবীর প্রধান মন্দির।
নামের অর্থ ও উৎপত্তি
গুহ্যেশ্বরী মন্দিরের নামের উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে অনেকে মনে করেন, ‘গুহ্য’ শব্দের অর্থ হল গুহা আর ‘ঈশ্বরী’ হলেন স্বয়ং দেবী। অনেকেই আবার ‘গুহা’কে যোনির সঙ্গে এক করে দেখতে চান। কিন্তু সেই ধারণা ভ্রান্ত। সতীর যোনি পতিত হয়েছিল কামরূপ-কামাখ্যা সতীপীঠে। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের ‘ললিতাসহস্রনাম’ অধ্যায়ে ললিতার সহস্র রূপের মধ্যে সাতশো সাততম রূপটি হল গুহ্যরূপিণী। অনেকে আবার মনে করেন, ষোড়শী দেবীর মন্ত্রের যে ষোলোটি অক্ষর তা থেকেই এই গুহ্যরূপিণী নামের উৎপত্তি হয়েছে। নেওয়ারি বজ্রযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে এই মন্দিরের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের সময় এখানেই নেওয়ারি ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। নেওয়ার বজ্রযানী বৌদ্ধরা এই গুহ্যেশ্বরী দেবীকে বজ্রযোগিনী রূপে পুজো করে থাকেন। বজ্রযোগিনী আসলে বজ্রবারাহীর এক বিশেষ অবস্থা যা কিনা কিংবদন্তী উপকথার সেই পবিত্র পদ্মকে সূচিত করে। এই পদ্মের উপরেই স্বয়ম্ভুনাথ বিশ্রাম নেন। বৌদ্ধদের কাছে এই মন্দির কাঠমান্ডুর নাভিকুণ্ড এবং ‘বজ্রবারাহী’ কথার অর্থ হল বারাহীর গর্ভতরল। এই মন্দিরে দেবীর বেদীর নীচে যে জলধারা বয় তাকেই বৌদ্ধরা বারাহীর যোনি নিঃসৃত তরল বা গর্ভতরল বলে মনে করে থাকেন। তাই এই সতীপীঠ হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়ের কাছেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন- কালীর মূর্তি নেই, বীজমন্ত্রে পূজিত হন দেবী || বর্ধমানের এই শক্তিপীঠে পড়েছিল সতীর বাম বাহু
ইতিহাস এবং লোককথা
কিংবদন্তি অনুসারে কাহিনির শুরু মাড়োয়ার দেশে। সেই দেশ ছিল রাজা সুদন্তের রাজ্য। তাঁর শাসনে প্রজারা বেশ সুখেই বাস করত। কিন্তু রাজা সুদন্তের মনে কোনও সুখ ছিল না। কোনও কারণে রানি পিঙ্গলার সতীত্বের ওপর তাঁর অহেতুক অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। সেই অবিশ্বাসের আগুনে দিনরাত জ্বলতে জ্বলতে তিনি একসময় অপমান করে পিঙ্গলাকে অন্তঃপুর থেকে তো বটেই রাজ্য থেকেও দূর করে দিলেন। অভিমানে রানি যেদিকে দু’চোখ যায় হাঁটতে লাগলেন। শেষে একদিন পৌঁছে গেলেন নেপাল প্রদেশে।
পিঙ্গলা রাজকন্যা ছিলেন তাই তার চরিত্রের প্রতি মিথ্যে সন্দেহে সকলের সামনে যেভাবে অপমান করে রাজা তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন, তা তাঁকে অত্যন্ত আঘাত করেছিল। তাতেই তাঁর নিজেকে বড় একা বলে মনে হয়েছিল। আশ্রয় নিয়েছিলেন ইষ্টদেবী শক্তির চরণে। রাজার ঘরণী পিঙ্গলা এক বস্ত্রে পায়ে হেঁটে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে যেভাবে তাঁকে সর্বদা স্মরণ করেছেন, তাতেই পেয়েছিলেন তপস্যার ফল। দেবী তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দিলেন স্বপ্নে। বললেন, “নিকটেই বাগমতী নদীতীরে আমার গুপ্তথান রয়েছে, তুই তা অনুসন্ধান করে আমার পুজো করবি। তাতে আবার স্বামীসোহাগ ফিরে পাবি। মনে রাখবি, আমি সেখানে সতীর দেহাংশে গুহ্যেশ্বরীরূপে বিরাজ করছি।”
স্বপ্ন ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসলেন পিঙ্গলা। আর স্থির থাকতে পারলেন না। দেবী তাঁকে আদেশ দিয়েছেন! শুরু করলেন বাগমতী নদীর সন্ধান। পাহাড়-অরণ্যে খুঁজতে খুঁজতে এক সময় খুঁজে পেলেন নদী। তার পাড় ঘিরেই শুরু করলেন ভগবতীর অনুসন্ধান। কিন্তু কোথায় সে পীঠ! দেবী তো তাঁকে সেই পীঠস্থান খুঁজে পাবার মতো কোনও চিহ্নের কথা বলে দেননি। কিন্তু এই সংশয়ের মাঝেও দেবীর প্রতি অচলা ভক্তিতে পিঙ্গলা ভাবলেন, দেবী যখন ভার দিয়েছেন, তখন নিশ্চয় উদ্ধার তিনিই করবেন, হলও তাই। বাংলার রামপ্রসাদকে দেবী বেড়া বাঁধতে সাহায্য করেছিলেন; মাড়োয়ারি রানি পিঙ্গলাকে তিনি পীঠ খুঁজে দিতে এগিয়ে এলেন।
চারিদিক অনুসন্ধান করতে করতে এক সময় হঠাৎ পিঙ্গলা দেখলেন এক কৃষ্ণকায় নিরাবরণা দৈবী কুমারী আলোর দ্যুতির মতো আবির্ভূতা হয়েই নিকটের ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পিঙ্গলা ভক্তিমতী বুদ্ধিমতী নারী। তিনি ইশারা বুঝলেন। ভক্তের আকুতি নিয়ে পৌঁছে গেলেন অদৃশ্য হওয়ার স্থানটিতে। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতেই দেখতে পেলেন পাথরের বুকে নারীদেহের জন্মদ্বারের মতো দেখতে এক গর্ত। তাতে ভরে আছে জল। পিঙ্গলা বুঝতে পারলেন ‘গুহ্যেশ্বরী’ কথার অর্থ। ‘গুহ্য’ কথার অর্থ, ‘যোনি’। আর সেই রূপে অধিষ্ঠাত্রী দেবীই হলেন ‘গুহ্যেশ্বরী। পিঙ্গলা গর্তের জল ভক্তিভরে মাথায় নিয়ে বুনো ফুল দিয়ে যথাবিহিত পুজো করলেন দেবীর। তারপর দেবীর থানই হয়ে উঠল পিঙ্গলার বাসস্থান; দেবী তাঁর হাতেই পেতে লাগলেন নিত্য পুজো।
অন্যদিকে ধীরে ধীরে রাজা সুদন্তের মনে ভাবান্তর ঘটতে লাগল। দেবীর কৃপায় তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনি রানির সঙ্গে বড় অন্যায় করেছেন। এও বুঝতে পারলেন যে, পিঙ্গলা সত্যিই নির্দোষ। এই সময় দেবী রাজার সহায় হলেন। স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলে দিলেন রানির ঠিকানা। সকালেই রাজা পিঙ্গলার খোঁজে পাড়ি দিলেন। অবশেষে তিনি বাগমতী নদীর তীরে গুহ্যেশ্বরীর থানে এসে খুঁজে পেলেন পিঙ্গলাকে। দু’জন দু’জনকে পেয়ে আনন্দে অধীর হলেন। পাড়ি দিলেন রাজধানীর উদ্দেশ্যে। তবে ফেরার আগে দেবীর থানটি সুরম্য বেদিতে বাঁধিয়ে দিয়ে গেলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দেবীর কৃপা, দেবীর পরশ আর শিলাগর্তের পবিত্র জল। তারপর কত কত কাল কেটে গেল। সুদন্তের বাঁধানো বেদি নষ্ট হয়ে গেল। দেবীর থান আবারও ভরে উঠল বন্য গাছগাছালিতে। কালের পরতে ঢাকা পড়ে গেল জাগ্রত পীঠভূমি।
সময়টা সতেরো শতক। তখন নেপালের রাজা প্রতাপমল্ল। এক তান্ত্রিক এই সময় ঘুরতে ঘুরতে নেপালে এসে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেন। রাজা তান্ত্রিকের দৈবীগুণের পরিচয় পেয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তান্ত্রিক রাজার আতিথ্যে থাকতে থাকতেই এক সময় অনুভব করতে শুরু করেন যে, এই ভূমিতে দেবী শক্তি জাগ্রতা হয়ে রয়েছেন। রয়েছেন ভক্তের পুজো পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। ধ্যানস্থ হয়ে তিনি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে রাজাকে জানালেন এই কথা। জানালেন যে, দেবী বাগমতী তীরেই গুপ্তপীঠে অবস্থান করছেন। ভক্ত তাঁকে অনুসন্ধান করে পুজো করবেন, এই তাঁর ইচ্ছা। একথা শুনে রাজা সদলে শুরু করলেন দেবীপীঠের অনুসন্ধান, খুঁজেও পেলেন দেবীর গুপ্তপীঠ।
আরও পড়ুন- জগন্নাথের পুজোর জন্য নিজে থেকেই সরে গিয়েছিল সতীপীঠ! রহস্যে ভরা পুরীর বিমলা মন্দির
মন্দিরের গঠন এবং মূর্তির বিশেষত্ব
রাজা প্রতাপমল্ল বনের মধ্যে গুপ্তপীঠ খুঁজে পেয়ে চারিদিক পরিষ্কার করে তান্ত্রিক যন্ত্রের আকারে দেবীর জন্য সেখানে তিনকোণা এক মন্দির নির্মাণ করে দিলেন। সিংহসহ মন্দিরে দেবীর প্রতীক এক শিলামূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। এই মূর্তিতে দেবী বিশ্বরূপীণী ও সহস্রবাহু। রাজা মন্দিরের মাথায় স্থাপন করালেন চারটি পেতলের সর্পমূর্তি। এই মূর্তিগুলিও তান্ত্রিক আচারের প্রতীক। নানান কারুকার্যে শোভিত করলেন মন্দিরের গা। আর আদি যে যোনিশিলা, তাকে বাঁধিয়ে দিলেন চার কোণা এক চাতালে। যোনিশিলার মুখ ঢেকে দিলেন ধাতুময় এক পর্দায়। পর্দা সরিয়ে সঞ্চিত জল মাথায় নিয়ে দেবীর আশীর্বাদ গ্রহণের চল শুরু হল। শুরু হল নিত্য পুজোর পরিসর।
বাগমতী নদীর তীরে আর্যঘাট মহাশ্মশান। অপর পাড়ে গুহ্যেশ্বরী মন্দির। পশুপতি মন্দির থেকে গুহ্যেশ্বরী দেবীর মন্দির পর্যন্ত সুন্দর রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন নেপালের রাজা পৃথ্বীনারায়ণের পুত্র জংবাহাদুর। মন্দিরের মাথায় শোভা পাচ্ছে ৪ টি পিতলের সর্প মূর্তি। সর্প কুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক। নেপালে যেহেতু তান্ত্রিক সাধনা হয় তাই এখানে সাপকে পুজো করা হয়। মন্দিরটি ত্রিকোণ যন্ত্র আকারে নির্মিত। চার কোণা চাতালের মাঝে দেবীর পীঠ বা আসন।
এখানে দেবীর কোনও বিগ্রহ নেই, সোনার বড় পরাতের সঙ্গে যুক্ত একটা কলসীই দেবীর প্রতীক, সকলে এই কলসীতে নৈবেদ্য অর্পণ করেন, কলসীর নীচে জলভরা গর্ত আছে। শোনা যায়, সেটি নাকি পাতাল পর্যন্ত চলে গেছে, এই জলই দেবীর নিরাকার রূপ। তন্ত্রশক্তি লাভের জন্য এই মন্দিরটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে কালীতন্ত্র, চণ্ডীতন্ত্র ও শিবতন্ত্র রহস্য গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। গুহ্যেশ্বরী দেবীর বিশ্বরূপ মূর্তিতে তাঁকে বিভিন্ন বর্ণের একাধিক মুখমণ্ডলবিশিষ্ট রূপে দেখা যায়। দেবীর হাতের সংখ্যা অসংখ্য। দেবীর মূর্তি নেই, সতী অংশ সোনায় ঢাকা। পবিত্র কুণ্ডের জল স্পর্শ করে মাথায় দেওয়া নিয়ম। পুরোহিতকে বললে তিনি সোনার আবরণ উন্মোচন করে দেবীর পীঠ দেখান।
রাতের অন্ধকারে এই শ্মশানে নানান প্রকার তান্ত্রিক সাধনা হয়। বহু অলৌকিক ঘটনাও শুনতে পাওয়া যায় দেবীর পীঠ সম্বন্ধে। এখানে ১২ বছরের কুমারী বালিকাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেবী রূপে তান্ত্রিক ও গুপ্তপুজো করা হয়। কালী বসন হীনা কারণ তিনি কোনও কিছুর বন্ধনে আবদ্ধ নন। তিনি দেশ কালের ঊর্ধ্বে। আবার বসনকে কামনা বাসনার প্রতীক রূপেও কিছু পণ্ডিত গণ্য করেন। নবরাত্রির শেষ দিনে এই গুপ্তপুজো হয়। বালিকা কন্যা হল আদ্যাশক্তির রূপ।