পরিচিত বৃত্তেও সুরক্ষিত নন এদেশের নারীরা, বলছে সরকারি তথ্যই
যতই দেশ অমৃতকালে পৌঁছে যাক, মেয়েদের জন্য ‘আচ্ছে দিন’-এর লড়াই আজও অব্যহত।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরোলেও মহিলাদের অবস্থা খুব বদলেছে বলে মনে হয় না। ঘরে-বাইরে তাঁদের সঙ্গে ঘটে চলা অত্যাচারে রাশ টানা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও অচিরেই বন্ধ হয়ে গেছে সেই স্বর। আর এসব যে কোনও মনগড়া কথা নয় তারই প্রমাণ ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) সদ্য-প্রকাশিত অপরাধ নথি। তাই যতই দেশ অমৃতকালে পৌঁছে যাক, মেয়েদের জন্য ‘আচ্ছে দিন’-এর লড়াই আজও অব্যহত।
এনসিআরবি রিপোর্ট
এনসিআরবি-র জাতীয় অপরাধ নথি অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশজুড়ে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা ঘটেছে মোট ৪ লক্ষ ২৮ হাজার ২৭৮টি। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা ঘটেছে ৫০,০৮৩টি, যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। তালিকার শীর্ষে থাকা অন্যান্য রাজ্যগুলি হলো রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা। অপরাধের হার সবথেকে বেশি উত্তর-পূর্বের রাজ্য অসমে (১৬৮.৩ %)। এ-রাজ্যে মোট কেসের সংখ্যা ২৯,০০০। উড়িষ্যা, হরিয়ানা, তেলেঙ্গানা এবং রাজস্থান রয়েছে এরপরেই। তবে নাগাল্যান্ডে অপরাধের হার (৫.৫%) এবং সংখ্যা (৫৪) দুইই দেশের মধ্যে সবথেকে কম। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে দিল্লিতে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সবচেয়ে বেশি। রাজধানীতে এই হার ১৪৭.৬ এবং শেষ তিন বছরে কেসের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। ২০১৯ সালে দিল্লিতে মোট কেসের সংখ্যা ছিল ১৩,৩৯৫টি যা ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ১৪,২৭৭টি। দেশে ২০ লক্ষর বেশি জনসংখ্যার শহরগুলির মধ্যে ২০২১ সালে অপরাধের হার সর্বাধিক জয়পুরে (১৯৪%) এবং দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দিল্লি (১৪৭.৬%)। তবে কলকাতায় অপরাধের হার সবথেকে কম। অপরাধের চার্জশিট তৈরির হারেও এগিয়ে রয়েছে কলকাতা (৯৩.৯ %) । শেষ তিন বছরে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে দিল্লিতে। এরপরেই রয়েছে মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদের মতো বড় শহরগুলি। তবে পণ-সংক্রান্ত গৃহহিংসা সবথেকে বেশি বাংলাতেই (১৯৯৫২ টি)। তবে পণ-সংক্রান্ত মৃত্যুর ঘটনা সর্বাধিক উত্তরপ্রদেশে। দেশের মোট মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশ মৃত্যু ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। অ্যাসিড আক্রমণেও বাংলা প্রথমের সারিতে (৩০টি)। উত্তরপ্রদেশে ২১টি।
আরও পড়ুন: নারীদের জন্য নিরাপদ কলকাতা! কোথায় দাঁড়িয়ে দেশের অপরাধ মানচিত্র?
ধর্ষণের ঘটনা
তবে ২০২১ সালে রাজস্থানে মহিলাদের ধর্ষণের হার ও সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এমনকী, এই রাজ্যে নাবালিকা ধর্ষণের পরিমাণও দেশের মধ্যে সর্বাধিক (১৪৫৩টি)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশ। গত বছরে মোট ৩১,৬৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দেশজুড়ে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১৯.৩৪% বেশি। ২০১৮ সালে এই ধরনের কেসের সংখ্যা ছিল ৩৩,৯৭৭টি। তবে দেশে গনধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ২০২০ সালের তুলনায় বেড়েছে। এ-বছর মোট ২৮৪টি গনধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টে দেখা গেছে, মোট ধর্ষণের ঘটনার ৯৬.৫% কেসেই অপরাধী মহিলার পূর্বপরিচিত। এর মধ্যে ৮৯% ঘটনায় দেখা গেছে অপরাধী মহিলার বন্ধু, স্বামী, লিভ-ইন পার্টনার বা পারিবারিক সূত্রে আলাপী বা সহকর্মী। পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে দেয় যে, পরিবার, কর্মস্থল এমনকী, কাছের মানুষের কাছেও মহিলারা নিরাপদ নন। বাংলায় পরিচিত ব্যক্তির হাতে ধর্ষণের পর ৯০% মহিলা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তবে কলকাতায় প্রতি এক লক্ষ মহিলার মধ্যে ধর্ষণের হার ০.২%, যা মেট্রোপলিটন শহরগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। মহিলাদের অপহরণের ঘটনাও নেহাত কম নয়। ১২,০০০ নাবালিকা-সহ মোট ২৮,০০০ মহিলাকে অপহরণ করা হয়েছে শেষ এক বছরে। উত্তরপ্রদেশে রাজ্যে অপহরণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি (৮,৫৯৯টি)। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিহার (৬,৫৮৯টি)।
বিচারব্যবস্থার দুর্দিন
শেষ দু'বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনা অতিমারীর কারণে জনজীবন প্রায় থমকে গিয়েছিল। এই অবস্থাতেও মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা চিন্তার কারণ। অন্যদিকে মহিলাদের ধর্ষণের ঘটনায় সবথেকে বেশি সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি মহিলারা। বিচারের অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে বহু পকসো কেস। সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় এফআইআরের হার ১৩.৯ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ, মহিলাদের বিরুদ্ধে বহু অপরাধের ঘটনা ঘটলেও তা পুলিশের কাছে পৌঁছচ্ছে না। রাজধানীর মহিলারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসুরক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও ৩৫৩% কেসই কোর্টে বিচারাধীন। যথেষ্ট ও যথাযোগ্য শাস্তি ছাড়া মহিলাদের জন্য সুরক্ষিত সমাজ কতখানি গড়ে তোলা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি দরকার সমাজের চিন্তাধারা বদলের, নাহলে এক অপরাধীকে শাস্তি দিলেও অন্য কোনও প্রান্তে জন্ম নেবে আরেক অপরাধ। সরকারের তরফেও মহিলাদের প্রতি সার্বিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া জরুরি। মহিলাদের সুরক্ষা প্রদানের স্বার্থে সরকার, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।