পঞ্চাশ বছরে শোলে! হিট ছবি, কালোত্তীর্ণ কি?
Fifty years of Sholay: এ কথাও আজ সবার জানা যে শোলের শেষ দৃশ্য প্রথমে অন্যরকম শুটিং হয়েছিল, সঞ্জীব কুমারের হাতে গব্বরের ভয়ঙ্কর মৃত্যুর দৃশ্য শুট হয়েছিল।
'কিতনে আদমি থে'- লোক গুণতে গুণতেই পার হয়ে গেল ৫০ বছর। জরুরি অবস্থার সময়ে বলিউডের যে সিনেমা ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা হিসাবে যাত্রা শুরু করে সেই সিনেমাই অঘোষিত জরুরি অবস্থা 'অমৃতকাল'-এ আজও উজ্জ্বল। যাঁরা সিনেমাকে আদ্যন্ত অর্থকরী বিষয় হিসাবে ভাবতে ভালোবাসেন, তাঁদের হিসাব মতো যদি মুদ্রাস্ফীতির অঙ্কটা মাথায় রাখা যায়, তাহলে দেখা যাবে এখনও পর্যন্ত শোলে বাণিজ্য করেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার। ২০৪ মিনিটের এই সেলুলয়েড আখ্যান রামগড় বলে এক কাল্পনিক গ্রামে স্থিত, ভাল বনাম মন্দের চেনা ছকের একদিকে গব্বর সিং নামক এক ভয়াল ডাকাত অন্যদিকে সহজ, সরল এবং মূলধারার সিনেমার চেনা ছক মেনে নিস্ক্রিয় ও অকর্মণ্য গ্রামবাসীকে বাঁচাতে উপস্থিত দুই পেটি ক্রিমিনাল জয় ও বীরু, সৌজন্যে প্রাক্তন জেলার ও গ্রামের মাথা ঠাকুর বলবন্ত সিং। বিবিসি-র তথ্য অনুযায়ী, শতাব্দীর সেরা ভারতীয় সিনেমা হিসাবে বিবেচিত শোলে সেই সময় টানা তিনবছর বোম্বের মিনার্ভা সিনেমায় প্রদর্শিত হয়েছিল।
বলিউডি সিনেমার সূচনালগ্ন থেকে গ্রাম ভারতের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ডাকাতরা, বার বার পর্দায় এসেছেন। 'মাদার ইন্ডিয়া', 'গঙ্গা যমুনা', 'জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়', 'মেরা গাও মেরা দেশ'- এমন বহু সিনেমা রয়েছে। এই সিনেমাগুলির মধ্যে বেশ কিছু সিনামা সাফল্য পেয়েছে কিন্তু শোলের মতো সাফল্য কারোরই নেই। এমনকি চিত্রনাট্যের মধ্যেও হলিউডের বিভিন্ন ছবির প্রভাব স্পষ্ট। 'সেভেন সামুরাই', 'ওয়ানস আপন এ টাইম ইন ওয়েস্ট', ' দি ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন', 'ফর এ ফিউ ডলারস মোর' এর মতো সিনেমা চিত্রনাট্যের নানান জায়গা থেকে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। কিন্ত চিত্রনাট্যকার সেলিম-জাভেদের কুশলী রচনার কারণে তা নিছক 'কারি ওয়েস্টার্ন' হয়ে ওঠে না বরং তার এক ভারতীয় করণ হয়। ধীরে ধীরে শোলে হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক কোড যা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমার প্রযোজক এবং পরিচালকদের কাছে অবশ্য মান্য ফর্মুলা হয়ে ওঠে।
এই কথা অস্বীকার করার প্রশ্ন নেই যে নব্বই পরবর্তী বিশ্বায়নের সময় নগরের বিকাশ, মনোরঞ্জনের বিভিন্ন মাধ্যমের সাড়ম্বর উপস্থিতি পরিস্থিতিতে পরিবর্তন হয়েছে তবুও সিনেমায় উৎসাহী মানুষের কাছে শোলে সিনেমা এক জরুরি পাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রত্যেক সফল সিনেমার পেছনে অনেক ছোটখাটো গল্প লুকিয়ে থাকে যা পরবর্তীতে মিথের অংশ হয় ওঠে। শোলের কাস্টিং নিয়ে অজস্র গল্প আছে, সবচেয়ে বেশি অবশ্যই 'গব্বর' চরিত্রটিকে নিয়ে। পরিচালক রমেশ সিপ্পির প্রথম পছন্দ ছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় ভিলেন ড্যানি কিন্তু ধর্মাত্মা সিনেমার শুটিং এর জন্য তখন তিনি বিদেশে। তখন সিপ্পিরা প্রেমনাথের কথা ভাবেন কিন্তু শুটিং ফ্লোরে প্রেমনাথের নানা বায়নাক্কার কারণে প্রেমনাথের কথা এগোয়নি। এরপর অমিতাভ বচ্চন ও সঞ্জীবকুমার গব্বর চরিত্রে আগ্রহ দেখান কিন্তু রমেশ সিপ্পি ততদিনে তাদের অন্য চরিত্রে ভেবে ফেলেছেন। শেষমেশ তখনকার হিন্দি সিনেমার পরিচিত মুখ জয়ন্তর ছেলে আমজাদ খানের নাম প্রোডাকশনের কেউ কেউ বলেন। প্রথম দর্শনেই সিপ্পি আমজাদের মধ্যে গব্বর চরিত্র খুঁজে পান। পরে এটাও শোনা যায় যে ঠাকুর বলদেবের চরিত্র করার প্রস্তাব প্রথমে যায় দিলীপ কুমারের কাছে কিন্তু অতিরিক্ত ভায়োলেন্সের কারণে তিনি পিছিয়ে আসেন। এ কথাও আজ সবার জানা যে শোলের শেষ দৃশ্য প্রথমে অন্যরকম শুটিং হওয়ার কথা ছিল, সঞ্জীব কুমারের হাতে গব্বরের ভয়ঙ্কর মৃত্যুর দৃশ্য শুট হয়েছিল। তবে জরুরি অবস্থার সেই বাজারে সেন্সর বোর্ডের কর্তারা সেই ঝুঁকি নিতে রাজি হন। ফলে আবার ব্যাঙ্গালোরের কাছে রামনগরম গ্রামে সিপ্পিরা নতুন ভাবে শুটিং করেন যেখানে দেখানো হয় আহত গব্বরকে পুলিশ গ্রেফতার করছে। আইনের লম্বা হাত থেকে গব্বরের মতো ডাকাতেরও নিস্তার নেই। রাষ্ট্রের পছন্দের হ্যাপি এন্ডিং।

সিপ্পি প্রোডাকশন খরচের দিক থেকে শোলে সিনেমাটি তৈরিতে কোনো কমতি রাখেনি। ছবির বাজেট তিন কোটি যা সেই সময়ের বিচারে বিশাল অঙ্ক। শোলে ভারতের প্রথম ৭০ মিমি ছবি, বিদেশ থেকে তার জন্য প্যানাভিশন লেন্স আনানো হয়, সঙ্গে স্টিরিওফোনিক সাউন্ড। সিনেমা রিলিজ করার আগেই এই মাল্টিস্টার ফিল্ম নিয়ে মিডিয়াতে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু প্রথম সপ্তাহে শোলে দর্শকমনে কোনো জায়গাই নিতে পারেনি। ট্রেড অ্যানালিসিস্টরা দুদিনের মধ্যেই শোলেকে ফ্লপ ঘোষণা করেন। পন্ডিতদের রায় বেরোয় যে অতিরিক্ত হলিউডের প্রভাব ছবিটির ভারতীয় আত্মাকে নষ্ট করে ফেলেছে। এক সংবাদপত্রে লেখা হয়: "Too much masala, not enough heart"। প্রথম সপ্তাহে বরং বক্স অফিসে ম্যাজিক দেখায় কম বাজেটের ধর্মীয় সিনেমা 'জয় সন্তোষী মা'। এই সিনেমা শুধু হিট হয়নি, সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এই প্রথম সিনেমার কল্যাণে এক স্বল্প পরিচিত দেবী সর্বভারতীয় পরিচিতি লাভ করল। প্রথম সপ্তাহের ফলাফলে সন্তোষী মা, শোলের থেকে অনেক বেশি আয় করে। হতাশ রমেশ সিপ্পি সিদ্ধান্ত নেন, প্রয়োজনে হিংসার দৃশ্য কমিয়ে এবং জয়কে বাঁচিয়ে নতুন ভাবে শোলে রিলিজ করবেন। তবে একমাত্র হতাশ হননি সেলিম-জাভেদ জুটি, প্রথম সপ্তাহে এক সাক্ষাৎকারে তাঁরা দাবি করেন ভারতের প্রত্যেকটা টেরিটরিতে শোলে এক কোটি টাকা আয় করবে। এই মন্তব্যের জন্য মিডিয়াতে তাঁদের অনেক বিদ্রুপের মুখোমুখি হতে হয়।
আরও পড়ুন- সিনেমায় বিকৃত ১৯৪৬, ইতিহাসের নামে চলছে যে রাজনীতির খেলা
দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আবার খেলা ঘুরতে শুরু করে। 'যো ডর গ্যায়া সমঝো ও মর গ্যায়া' -- এই সংলাপ দেশের বিভিন্ন কোণে বাজতে থাকে। পলিডোর কোম্পানি ৪৮ মিনিটের শোলের সংলাপের এক রেকর্ড বাজারে ছাড়ে যা প্ল্যাটিনাম ডিস্ক পায়। ১৯৭৬ সালে এসে বোঝা যায় যে শোলে বাণিজ্যিক সিনেমার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। পাকিস্তানে শোলের অনুকরণে ১৯৭৯ সালে তৈরি হয় 'মওলা জাঠ' নামের এক সিনেমা। তুরস্কের সেই সময়কার সিনেমার বহু খলনায়ক অভিনয়ের সময় আমজাদ খানের নকল করতে শুরু করেন।
ইরান আজও শোলেকে মনে রেখেছে। চিন ও সোভিয়েত রাশিয়ায় ভারতীয় সিনেমা বরাবরই জনপ্রিয়, শোলের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা ঘটেনি। একটা সিনেমাকে বাণিজ্য সফল ও দর্শকধন্য হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ফিল্মের মেকিংটা ভীষণ জরুরি। সিনেমার সব কটি ডিপার্টমেন্ট শোলের ক্ষেত্রে ম্যাজিকের কাজ করেছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয় সেলিম-জাভেদের চিত্রনাট্য। 'জঞ্জির', 'দিওয়ার' থেকে সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ব্যাক্তি মানুষের প্রতিবাদ এবং প্রোটাগনিস্টের সামাজিক নিয়মের বিপরীতে কাজকর্মকে মহিমান্বিত করার যে ফর্মুলা, এই জুটির সিগনেচার টিউন, তাকে গ্রাম ভারতে স্থাপিত করার কাজটা অসাধারণ দক্ষতায় করেছেন সেলিম-জাভেদ। এই চিত্রনাট্যকে আগাগোড়া অনুসরণ করেছেন পরিচালক রমেশ সিপ্পি। এক্ষেত্রে ক্যামেরাম্যান দ্বারকা দিবেচার কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হবে। বীরু ও জয়ের এন্ট্রির ক্ষেত্রে এবং পর্দায় প্রথমবার গব্বরকে দেখার সময় ক্যামেরা ছবিতে এমন এক ওয়েস্টার্ন লুক এনেছেন যা আগে কখনও আম দর্শক দেখেনইনি। আবার ঠাকুর হাভেলিতে লণ্ঠন জ্বালানো ও নেভানোর দৃশ্যে জয়া ভাদুড়ি ও অমিতাভের দৃষ্টিপাতে ক্যামেরা যেন কবিতা হয়ে উঠেছে। এগুলো সম্ভব হত না যদি এম এস সিন্ধের সম্পাদনা থাকত।
শোলে সংক্রান্ত আলোচনায় সেট ডিজাইনার রাম ইয়েদকারের কথা খুব একটা হয় না অথচ তিনি রামগড় বলে যে গ্রামটা তৈরি করেছিলেন তা আদতে সিনেমার এক চরিত্র হয়ে উঠেছে। গব্বরের নৃশংসতা, অন্তর্লীন সন্ত্রাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ হল রামগড়ের উষর চালচিত্র। ভারতীয়দের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে সংগীত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই দাদাসাহেব ফালকের সময় থেকে গান মেইনস্ট্রিম সিনেমার এক অনিবার্য উপাদান। শোলের ক্ষেত্রে সেই বিষয়টাকে মাথায় রেখে আরডি বর্মনকে মিউজিকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন রমেশ সিপ্পি। আমার মতে শোলের গান শ্রবণসুখকর কিন্তু সেই অর্থে অসাধারণ নয়। 'ইয়ে দোস্তি হাম নেই তোড়েঙ্গে' ছবির গড়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। গব্বরের ডেরায় 'মেহেবুবা মেহেবুবা' ক্যাবারে নাম্বার হিসাবে ঠিকঠাক তবে গানটি ডেমিস রুশোর 'say you love me' দ্বারা খুব বেশি রকম অনুপ্রাণিত। তবে শোলেতে আরডি ম্যাজিক দেখিয়েছেন ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের ক্ষেত্রে। সেটা শুরুর দৃশ্যে বাতাস চিরে রেল ইঞ্জিনের হুইসেল হোক বা গব্বরের এন্ট্রির সেই ধাতব শব্দ। কে ভুলতে পারে জয়া ভাদুড়ির লণ্ঠন জ্বালানোর দৃশ্যে অমিতাভের সেই মাউথ অরগ্যানের সুর। শোলের নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে আগাগোড়া পাল্লা দিয়ে গেছে আরডি বর্মণের আবহসঙ্গীত।আর সেটা করতে গিয়ে আর ডি বর্মন পাশে পেয়েছিলেন এক ঝাঁক তরুণ শিল্পীকে যাঁরা পরে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিংবদন্তী হয়ে উঠবেন। শিবকুমার শর্মা (সন্তুর), ভূপিন্দার সিং (গিটার), মনোহরি সিং (স্যাক্সোফোন), কার্সি লর্ড (সিন্থেসাইজার), ভানু গুপ্তা (হারমোনিকা)- সব মিলিয়ে ৫০-৬০ জনের অর্কেস্ট্রা। আজকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বরাত দেওয়া গান কারখানার সঙ্গে যুক্ত লোকেরা এই গ্র্যান্ড অর্কেস্ট্রাকে বুঝতেই পারবেন না।
শোলের কুশলী চিত্রনাট্য সফল হয়েছে অভিনেতাদের গুণে। এক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রগুলোর নির্মাণ করা হয়েছে চিত্রনাট্যের দাবি মেনে। সিনেমাটা দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠাকুর বলদেব সিং-এর উপর। এক অর্থে তিনি এই আখ্যানের সূত্রধর। সঞ্জীব কুমারের পরিমিতিবোধ চরিত্রটিকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। সেলিম-জাভেদ বীরু ও জয় (ধর্মেন্দ্র ও অমিতাভ) এবং বাসন্তী-রাধা (হেমা মালিনী ও জয়া ভাদুড়ী)কে বিপ্রতীপ চরিত্র হিসাবে নির্মাণ করেছেন। এক্ষেত্রে জয়ের চরিত্রটি জঞ্জীর ও দিওয়ারের অমিতাভ চরিত্রের এক ধরণের রূপভেদ, সিরিও কমিক চরিত্রে ধর্মেন্দ্র যথাযথ। নারী চরিত্র দুটির বৈপরীত্য ফুটিয়ে তুলতে হেমা মালিনী ও জয়া ভাদুড়ী সফল। কিন্তু শোলে সিনেমার সবচেয়ে আলোচিত দিক হল ছোট ছোট চরিত্রগুলি (যাঁদের সিনেমার ভাষায় পার্শ্ব অভিনেতা বলা হয়) যাঁরা এই সিনেমার প্রাণ হয়ে উঠেছেন এবং অনেকে পরবর্তী কালে সেই ইমেজের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে থেকেছেন, তার থেকে বেরোতে পারেননি। হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে কখনও পার্শ্ব চরিত্ররা এত অল্প সময় থেকে এত দীর্ঘ প্রভাব রেখে যেতে পারেননি। আসলে এই দীর্ঘ সিনেমায় এই চরিত্রগুলো দর্শকদের এক ধরণের স্পেস দেয়, তাঁরা হাস্যরস,করুণ রস, দুঃখ ও আনন্দের মুহূর্ত তৈরি করে যা মূল গল্পকে তরতরিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এ কে হাঙ্গল (ইমাম সাহেব), সত্যেন্দ্র কাপুর (রামলাল), ইফতিকার(রাধার বাবা), লীলা মিশ্র (মউসি জি), বিজু খোটে (কালিয়া), শচীন(ইমাম সাহেবের পুত্র), জগদীপ (সুরমা ভূপালি), সাম্বা (ম্যাকমোহন), আসরানি (ইংরেজ আমলের জেলার)- এঁদের কাউকে ছাড়াই শোলেকে ভাবা যায় না। দেখবার মত বিষয় হল শোলের বহু অবিস্মরণীয় সংলাপ এই চরিত্রগুলির জন্য বরাদ্দ। 'ইতনে সান্নাটা কিউ হ্যাঁয়', 'ম্যা ইংরেজ জমানা কে জেলার হু', 'পুরে পঁচাশ হাজার' থেকে 'ম্যা আপকা নিমক খায়া সরদার' থেকে 'আব গোলি খা'- এগুলো ধীরে ধীরে মানুষের কথাবার্তার অংশ হয়ে গেছে।
এত অভিনেতার ভিড়ে শেষপর্যন্ত বলতেই হয় যে শোলে আসলে আমজাদ খানের থুড়ি গব্বরের।
শার্লক হোমস চরিত্রের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডায়েল বলেছিলেন- 'Great heroism demands a fitting rival'। শোলে সিনেমায় ভাল-মন্দের আখ্যানে ঠাকুর সাহেব, জয় ও বীরুর প্রতিস্পর্ধায় গব্বর সিং এক লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্র। তাঁর করাল চাউনি, ক্রুর সংলাপ, নৃশংসতা এমন মাত্রায় উপস্থিত হয় যা আগে কখনও বলিউড দেখেনি। মিহি গলার স্বরের কারণে সেলিম-জাভেদের সন্দেহ ছিল আমজাদ পারবেন কি না! কিন্তু রমেশ সিপ্পি তাঁর উপর আস্থা রাখেন।
আরও পড়ুন- জ্বলছে মণিপুর, মরছে মানুষ! আর সিনেমাহলে দেখানো হচ্ছে ‘উড়ি; দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’?
গব্বরের সৌজন্যে খৈনি উত্তর ও পূর্ব ভারতে জাতীয় নেশায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে গব্বরের আদলে একাধিক চরিত্র হয়। খোদ রমেশ সিপ্পির শানে খলনায়ক শকাল (কুলভূষণ খারবান্দা), শেখর কাপুরের মিঃ ইন্ডিয়ার মোগাম্বো (অমরীশ পুরি) গব্বরের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। তবে বর্তমান নিবন্ধকারের মতে রাজকুমার সন্তোষীর শোলে অনুপ্রাণিত সিনেমা 'চায়না গেটে' ডাকাত সর্দার জাগিরার চরিত্রে মুকেশ তেওয়ারির অভিনয় গব্বরের এক বিশ্বাসযোগ্য অনুকরণ। সারা ভারত ঘুমিয়ে পড়েনি, তাই গব্বর এসেছেন। অন্যায়, অসততা ও নৃশংসতার মিশেলে গড়ে ওঠা গব্বর হয়ে ওঠে এমন এক খলনায়ক, যাঁকে ভয়ের সঙ্গে ভক্তিও করতে হয়। এই আকাশচুম্বী সাফল্য ও ট্রেডমার্ক সিনেমা হওয়া সত্বেও শোলে কালোত্তীর্ণ সিনেমা হয়ে উঠতে পারে না। এর কারণ সেলিম-জাভেদের চিত্রনাট্য জীবনের প্রতি সৎ থাকতে পারে না। স্থিতাবস্থা রক্ষার স্বার্থে তাঁকে এক কাল্পনিক আখ্যানের আশ্রয় নিতে হয়। এই জটিলতার কারণ লুকিয়ে আছে রামগড় নামক গ্রামটির চিত্রায়ণে। শোলে সন্তর্পণে সত্তর দশকের গ্রাম ভারতের ছবিটাকে আড়াল করতে চায়। আমাদের নজর এড়ায় না যে রামগড়ের মত ছোট্ট গ্রামে স্কুল, বিদ্যুৎ বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো বেঁচে থাকার সাধারণ উপকরণগুলো পর্যন্ত নেই। মনে করা হয়, গ্রামের মানুষ কৃষিজীবি কিন্তু গোটা ছবিতে কৃষির নাম ও নিশান নেই। গ্রামে কাজ নেই তা বোঝা যায় জীবিকার সন্ধানে ইমাম সাহেবের ছেলের গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে। এই গল্পে সামন্ততন্ত্র এক ভালো মানুষের মধ্যে দিয়ে উপস্থিত হয়, ঠাকুর বলদেব সিং। তাঁর আভিজাত্য, ক্ষমতার কেন্দ্রে তাঁর অবস্থান বোঝানো হয় গ্রামের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় তাঁর বাড়ির অবস্থানের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু সেলিম-জাভেদ সুকৌশলে এড়িয়ে যান সামন্ততন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা গ্রাম ভারতের সামাজিক-আর্থিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বৈষম্যগুলিকে। রামগড় যেন এইসব অভিশাপ মুক্ত, রোমান্টিকতার বার্তাবাহী এক নিঃসঙ্গ মডেল গ্রাম। আধুনিকতা থেকে বহু যোজন দূরে তার অবস্থান।

আজকের সময়ের চোখ দিয়ে দেখলে একটা পার্থক্য অবশ্যই নজরে পড়ে। গ্রামে থাকা মুসলিম পরিবারটি, বিশেষ করে ইমাম সাহেব ও তাঁর পুত্রের উপস্থিতি। তাঁদেরকে আজকের ভারতের সিনেমা পরিচালকদের মতো 'অপর', 'হিংসাশ্রয়ী' এবং শত্রু হিসাবে দেখা হয় না। আমরা বুঝতে পারি, তখনও দেশটা নেহেরুর ভারতের ভাবনার বাইরে যায়নি। শোলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল গব্বর সিং-কে সামাজিক বাস্তবতাহীন ভাবে উপস্থিত করা। অথচ বহু মেইনস্ট্রিম হিন্দি সিনেমাতে ভারতের সামাজিক বাস্তবতাকে কেন্দ্রে রেখে ডাকাতদের চরিত্রায়ন করা হয়েছে। 'মাদার ইন্ডিয়া'-তে মূল চরিত্রের ছেলে (সুনীল দত্ত) দারিদ্র্য ও সুদখোর মহাজনদের শোষণের হাত থেকে বাঁচতে ডাকাত হয় যা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির ঘুণ ধরা ছবিটাকে দর্শকদের কাছে উন্মোচিত করে।
'গঙ্গা যমুনা'-তে দারিদ্র্য ও সামাজিক বিয়োজন গঙ্গা ডাকাতের (দিলীপকুমার) চরিত্রটি নির্মাণ করে। গঙ্গা কি সৌগন্ধ, বাটোয়ারা এবং ব্যান্ডিট কুইনে ডাকাতরা হয়ে ওঠে জাতব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিস্পর্ধা। বিশেষ করে ফুলন দেবীর (সীমা বিশ্বাস) সন্ত্রাস আসলে উচ্চ বর্ণের নারকীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে দলিত হিংসার ছবি। সেলিম-জাভেদের রামগড় যেমন এক কল্পিত গ্রাম, তাঁর খলনায়ক গব্বরও এক কল্পিত চরিত্র। আমরা ভাবতে চেষ্টা করি কেন গব্বর ডাকাত? সে কি সামন্ততান্ত্রিক শোষণের শিকার হয়ে বন্দুক তুলে নেয়? ঠাকুরের প্রতি তাঁর এই ঘৃণার কারণ কী উচ্চবর্ণের অত্যাচার? গব্বরের ইউনিফর্ম দেখে প্রশ্ন জাগে সে কি কোন প্রাক্তন হাবিলদার যে আজ ডাকাতির পথ বেছে নিয়েছে? এসব নিয়ে সেলিম-জাভেদ বা পরিচালকের কোনো চিন্তা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হল, ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাই যে সত্তর দশক আদতে স্বৈরাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে, স্থিতাবস্থা ভাঙার লক্ষ্যে এক সমষ্টিগত প্রতিবাদের ডাক দেয়। বসন্তের সেই বজ্র নির্ঘোষ শাসকদের চিন্তার কারণ হয়। সেলিম-জাভেদ এই বজ্র নির্ঘোষকে বিপথগামী করতে সিনেমার মতো জনপ্রিয় মাধ্যম কে ব্যবহার করেন।
জঞ্জির, দিওয়ার, শোলের মত সিনেমা বার্তা দেয় যে সামাজিক অসাম্য দূর করতে জনগণের নিজের সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের অপেক্ষা করতে হবে মসিহার জন্য। কখনও কর্তব্যে অবিচল পুলিশ অফিসার, কখনও শহরের ক্রাইম র্যাকেটের গুন্ডা বা পেটি ক্রিমিনালরা ন্যায়ের প্রতীক হয়ে উঠবে। এই অসত্য রাজনীতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা সিনেমা তাই যাবতীয় সাফল্য সত্ত্বেও কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠতে পারে না। আলফ্রেড হিচকক অসাধারণ দক্ষতায় একের পর এক থ্রিলার তৈরি করেন যা শেষপর্যন্ত চমকপ্রদ সিনেমা হয়ে থেকে যায়। কারিগরি দক্ষতা, নিটোল চিত্রনাট্য, কুশলী পরিচালনা সত্বেও তা যুগোত্তীর্ণ সিনেমা হয়ে ওঠে না। শোলে তার অসাধারণ বানিজ্যিক সাফল্য সত্ত্বেও থেকে যায় এক হীরকমন্ডিত ভস্মাধার হিসাবে।

Whatsapp
