১৯০ কোটি বছর ধরে মহাকাশের পথ পেরিয়ে পৃথিবীতে কোন বার্তা এসে পৌঁছল?

NASA GRB Signal: ১৯০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে স্যাগিত্তা নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে এই সিগন্যালের উৎপত্তি হয়েছে।

১৯০ কোটি বছর ধরে মহাকাশের পথ অতিক্রম করেছে সে। এই এতটা পথ অতিক্রম করে ধরা দিয়েছে মানুষের কাছে। দীর্ঘ সেই পথ, যার সূত্রপাত এক ভয়াবহ হিংসাত্মক ঘটনার মাধ্যমে। সেই তীব্র হিংসাত্মক, ধংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে এতটাই আগে, যে তখন পৃথিবীর বুকে সবক'টি মহাদেশ একসঙ্গে ছিল। পৃথিবীর সমস্ত স্থলভাগ ছিল একজোট হয়ে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তখন সদ্য অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের আধিক্য বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হয়েছে। সায়ানোব্যাকটেরিয়া কিছু কোটি বছর আগে থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আনতে শুরু করেছে অক্সিজেন। পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার ঘটে গেছে, এবং মনে করা হয়, ততদিনে প্রথমবারের মতো প্রাণের বিলুপ্তিও ঘটে গেছে।

কিন্তু কী এসে পৌঁছল? ভিনগ্রহীদের কোনও বার্তা? কোনও সিগন্যাল?

না। এখনও পৃথিবীর মতো কোনও সমান্তরাল সভ্যতার খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেইরকম কোনও বার্তাও এসে ধরা পড়েনি আমাদের কাছে, এখনও। তবে? নাসা জানাচ্ছে, ৯ অক্টোবর তাদের কাছে ধরা পড়েছে এক দীর্ঘ তরঙ্গ, খুবই শক্তিশালী এবং অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই দীর্ঘ, শক্তিশালী তরঙ্গের উৎস এক ভয়ংকর গামা রশ্মি বিস্ফোরণ। যাকে বলা হয়, এই ব্রহ্মাণ্ডের সবথেকে শক্তিশালী বিস্ফোরণগুলির একটা। আজ থেকে বেশ কয়েক কোটি বছর আগে এরকমই এক গামা রশ্মি বিস্ফোরণ ধেয়ে এসেছিল পৃথিবীর দিকে, তবে মাত্র ৬,০০০ আলোকবর্ষ দূর থেকে। ৬,০০০ আলোকবর্ষকে সাধারণত বড় দূরত্ব বলেই বর্ননা করা যায়, কিন্তু এই ধরনের বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী যে ৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরত্বেও তার ধ্বংসাত্বক ক্ষমতা মারাত্মক থাকে। মনে করা হয়, অরদোভিশিয়ান বিলুপ্তির ঘটনা, বা পৃথিবীর ইতিহাসের শুরুর দিকের প্রাণ বিলুপ্তির ঘটনা, সেই ৬,০০০ আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা গামা রশ্মি বিস্ফোরণের কারণে ঘটেছিল।

আরও পড়ুন: মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা বিপদ এড়াল নাসা-র অস্ত্র! যেভাবে বিলুপ্তি থেকে বাঁচল মানুষ

নাসা জানাচ্ছে, ৯ অক্টোবর তাদের বিভিন্ন মানমন্দির, টেলিস্কোপে এক্স রে এবং গামা রে-র আগমন ধরা পড়ে। ওইদিন মার্কিন সময়ে সকাল নাগাদ তা আমাদের সৌরজগৎ অতিক্রম করে। নাসার ফের্মি গামা-রে স্পেস টেলিস্কোপ, নিল গেহরেলস্ সুইফট অবজার্ভোটরি, উইন্ড স্পেসক্রাফ্ট, এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীর তাবড় তাবড় টেলিস্কোপ এবং মানমন্দিরের যন্ত্রে এই বিস্ফোরণ ধরা পড়ে। চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে।

তাঁরা জানাচ্ছেন, ১৯০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে স্যাগিত্তা নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে এই সিগন্যালের উৎপত্তি হয়েছে। প্রাথমিক গবেষণার পর বিজ্ঞানীদের ধারণা, একটি বিশালাকার নক্ষত্র নিজের মাধ্যাকর্ষণের জেরে পতনের ফলে কৃষ্ণগহ্বর বা Black Hole-এ পরিণত হওয়ার ফলে এই তীব্র শক্তিশালী গামা রশ্মির বিস্ফোরণ ঘটেছে। তা এতটাই শক্তিশালী যে, ১৯০ কোটি বছর যাত্রার পরেও তা ভীষণভাবে উজ্জ্বল, এবং প্রায় দশ ঘণ্টা ধরে এই বিস্ফোরণ নাসার বিভিন্ন যন্ত্রে ধরা পড়েছে। সেই সঙ্গে নাসা জানাচ্ছে, এই বিস্ফোরণ তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কাছে ঘটেছে। অতীতে তাদের যন্ত্রে যে ধরনের বিস্ফোরণ ধরা পড়েছে, তার তুলনায় ১৯০ কোটি আলোকবর্ষর দূরত্বকেও তারা কাছাকাছি বলেই দাবি করছেন। সেই সঙ্গে এত উজ্জ্বল এবং শক্তিশালী গামা রশ্মি সুদূর অতীতে তাদের কোনও যন্ত্রে ধরা পড়েনি। সেই কারণে তারা আরও বেশি উত্তেজিত।

এই আবিষ্কার বিজ্ঞানী-মহলকে তীব্রভাবে উৎসাহিত করেছে। এই রশ্মির ওপর গবেষণা করে তারা আরও বিশদে বোঝার চেষ্টা করবেন, কোন পরিস্থিতিতে কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হয়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, একটি কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হওয়ার প্রাথমিক শর্তই হলো, নক্ষত্রের আয়তন বিশাল হতে হবে। আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে থাকা নক্ষত্রের থেকে তা অনেকাংশেই বৃহৎ হতে হবে। তবেই একটা সময়ের পর নিজের মাধ্যাকর্ষণের জেরে তার পতন হবে এবং সে পরিণত হবে এমন একটি বস্তুতে, যার থেকে আলোরও রেহাই নেই।

নাসা এই ঘটনাকে বলছে GRB 221009A; নাসা-র ফের্মি সিমপোজিয়াম, যা শুরু হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে, তার সূত্রপাত হলো এই ঘটনার মধ্য দিয়েই। মেরিল্যান্ডে নাসা-র গোদার স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে অবস্থিত ফের্মি প্রোজেক্টের ডেপুটি অ্যাসিস্ট‍্যান্ট জুডি রাকুসিন যেমন মজা করে বলছেন, "আমাদের এই মিটিং শুরু হলো একেবারে একটা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে! যে সে কথা নয়!"

এই ধরনের উজ্জ্বল গামা রে আরও কয়েক দশকে ধরা পড়বে না, এমনটাই মনে করছে নাসা। ইতালি-র ব‍্যারির একজন গবেষক, যিনি ফের্মি-র প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই বিস্ফোরণের প্রাথমিক সংকেতগুলো টের পেয়েছেন, তিনি বলছেন, "অন‍্যান‍্য গামা রে বিস্ফোরণের তুলনায় এটির দূরত্ব কম হওয়ার দরুন আমাদের এই বিস্ফোরণের খুঁটিনাটি চিনতে সুবিধে হচ্ছে। এই বিস্ফোরণের ঔজ্জ্বল্য বেশি, তীব্রতাও বেশি।"

প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে এই বিস্ফোরণের সংকেতের সাক্ষী থাকল ফের্মি-র 'লার্জ এরিয়া টেলিস্কোপ' (LAT)। ইন্টারন‍্যাশনাল স্পেস স্টেশনে চলতে থাকা আরও একটি নিরীক্ষাকে সাহায্য করল এই সংকেত, তা হলো নাসা-র নাইসার এক্স রে টেলিস্কোপ এবং জাপানের মনিটর অফ অল স্কাই এক্স রে- এই দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন।

More Articles