দেবতাদের যৌনতা নাকি অন্য রহস্য! খাজুরাহোর মূর্তি আসলে কীসের প্রতীক?
Khajuraho Temples: মন্দিরের কামোত্তেজক ভাস্কর্যগুলি খাজুরাহো চত্বরের মাত্র ১০ শতাংশ নিয়ে গঠিত আর বাকিটা জুড়েই রয়েছে জীবনের নানা আলো আঁধারি।
মহাত্মা গান্ধী অত্যন্ত হতাশ হয়েছিলেন। খাজুরাহো মন্দিরের দেওয়ালে দেওয়ালে খোদাই করা ভাস্কর্যগুলি তাঁকে শিল্পসুষমার দিকে চালিত করেনি, বরং নিয়ে গিয়েছিল হতাশার কাছে। 'তথাকথিত' ভারতীয় সংস্কৃতির পক্ষে এসব ভাস্কর্যকে 'অশোভন' বলেই মনে করেছিলেন গান্ধী। ভারতকে বুঝতে গেলে শুধু যদি গ্রামেও তাকাতে হয়, তাহলেও সেখানের যৌনজীবন বাদ যায় কীভাবে? কীভাবেই বা অস্বীকার করা যায় যে, যৌনক্রীড়া এই দেশের সম্পদ এবং এখন নানা শিল্পের মূলধনও। সবথেকে মজার বিষয়, যে খাজুরাহোর দেওয়ালে কামসূত্রের ভঙ্গিমা দেখে গেল-গেল রব ওঠে তা রয়েছে মন্দিরের মাত্র ১০ শতাংশ অংশে! মধ্যপ্রদেশের বিখ্যাত খাজুরাহো মন্দিরগুলিকে 'আপত্তিকর', 'পর্নোগ্রাফিক' দৃশ্যভাণ্ডার বলে মনে করেন অনেক ভারতীয়ই। আর এসেবের মাঝেই হারিয়ে যায় এই মন্দিরগুলি তৈরির মূল উদ্দেশ্য। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এই মন্দির কামসূত্রের ক্ষুদ্র সংস্করণের অনেক ঊর্ধ্বে! এখানকার মন্দিরগুলি প্রকৃতপক্ষে, মানুষের জীবনের ধারণাকেই চিত্রিত করে।
মন্দিরের কামোত্তেজক ভাস্কর্যগুলি খাজুরাহো চত্বরের মাত্র ১০ শতাংশ নিয়ে গঠিত আর বাকিটা জুড়েই রয়েছে জীবনের নানা আলো আঁধারি। খাজুরাহো মন্দির তৈরির নেপথ্যের কারণটিও বড়ই আকর্ষণীয়। কিংবদন্তি অনুযায়ী, হেমবতী নামে এক সুন্দরী মহিলা ছিলেন, যাকে ভিত্তি করেই পরে খাজুরাহোর মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল। একদিন বেনারসের একটি পুকুরে স্নান করছিলেন হেমবতী। আবার অনেকে বলেন, খাজুরাহো মন্দিরের পশ্চিমদিকে পদ্মভরা এক বড় পুকুর রয়েছে যা 'রতি তালাব' নামেই পরিচিত, সেখানেই স্নান করছিলেন হেমবতী। তখন চন্দ্রদেবতা তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং হেমবতীকে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। চন্দ্রদেব এবং হেমবতী মিলিত হন। তাঁরা এক সন্তানের জন্ম দেন, তার নাম রাখেন চন্দ্রবর্মণ। তবে তাঁর আশঙ্কা ছিল, কুমারী মায়ের এই সন্তান বড় হলেই হেনস্থার মুখে পড়বে। তিনি এই গোটা ঘটনায় এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে চন্দ্রদেবকে অভিশাপ দিয়ে বসেন। পরে এই চন্দ্রদেবই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে শিশুটি বড় হয়ে এক রাজা হবে। তাঁদের ছেলের যখন ১৬ বছর বয়স হবে তখন সে হেমবতীকে শুদ্ধ করার জন্য একটি ‘যজ্ঞ’ করবে।
ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়। শিশুটি বড় হয়ে চান্দেলা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। হেমবতী মারা যাওয়ার পর, তাঁর ছেলে মাকে স্বপ্নে দেখেন। হেমবতীই নাকি তাঁর সন্তানকে এমন মন্দির নির্মাণ করতে বলেন যা মানুষের আবেগকে চিত্রিত করবে। এই খাজুরাহো মন্দির চত্বরের ৯০ শতাংশ জুড়েই রয়েছে সেই সময়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন। কিছু কিছু ভাস্কর্য রয়েছে যেখানে মহিলাদের প্রসাধন করতে দেখা যায়, কিছু ভাস্কর্যে মৃৎশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, কৃষক এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস বলে মন্দিরে দেবতাদের যৌনতাকেই চিত্রিত করা হয়েছে, অথচ এই ধারণার সপক্ষে বিশেষ যুক্তি পান না অনেক বিশেষজ্ঞই।
আরও পড়ুন- চতুর্দিকে ‘প্রেতে’র ভিড়! লোম খাড়া হয়ে যায় ভারতের ১৪ দিনের এই ভূতমেলায়
১২ শতক পর্যন্ত খাজুরাহোতে ৮৫টি মন্দির ছিল। ১৩০০ শতাব্দীতে, দিল্লির সুলতানরা মধ্যভারত দখল করে। সেই সময়ই বেশ কিছু মন্দির ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাকিগুলি অবহেলিত অবস্থাতেই পড়ে থাকে। এখন মাত্র ২২টি মন্দির টিকে রয়েছে খাজুরাহে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, মন্দিরগুলির দরজা হিসাবে ছিল দু'টি সোনার খেজুর গাছ। সেই খেজুর শব্দ থেকেই এসেছে খাজুরাহো। মন্দিরগুলি হাজার বছরেরও প্রাচীন, তবে তা পুনরাবিষ্কার করেছিলেন ক্যাপ্টেন টি.এস. বার্ট। ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশ সেনা ক্যাপ্টেন বার্ট এক সরকারি দায়িত্বে খাজুরাহোতে ছিলেন। সেইসময় অচেনা পথ খুঁজতে খুঁজতে তিনি এসে পড়েন এই মন্দিরে।
খাজুরাহো মন্দিরগুলি রাজপুত চান্দেলা রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। রাজ্যজুড়ে ক্ষমতা কায়েমের পরেই এই মন্দির নির্মাণ শুরু করেন তারা। পরে তাঁদের এই রাজ্য বুন্দেলখণ্ড নামে পরিচিত হয়। হিন্দু রাজা যশোবর্মণ এবং ধাঙ্গার শাসনামলেই অর্থাৎ ৯৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই বেশিরভাগ মন্দির নির্মিত হয়েছিল।