মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা বিপদ এড়াল নাসা-র অস্ত্র! যেভাবে বিলুপ্তি থেকে বাঁচল মানুষ
DART mission of NASA: নাসা মানবজাতির হতে তুলে দিয়েছে এমন এক অস্ত্র, যা ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরদের হাতে ছিল না।
That's one small step for man, one giant leap for mankind.
২০ জুলাই, ১৯৬৯-এ চাঁদের মাটিতে পা রেখে এই কথাটা বলেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। ব্রহ্মাণ্ডকে চেনার পথে, এবং মানুষকে পৃথিবীর বাইরে প্রথম কোনও মহাজাগতিক বস্তুতে পৌঁছে দিয়ে ভবিষ্যতের অপরিসীম এক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল নাসা। আজ, নাসা আরও একবার, এক বিরাট কর্মকাণ্ডে সাফল্য পেয়েছে। করেছে অসাধ্যসাধন। মানবজাতির হতে তুলে দিয়েছে এমন এক অস্ত্র, যা ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরদের হাতে ছিল না।
The Double Asteroid Redirection Test, সংক্ষেপে DART মিশন। আজ থেকে দশ মাস আগে পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপনের পর এই প্রযুক্তি পাড়ি দেয় পৃথিবী থেকে ৭০ লক্ষ মাইল দূরে থাকা ডিমোরফস নামক এক গ্রহাণুর উদ্দেশ্যে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর এটি ঘণ্টায় ১৪,০০০ মাইলের গতিতে গিয়ে ডিমোরফসকে আঘাত করে। ডিমোরফস আরও একটি গ্রহাণু ডিডিমোসকে প্রদক্ষিণ করে। উদ্দেশ্য ছিল ডিমোরফসকে কক্ষপথচ্যুত করা। গতকাল নাসা ঘোষণা করেছে, সেই কাজে তারা সফল হয়েছে। ডিমোরফসের ১১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের কক্ষপথকে ৪৪ মিনিট কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে তারা। ঘটিয়ে ফেলেছে ইতিহাস। মানবতার ইতিহাসে প্রথমবার পৃথিবীকে গ্রহাণুর বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রযুক্তি চলে এসেছে তাদের হাতে। First ever Planetary Defense System। নাসার অধিকর্তা বিল নেলসন বলছেন, "আমাদের সবারই নিজেদের গ্রহকে রক্ষা করার দায়িত্ব রয়েছে। যতই হোক, এটাই আমাদের একমাত্র ঠাঁই। এই মিশন প্রমাণ করে দিয়েছে যে ব্রহ্মাণ্ড আমাদের দিকে যাই ছুড়ে দিক, তার মোকাবিলা করার জন্য নাসা একেবারেই ঠিক পথে এগোচ্ছে। আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি আমরা কতটা দায়বদ্ধ এই গ্রহের রক্ষাকর্তা হিসেবে। মানবতার ইতিহাসে এ এক বিশেষ সন্ধিক্ষণ।"
আরও পড়ুন: সমুদ্রের জলে হু হু করে বাড়ছে অ্যাসিডের মাত্রা! কোন বিপদ অপেক্ষায়
বিল নেলসনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সহমত হওয়া ছাড়া কোনও উপায়ই নেই, তার কারণ, ইতিহাসে প্রথমবার কোনও বৃহৎ মহাজাগতিক বস্তুর গতির ওপর এইভাবে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করল মানুষ। ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ এই কাজ। এটা ঠিকই যে, আপাতত পৃথিবীর দিকে কোনও গ্রহাণু ধেয়ে আসছে না। সুতরাং ডাইনোসরদের মতো পরিণতিও এই মুহূর্তে হচ্ছে না। কিন্তু পৃথিবী থেকে মাত্র কয়েক লক্ষ কিলোমিটার দূরেই ঘুরে বেড়ায় প্রায় ২৭,০০০ গ্রহাণু। যাদের বলা হয় Near Earth Objects। এছাড়াও মঙ্গল এবং বৃহস্পতির মাঝে রয়েছে গ্রহাণুদের বেল্ট। সেই সঙ্গে এই অপরিসীম ব্রহ্মাণ্ডে লক্ষ কোটি ধুমকেতু এবং গ্রহাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে যারা যে-কোনও মুহূর্তে এসে আঘাত করতে পারে পৃথিবীকে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, আমাদের সৌরজগতের সব থেকে বড় গ্রহ বৃহস্পতি তার মাধ্যাকর্ষণের জেরে এমনিতেই আমাদের এই ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করে আসছে কোটি কোটি বছর ধরে। কিন্তু তার মধ্যেও ডাইনোসরদের বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছিল। সুতরাং, বিপদ যে-কোনও সময়েই আসতে পারে। এতদিন সেই বিপদকে ঠেকানোর কোনও রাস্তা ছিল না মানুষের কাছে। আজ গর্ব করে আমরা বলতে পারব, সভ্যতা হিসেবে আমরা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলাম। আজ আমাদের হাতে সেই বিপদকে ঠেকানোর অস্ত্র চলে এসেছে।
তবে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। গ্রহাণুকে শনাক্ত করতে হবে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। তবেই যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে তাকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করতে। তাছাড়া, সব গ্রহাণু একরকম হয় না। তাদের গঠনও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছে। ডিমোরফসের যে ধরনের গঠন, তাতে মহাকাশযানের ধিক্কার-অভিঘাতে তার শুধুমাত্র কক্ষপথচ্যুতি ঘটেনি, তা অস্বাভাবিকভাবে কম্পিত হচ্ছে। অন্য গ্রহাণুর ক্ষেত্রে ফলাফল একেবারে অন্য কিছু হতেই পারে। সেই সঙ্গে গ্রহাণুর আকারও খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। ডিমোরফস খুব বেশি বড় নয়। তার আকার একটি ফুটবল স্টেডিয়ামের মতো। অনেক গ্রহাণুর আকার বেশ কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হয়। সেক্ষেত্রে রেফ্রিজারেটরের আকারের যন্ত্র সফল হবে কি না, তাও জানা নেই।
তবে এই নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে, এই মিশন চূড়ান্ত সফল। এই ধরনের পরীক্ষা প্রথমবার হলো এবং নাসার কাছে ৭৩ সেকেন্ডের কক্ষপথচ্যুতিও সাফল্য হিসেবে গণ্য হতো। তারপর নাসা হিসেব করে ১০ মিনিটের কক্ষপথচ্যুতি। নাসার বিজ্ঞানীরাও ভাবতে পারেননি যে, তাদের অস্ত্র ডিমোরফসের সময় প্রায় ২৩ মিনিট কমিয়ে দেবে। যা এক বিরাট সাফল্য। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে, এই গ্রহাণু আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে না। কিন্তু প্রথমবার মানুষ এক ধারণা পেল, কীভাবে এই বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব হবে। আজ থেকে চার বছর পর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি হেরা মিশনের মাধ্যমে ডিমোরফস এবং ডিডিমসের সমীক্ষা করতে চলেছে। সেই মিশনের মাধ্যমে জানা যাবে, ডিমোরফসে কতটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে ডার্টের মহাকাশযান। একেবারে নিখুঁতভাবে জানা যাবে ডিমোরফস এবং ডিডিমসের গঠন এবং আকার। যে তথ্য ভবিষ্যৎ সমস্ত মিশনের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
নাসা জানিয়েছে, এই বিশাল কর্মকাণ্ড তারা একা করেনি। এক বিশাল আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের ফলেই এই কাজ সম্ভব হয়েছে। যার মধ্যে সবথেকে বেশি সাহায্য করেছে ইতালিয়ান স্পেস এজেন্সি। এছাড়াও জন হপকিন্স তৈরি করেছে মহাকাশযানটিকে। চিলি, ডেনমার্ক এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও তাদের টেলিস্কোপ এবং মানমন্দিরকে এই মিশনের জন্য ব্যবহার করে নাসা-কে মহামূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে গেছে।
যাবতীয় যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে গবেষণা পুরোদমে এখন চলতে থাকবে। নাসা মনে করছে, তাদের কাজ সবে শুরু হলো। এটা সবে প্রথম পরীক্ষা। আরও অনেক কাজ বাকি। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে এই মিশন কোনও হলিউডের চিত্রনাট্যকেও হার মানাবে। তবে মানবজাতি এখনও পর্যন্ত মহাকাশের কোনও কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি। তবে প্রশ্ন এলেও, তার উত্তর হয়তো মানবসভ্যতার কাছে রয়েছে।