হাড়জ্বালানো বাচ্চাকে শান্ত করতেই খেলায় ভর্তি! নীরজের উত্থান এক রূপকথা...
Neeraj Chopra Wins Gold: ক্রিকেটখ্যাপা দেশে বিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মার চেয়েও বেশি মানুষ গুগলে খুঁজেছেন নীরজ চোপড়াকেই।
হিন্দিতে বলে দুধ পিতা বাচ্চা! গোলগাল, সাধারণভাবে ডাকনাম গোলু হওয়াই দস্তুর, পড়শি থেকে স্বজন গাল টিপে দেন সকলেই। অথচ চোখ ছোটর থেকেই ধারালো। যেন লক্ষ্য জানাই আছে, পৌঁছনোর সফর শুরুর অপেক্ষা কেবল। নীরজের চাহনি বদলায়নি, কিন্তু আদ্যোপান্ত সেই গোলগাল বাচ্চা এখন হয়ে উঠেছেন সুঠাম, দৃপ্ত যুবা! হরিয়ানার একটি গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু। কিন্তু জানলে অবাক হতে হয়, এই গোলগাল বাচ্চাকে প্রাথমিকভাবে ওজন কমানোর জন্যই খেলাধুলোয় উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল! তারপর ইতিহাস! ২৫ বছর বয়সেই ভারতের অন্যতম সম্মানীয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব নীরজ, সোনার পদকে ঝুলি ভরেছে তাঁর। বছর দুয়েক আগেই টোকিও অলিম্পিক্সে নীরজের জ্যাভলিনে সোনা জয় অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয়ী হিসেবে তাঁর যাত্রাপথের উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হয়ে ওঠে। এবার বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপেও সোনা জিতলেন নীরজ।
১৭ সদস্যের যৌথ পরিবারে বড় হওয়া নীরজের। এতটাই গোলগাল ছিলেন যে চিন্তায় পড়ে যান বাড়ির লোকেরা। ওজন কমানোর জন্য প্রচণ্ড চাপ দিতে থাকেন সকলে। বয়স তখন মাত্র ১৩। পাড়ায় 'দুষ্টু ছেলে' হিসেবেই খ্যাতি জুটেছে। কখনও গ্রামের গাছে মৌমাছির চাকে ঢিল ছুঁড়ে গোটা পাড়াকে ব্যতিব্যস্ত করছেন, কখনও গোবেচারা মোষের লেজ ধরে টানাটানি করে বিরক্ত করছেন। ছেলের এই পাড়াজ্বালানো দুষ্টুমি থামাতে বাবা সতীশ কুমার চোপড়া পথ খুঁজছিলেন। ওজনও কমবে, দুষ্টুমিও থামবে এই ভেবেই দৌড়ে ভর্তি করিয়ে দেন ছেলেকে। গ্রাম থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পানিপথের শিবাজি স্টেডিয়ামে নীরজকে নিয়ে যান তাঁর কাকা। তবে দৌড়ানোতে মোটেই আগ্রহ ছিল না নীরজের। উল্টে জ্যাভলিন থ্রোয়ের প্রেমে পড়ে যান। বাকিটা তো ইতিহাস!
কিংবদন্তি শ্যুটার অভিনব বিন্দ্রার পরেই, মাত্র ২৩ বছর বয়সেই অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী দ্বিতীয় ভারতীয় হয়ে ওঠেন নীরজ। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনা জেতেন অভিনব বিন্দ্রা। তার আগে অবশ্য অলিম্পিক গেমসে ভারতের আরও আটটি স্বর্ণপদক জেতে হকিতে, দলগত খেলা হিসেবে। অভিনব বিন্দ্রার পরে একই সঙ্গে অলিম্পিক এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছেন নীরজ চোপড়াই৷ অভিনব বিন্দ্রা ২৩ বছর বয়সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছিলেন এবং ২৫ বছর বয়সে অলিম্পিক সোনা জিতেছিলেন। নীরজ যদি এই গতিতেই এগোতে থাকেন তাহলে কালের নিয়মেই আরও সাফল্য অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য। ৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দু'টি অলিম্পিক এবং দু'টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের সুযোগ থাকবে নীরজের।
আরও পড়ুন- সোনা এল ঘরে! আঘাত নিয়েও কীভাবে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়ন হলেন নীরজ চোপড়া?
২০১৬ সালে বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেই আন্তর্জাতিক স্তরে নীরজ চোপড়ার উত্থান। তবে ২০২১ সালের টোকিও অলিম্পিক্সে স্বর্ণপদক জয়ই ছিল সবচেয়ে ঐতিহাসিক ক্ষণ। তবে খ্যাতির বিড়ম্বনাও প্রবল! ওই সোনা জয়ের পর চারদিক থেকে শুরু হাঁকডাক! 'না' করা যায় না সবেতে। একের পর এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হতে ক্লান্তিতে জ্বরও চলে এসেছিল একবার। এত সম্বর্ধনাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয়েছিল তাঁকে যে প্রশিক্ষণে বাধা পড়ে যায়, ওজনও বেড়ে গিয়েছিল খানিক।
লাভজনক এবং খ্যাতিজনক খেলা এ দেশে ক্রিকেটই। ব্যবসার সমস্ত ক্ষেত্রই এখানে উন্মুক্ত। সেই ক্রিকেটখ্যাপা দেশে বিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মার চেয়েও বেশি মানুষ গুগলে খুঁজেছেন নীরজ চোপড়াকেই। গত ডিসেম্বরে নীরজ চোপড়া বিশ্ব রেকর্ডজয়ী কিংবদন্তি স্প্রিন্টার উসেইন বোল্টকে সরিয়ে বিশ্বের 'মোস্ট ভিজিবল' এবং 'রিটেন-অ্যাবাউট' অ্যাথলিট হয়ে ওঠেন। নীরজ চোপড়াকে নিয়ে ৮১২টি নিবন্ধ রচিত হয়েছে এখনও, এরপরেই আছেন জামাইকান স্প্রিন্ট ত্রয়ী এলেন থম্পসন-হেরাহ (৭৫১), শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস (৬৯৮) এবং শেরিকা জ্যাকসন (৬৭৯)।
ভারতে ক্রিকেটই যে সব নয়, প্রমাণ করেছিলেন অভিনব, প্রমাণ করেছেন নীরজ। বর্তমানে ভারতে ৬ জনেরও বেশি জ্যাভলিন থ্রোয়ার আছেন যারা ৮০ মিটারের উপরে বর্শা নিক্ষেপ করতে পারেন। নীরজের অলিম্পিকে সোনা জয়ের মুহূর্ত, মানে ৭ অগাস্ট দিনটিকে এখন জাতীয় জ্যাভলিন দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সেই জয়ের পর থেকে গত দুই বছরে নীরজ যে সব প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন তাতে তিনি ৮৬ মিটারের উপরেই জ্যাভলিন ছুঁড়েছেন। চাহনি বদলায়নি, বরং ধারালো হয়েছে ঢের বেশি।