বেলঘড়িয়ায় বসেই নাসাকে নতুন গ্রহাণুর সন্ধান! কে এই তরুণ?
NASA Citizen Scientist: পেশায় এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার উজ্জ্বল শুধু ইঞ্জিনিয়র নন, বিমানের নকশা তৈরির সঙ্গেই তাঁর শখের খাতায় রয়েছে কবিতা লেখা। তাঁর ব্যক্তিগত খ্যাতির ঝুলিতে রয়েছে একাধিক পুরস্কারও।
নাসা! ন্যাশনাল এরোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NASA) । বিশ্বের মহাকাশ গবেষণায় সর্বোচ্চ সংস্থা। এর সঙ্গেই এবার নাম জড়াল বাংলার! ২০২২ এর 'সিটিজেন সায়েন্টিস্ট' অথবা নাসার আন্তর্জাতিক মহাকাশীয় অন্বেষণ উদ্যোগের (International Astronomical Search Collaboration) তরফে 'নাগরিক বিজ্ঞানী' হিসেবে খেতাব ছিনিয়ে নিলেন উত্তর ২৪ পরগনার নিমতার উজ্জ্বল অধিকারী। এই সম্মান দেয় নাসার উদ্যোগে ওই নির্দিষ্ট বিভাগ।
'ভারতের সর্বকনিষ্ঠ এরোস্পেস চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়র' হিসেবে 'ইন্ডিয়া বুক অব রেকর্ডস্'-এ ২০২০ সালে নাম তুলেছিলেন তিনি। বিশ্বের অন্যতম সর্বকনিষ্ঠ এরোস্পেস চাটার্ড ইঞ্জিনিয়র (Aerospace Chartered Engineer) হিসেবেও ২০২১ সালে উঠে এসেছে উজ্জ্বলের নাম। নিমতার মেধাবী এই যুবক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন আগেই, এবার তাঁর মুকুটে জুড়ল নতুন পালক। ফের ২০২২-এ 'সিটিজেন সায়েন্টিস্ট' বা 'নাগরিক বিজ্ঞানী' হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি, যে খেতাব এই বছরে, এদেশে সম্ভবত তিনি একাই পেয়েছেন! পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, উজ্জ্বলের দাবি, ভারত থেকে ২০২২ সালে তিনি ছাড়া আর কেউ এই সম্মান পাননি! এই বিষয়টি একজন ইঞ্জিনিয়র শুধু নয়, ভারতীয় নাগরিক হিসেবেও গর্বের বলেই মত তাঁর।
কিন্তু কীভাবে এই খেতাব পেলেন উজ্জ্বল? সদ্য নির্বাচিত এই 'নাগরিক বিজ্ঞানী'র দাবি, প্রতি বছর বিভিন্ন বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রকল্পের আওতায় নিজেদের মতামত ব্যক্ত এবং কাজ করার অভিজ্ঞতা জানানোর জন্য আবেদন করতে বলে নাসার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নির্দিষ্ট বিভাগ। আবেদন করতে পারেন সকলে। যেকোনও নাগরিক, গবেষক, বিজ্ঞানী অথবা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারেন এই ক্ষেত্রে। নির্দিষ্ট বিষয়ের উপরে গবেষণা চালিয়ে প্রাথমিক ভাবনার কথা, প্রস্তাবের কথা পাঠাতে হয় ওই সংস্থাকে। লাখ লাখ আবেদন জমা পড়ে। সেই আবেদনের ভিত্তিতে এবং কাজ খতিয়ে দেখে নির্বাচিত হন শতাধিক। আবার তার মধ্যে থেকে চূড়ান্ত তালিকায় থাকা বিশ্বের সেরা কয়েকজনকে এই খেতাব দেওয়া হয়। পাঠানো হয় শংসাপত্র। যার উপর ভিত্তি করে ওই নির্দিষ্ট প্রকল্পের গবেষণার কাজ বা নাসার ইচ্ছামতো অথবা তাদের আমন্ত্রণে নাসার সাহায্যে ওই নির্দিষ্ট বিভাগের সঙ্গে কাজ করতে পারেন এই সমস্ত সিটিজেন সায়েন্টিস্ট বা নাগরিক বিজ্ঞানীরা। ডাক পেলে থাকে মোটা অঙ্কের সাম্মানিকের ব্যবস্থাও। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় এটি। এবছরে বাংলা থেকে এই শংসাপত্র ছিনিয়ে নিয়েছেন উজ্জ্বল!
আরও পড়ুন- মানুষ এক ছোবলেই ছবি! তবে কোন রহস্যে সাপের তীব্র বিষেও বেঁচে যায় বন্য প্রাণীরা?
নিমতার বাসিন্দার বর্তমানের আবাস বেঙ্গালুরু। সেখানেই একটি সংস্থার সঙ্গে বিমানের নকশা করেন তিনি। বরাবরের মেধাবী উজ্জ্বলের স্বপ্ন ছিল আকাশ নিয়ে গবেষণা। তাঁর কথায়, ''আগেও চেষ্টা করেছি। সেবার ৩০ জনের মধ্যে আসতে পারিনি। এবার ভালো লাগছে এই খেতাব পেয়ে।'' এরপরের উদ্দেশ্য? ''আমি ইঞ্জিনিয়র। চাকরি করি। ডাকলে সেটাতেও যাব। তাতে চাকরি ছাড়তে হবে না ঠিকই। কিন্তু এই সম্মান যা আমি পেয়েছি, সেটাই বিরাট।''
নাগরিক বিজ্ঞানী হিসেবে কেন উজ্জ্বলকেই বাছল নাসা? "এবছরের জন্য দেওয়া হয়েছিল অ্যাস্টরয়েড নিয়ে প্রকল্প। অর্থাৎ এই যে তারাখসা-উল্কা মহাকাশে রকমারি ঝলকানি, নানা গ্রহ, উপগ্রহের বাস সম্পর্কে আমরা জানি- তাদের নিয়েই কাজ। আমি এই গবেষণায় তিনটি নতুন অ্যাস্টরয়েডের সন্ধান দিয়েছি। ওই প্রতিবেদনে বিস্তারিত পাঠিয়েছিলাম। ভাবিনি নির্বাচিত হব।''
পেশায় এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার উজ্জ্বল শুধু ইঞ্জিনিয়র নন, বিমানের নকশা তৈরির সঙ্গেই তাঁর শখের খাতায় রয়েছে কবিতা লেখা। তাঁর ব্যক্তিগত খ্যাতির ঝুলিতে রয়েছে একাধিক পুরস্কারও। উজ্জ্বলের পড়াশোনা এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। এর পাশাপাশি, এমপিবিল ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ সেন্টারের অ্যাস্ট্রোনমি অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনাও চলে জোরকদমে। 'বিগ ব্যাং থিওরি'র উপরে গবেষণা সন্দর্ভ জমা দেন পড়ুয়া থাকাকালীন। ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স থেকে এরোস্পেসের উপরে চার্টার ইঞ্জিনিয়রিংও পাস করেন এই যুবক।
এরপরই আসে প্রথম জয়ের শিরোপা অর্জন। ২০২০ সালে ইন্ডিয়া বুক অব রেকর্ডসে ভারতের কনিষ্ঠতম এরোস্পেস চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়র হিসেবে নাম ওঠে তাঁর। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। ২০২১ সালে বিশ্বের কনিষ্ঠতম এরোস্পেস চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়র হিসেবে বিশ্বরেকর্ডটিও উজ্জ্বলের ঝুলিতে রয়েছে। আবার 'প্রফেসর শঙ্কু' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি সায়েন্স ফিকশন সিরিজও তৈরি করেন উজ্জ্বল। যার নাম 'প্রফেসর উজান সিরিজ'। ২০২২ সালে কানাডা থেকে আন্তর্জতিক সাহিত্য সম্মানে ভূষিত হয়েছেন বাংলার ছেলে উজ্জ্বল অধিকারী। তাঁর ভাগ্যে জুটেছে ডক্টর এপিজে আব্দুল কালাম পুরস্কার, ভারতভূষণ সম্মান, রাষ্ট্রীয় রত্ন পুরস্কার এবং ইন্ডিয়া প্রাইমের বিচারে সেরা ১০০ ভারতীয় লেখকদের তালিকায় তাঁর নাম উঠেছে। ইতালির প্যানোরোমা আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেন তিনি।
আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া
সিটিজেন সায়েন্টিস্ট প্রোগ্রাম
মূলত প্রতি বছর, নির্দিষ্ট সময়ে নাসার উদ্যোগে, 'ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসট্রোনমিক্যাল সার্চ কোলাবরেশনে'র তরফে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে এই বিষয়টি নিয়ে অবগত করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। ওই বিজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকে একাধিক প্রকল্পের কথা, যা মূলত গবেষণা সংক্রান্ত। সেই অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকেই যেকোনও নাগরিক, গবেষক, বিজ্ঞানী আবেদন করতে পারেন। এবার সফল আবেদনকারীদের 'র' বা কাঁচা ডাটা বা তথ্য পাঠানো হয়।
বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা থাকলে মেলে অগ্রাধিকার। অনেকসময় ওই শাখায় পড়াশোনা বাধ্যতামূলক রাখে সংস্থা। সেই পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওই প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে নিজেদের আবেদন করতে হয়। বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করতে হয়। অনলাইনেই জমা দিতে হয় গবেষণা সন্দর্ভ। সংস্থার তরফে দেওয়া তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে বিশদে তথ্য পাঠাতে হয়।
বিশ্বের একাধিক দেশের বহু আবেদনকারীর পাঠানো তথ্য বিচার করে এই সংক্রান্ত বিভাগ, চলে বিশ্লেষণ। এরপর একটি তালিকা প্রকাশিত হয়। তারপর ফের চলে বিচার-পর্ব। অবশেষে কমপক্ষে ৩০ জনকে বছরের সেরা 'নাগরিক বিজ্ঞানী' হিসেবে মনোনীত করা যায়। তাঁরা ইমেইলের মাধ্যমে পান শংসাপত্র।
এই বিষয়টি আজীবন থাকে অর্থাৎ নির্বাচিতদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় নাগরিক বিজ্ঞানী হিসেবে, যা আজীবনের সম্মান। যাঁরা নির্দিষ্ট ওই প্রকল্পের বিস্তারের কাজে ডাক পেতে পারেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁদের কাজেও লাগাতে পারে সংস্থা।
নাসার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আমেরিকা ছাড়া অন্য দেশের নাগরিকদের প্রত্যক্ষ সুযোগ না থাকলেও এই বিষয়টি খানিকটা সুবিধা করে দেয় অনেককেই। স্বেচ্ছাসেবকের মতো নাসার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সংস্থার বিজ্ঞানী তকমা জোটে কারও কারও। আবার প্রকল্পের বিস্তারে ডাক এলে সেখানে সাম্মানিকের পরিমাণও থাকে বিপুল। তাই সব মিলিয়ে এই স্বীকৃতি বেশ গুরুত্বেরই বটে।