অত্যাচারীদের যম, গরিবের ভগবান || বাংলার এই ডাকাতকে নিয়ে প্রচলিত যে কিংবদন্তি

অত্যাচারী জমিদার-মহাজনদের ত্রাস হয়ে ওঠে রঘু। শুধু নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়াই নয়, ছোটবড় যে-কোনও শোষণযন্ত্রের কাছেই রঘু ডাকাত ছিল মূর্তিমান যম।

হাতে লাঠি, মাথায় ঝাকড়া চুল
কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার!
এক পা আগে আসিস যদি আর-
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার...

একটা সময় রাত নামলেই বাংলার আনাচকানাচে নেমে আসত ডাকাতের ভয়। ডাকাতদের এরকম চেহারার বর্ণনা পাওয়া যায় কাব্যে-সাহিত্যে। সেকালের ডাকাতদের বেশ একটা নায়কোচিত ব্যাপার ছিল। বাড়ির গৃহকর্তাকে আগাম চিঠি পাঠিয়ে, নরবলি দিয়ে, কালীপুজো করে, মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে, কপালে রক্তবর্ণের তিলক এঁকে, রণপা চড়ে, সদলবলে ডাকাতি করতে আসত তারা।

দেড়শো-দুশো বছর আগের কথা। সেই যুগে বাংলার বেশিরভাগ এলাকা ছিল বন-জঙ্গলে ঘেরা। বন্য পশুর ভয় যেমন ছিল, তেমনই ছিল ডাকাতের ভয়। দস্তুরমতো নামকরা, দাপুটে ডাকাতরা ছিল সেই আমলে। তাদের ভয়ে যে সাধারণ মানুষ ভীত হয়ে থাকতেন তা নয়, ব্রিটিশ সরকার রীতিমতো অস্থির হয়ে থাকতেন ডাকাতির উপদ্রবে। বাংলা সাহিত্যে এ-বিষয়ে দু'টি বিখ্যাত বই আছে। দু'টি বইয়ের নামই 'বাংলার ডাকাত’। একটির লেখক খগেন্দ্রনাথ মিত্র। অপরটির লেখক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত।

আরও পড়ুন: সিঙ্গুরের ডাকাত কালী, ৫৫০ বছর পেরিয়ে আজও জেগে আছে ভয়াল এক ইতিহাস

বাংলার বিখ্যাত (না কি কুখ্যাত!) ডাকাতরা কিংবদন্তি হয়ে আছে। ডাকাতকুলে সবচেয়ে বেশি আলোচিত, নিন্দিত এবং নন্দিত 'রঘু ডাকাত’। তাঁকে নিয়ে বাংলার জনমানসে অসংখ্য মিথ। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রঘু ওরফে রোঘো ডাকাত সম্পর্কে লিখছেন, "রঘু ডাকাতের নামে লোকে এক সময়ে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাইত। রঘু ডাকাতের বাড়ি কোথায় ছিল, কেহ ঠিক করিয়া বলিতে পারিত না। কেহ বলিত নদীয়া জেলায়, কেহ বলিত হুগলী, কেহ বলিত চন্দননগর।… রঘুর এভাবে থাকিবার প্রধান কারণ ছিল ধরা পড়িবার ভয়।… গভর্নমেন্ট সে-সময়ে রঘু ডাকাতকে ধরিবার জন্য অনেক টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন।”

গল্পগাছা
কথিত আছে, প্রায় ৫০০ বছর আগে বাগহাটির জয়পুরের বাসিন্দা বিধুভূষণ ঘোষ ও তার ভাই রঘু ঘোষ ঘন জঙ্গলের মধ্যে হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের মায়ের মূর্তি স্থাপন করে। দিনের বেলায় দুই ভাই দিনমজুরের কাজ করলেও রাতে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়িতে ডাকাতি করত। ডাকাতি করে আনা জিনিসপত্র এলাকার গরিব মানুষের মধ্যে বিলি করত। কিংবদন্তি আছে, কারও বাড়িতে ডাকাতি করার আগে রঘু ডাকাত চিঠি দিয়ে বাড়ির গৃহকর্তাকে জানিয়ে দিত। সন্ধের পর পুরোহিতকে ডেকে এনে ঢাকঢোল বাজিয়ে নরবলি ও ল্যাটা মাছের পুজো দিত। তারপর মহাপ্রসাদ খেয়ে ডাকাতি করতে বের হত।

ডাকাত দলের ভয়ে দুপুরের পর থেকে রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করত না। শোনা যায়, সাধক কবি রামপ্রসাদ কোনও এক সময়ে এই রাস্তা ধরে ত্রিবেণী ফেরিঘাটে ফিরছিলেন। ওই সময়ে রঘু ডাকাতের দলবল তাঁকে নরবলি দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে এসে বেঁধে রাখে। রাতে রামপ্রসাদকে বলি দেওয়ার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সেরে ফেলার পর ঘটে অদ্ভুত ঘটনা। বলি দেওয়ার আগের মুহূর্তে রামপ্রসাদ মাকে একটি গান শোনানোর আর্জি করেন। সেই আর্জি মেনে রঘু ডাকাত গান শোনানোর অনুমতি দিলে রামপ্রসাদ ‘তিলেক দাঁড়া ওরে শমন বদন ভরে মাকে ডাকি’ বলে একটি গান ধরেন। তারপরেই রঘু ডাকাত বলির হাঁড়িকাঠে রামপ্রসাদের পরিবর্তে মাকে দেখতে পান। এরপর থেকে রঘু ডাকাত বলি বন্ধ করে রামপ্রসাদের সেবার ব্যবস্থা করে। শুধু তাই নয়, পরের দিন সকালে নৌকোয় করে রামপ্রসাদকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে।

লোকমুখে কথিত আছে, রঘু ডাকাত ও তার দলবল কোনও দিন ডাকাতি করতে গিয়ে মহিলাদের ওপর কখনও অত্যাচার করত না। মা সম্বোধন করে গায়ের গয়না ও অলংকার খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করত। ডাকাতি করে আনা জিনিসপত্র গরিব মানুষকে বিলিয়ে দিত বলে এলাকার মানুষের কাছে রঘু ডাকাত ভগবানের মতো ছিল।

বাংলার রবিনহুড
অত্যাচারী রাজা আর সামন্তপ্রভুদের সর্বস্ব কেড়ে দরিদ্র ভিখিরিদের বিলিয়ে দেওয়াই ছিল ডাকাত রবিনহুডের নেশা। কিন্তু জানেন কী, এই বাংলাদেশের বুকেও একদা দাপিয়ে বেড়াত আর এক 'রবিনহুড'। মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে লুঠতরাজ নয়, দিনে-দুপুরেও তার হা-রে-রে-রে ডাক শুনে ভয়ে রক্ত হিম হয়ে যেত বড়লোক জমিদার আর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের। ডাকাতি, খুনজখম তো ছিলই, তার পাশাপাশি তিথি মেনে আরাধ্যা দেবীর সামনে নরবলিও চড়াতেন তিনি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার-মহাজনরা তার সামনে দাঁড়িয়ে বলির পাঁঠার মতো ঠকঠক করে কাঁপতেন। বাংলার সেই কিংবদন্তি দস্যুসর্দার রঘু ডাকাত।

ঝাঁকড়া চুল, মাথায় লাল ফেট্টি, কপালে ইয়া তিলক, রক্তজবার মতো চোখ- দল বেঁধে হা-রে-রে-রে করে গৃহস্থের বাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে যে ‘গ্ল্যামার’ অনেক বেশি, সেকথা অস্বীকার করা যাবে না। রঘু ডাকাত বাংলার সেই ‘টিপিক্যাল’ ডাকাতদের এক চূড়ান্ত প্রতিনিধি।

নীলকর সাহেবদের ত্রাস
শোনা যায়, রঘু ডাকাতের বাবাও ছিলেন একজন সাধারণ চাষি। নীল চাষে রাজি না হওয়ায় নীলকরের পেয়াদা এক রাতে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। সাহেবকুঠিতে ভয়ংকর অত্যাচারে অসহায়ভাবে মারা যান রঘুর বাবা।

বাবার এই নির্যাতন আর অন্যায় মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি তরুণ রঘু। এই হত্যার বদলা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ছেলেবেলা থেকেই লাঠিখেলায় বেশ পোক্ত ছিলেন রঘু। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের সামনে সেই লাঠিকেই অস্ত্র হিসেবে তুলে নিলেন তিনি। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল একরোখা আরও একদল মানুষ। গড়ে উঠল লাঠিয়াল-বাহিনী। যাদের প্রথম কাজই ছিল, নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।

দলবল নিয়ে একের পর এক নীলকুঠিতে চড়াও হয় রঘু ঘোষ। লুটপাট চালায়, জ্বালিয়ে দেয় নীলকরদের ঘরবাড়ি। ধীরে ধীরে এলাকার অত্যাচারী জমিদার-মহাজনদের ত্রাস হয়ে ওঠে রঘু। শুধু নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়াই নয়, ছোটবড় যে-কোনও শোষণযন্ত্রের কাছেই রঘু ডাকাত ছিল মূর্তিমান যম। তাই আজও রঘু ডাকাত মানেই সেই আমলের বাংলার শাসকের যম, শোষিতের রোবিনহুড। তাকে নিয়ে বাংলায় নির্মিত হচ্ছে একটি সিনেমাও। তারকা দেব থাকছেন নামভূমিকায়, পরিচালনায় ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। সব ঠিক থাকলে এই বছরের দুর্গাপুজোর সময় মুক্তি পাবে এই ছবি।

More Articles