গালাগাল খেলেই বলে, "ডার্ক জোক লিখেছি, সমাজ আমায় বুঝল না!"

Dark Comedy: আমাদের এখানে এই ধরনের কোনও কমিক নেই। যারা ছিল, তারা এখন কেসের ঠেলা সামলাচ্ছে। বেশ হচ্ছে।

পৃথিবী নামক ডিলুলুতে যে ক'টি স্ট্যান্ড আপ কমিক নামক কার্বন-বেসড অর্গানিজম হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে, তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম নামখানা বোধহয় ডেভ শ্যাপেল। যাঁরা এই নামটা প্রথমবারের জন্যে শুনলেন তাঁদের জন্য বলি, ডেভ শ্যাপেল হলেন কমেডির শচিন তেন্ডুলকার। একমেবাদ্বিতীয়ম। ক্লিয়ার? বেশ! শুরু করি।

ডেভবাবু সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম কমিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ বিতর্কিত একজন মানুষও বটে। তিনি ‘ট্রান্স’ কমিউনিটির মানুষদের নিয়ে প্রচুর 'জোক' বলেন। ফলে তারা রেগে যান। সোশ্যাল মিডিয়ায় রাগ দেখান। ক্ষমা চাইতে বলেন। আর ডেভ এই সমস্তটায় পাত্তা না দিয়ে আবারও সেই একই কাজ করেন। জোক বলেন। যেমন বলেছেন তাঁর এক বন্ধুর কথা, ড্যাফনি। ড্যাফনি একজন ট্রান্স মহিলা। মানে এমন একজন মহিলা যিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনায় পুরুষের শরীরে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তারপর সেই বিড়ম্বনাকে অস্বীকার করে, নানা বাধা বিপত্তি, সমাজের কটুক্তি, ডেভের মতো কমেডিয়ানদের জোক উপেক্ষা করে, গর্বিত ভাবে নারীত্বের উদযাপন করেছেন। ড্যাফনি নিজেও একজন স্ট্যান্ড আপ কমিক। ডেভ শ্যাপেলের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় একটি শো-তে। সেখান থেকে আলাপ গড়ায় বন্ধুত্বে। সেই বন্ধুকে ডেভ তাঁর নিজের শো-তেও পারফর্ম করার সুযোগ করে দেন। বন্ধুর পর মঞ্চে ওঠেন। ড্যাফনি তখন সামনের সারির চেয়ারে। দুই বন্ধু, একে অপরের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করে আর শো-টা একটা স্ট্যান্ড আপ কমেডি শো-এর থেকেও অনেক বেশি কিছু হয়ে ওঠে।

ডেভ শ্যাপেল

ডেভ ট্রান্স কমিউনিটি নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন কারণ তিনি বুঝতে চাইছিলেন তাঁর বন্ধুকে, তাঁর বন্ধুর মতো মানুষদের। ড্যাফনি সেই সব প্রশ্নের এমন সমস্ত উত্তর দেন যাতে গোটা হল হাততালি, বাহবা আর হাসিতে ফেটে পড়ে। শুধু ড্যাফনি হাসেন না। তিনি একটা সময় পর চিৎকার করে যা বলেন, সেটার বাংলা করলে দাঁড়ায়, "তোমায় তো কেউ আমায় বোঝার দায়িত্ব দেয়নি, আমি একজন মানুষ যে নতুন অজ্ঞিতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আমায় একটু বিশ্বাস করো ব্যাস।" হিউম্যান এক্সপেরিয়েন্স বলেছিলেন ড্যাফনি। এরপর থেকেই দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। কিন্তু ওই যে, আগেই বললাম বিতর্ক। আবারও ট্রান্স কমিউনিটির রোষের মুখে পড়েন ডেভ। শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল। ডেভের আবারও কিছু যায়-আসে না কিন্তু ড্যাফনির যায়-আসে। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বন্ধুর সমর্থনে একটা পোস্ট দেন। ব্যাস, যাবি কোথায়! শুরু হয় ড্যাফনিকে ম্যালাইন করা। তা এমন পর্যায়ে যায় যে ডেভ শ্যাপেলের বন্ধু, একজন ট্রান্স মহিলা ড্যাফনি ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন। ডেভ যখন এই কথাটি বলেন তখন গোটা হল স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ ডেভ বলেছিলেন, "আমার বন্ধু ছাদ থেকে লাফিয়ে নিজেকে মেরে ফেলেছে"। ব্যাক্তিগত। ভীষণ ভীষণ ব্যক্তিগত। কিন্তু ঠিক তারপরেই ডেভ বলেন,

"আমার বন্ধু সারাজীবন নিজেকে মহিলা হিসেবে চিনেছে কিন্তু ছাদে উঠে লাফানোর জন্যে যে খারাপ দুঃসাহস দরকার সেটা শুধুমাত্র একটা ছেলেরই থাকে।"

এইটা একটা ডার্ক জোক। এইটা।

আরও পড়ুন- আজ ‘অজাচার’, কাল মেয়েদের কটূক্তি! রণবীরদের সব ‘ডার্ক কমেডি’ আমাদের নজরে আসে?

মৃত বন্ধুকে নিয়ে অমন একটা জোক লেখা তখনই সম্ভব, যখন একজন শিল্পী নিজ শিল্পের জন্যে তাঁর গোটা জীবনটা, অন্তরটা নিংড়ে ফেলেছেন। না হলে এই দখল থাকার কথা নয়। কারণ তারপরই ডেভ শ্যাপেল বলবেন যে, ড্যাফনির একটি কন্যাসন্তান আছে। ডেভ তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই মেয়েটির জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন যেটা মেয়েটি সাবালিকা হওয়ার পর ডেভ নিজে তাঁর হাতে তুলে দেবেন। আর নিজের বন্ধুর মেয়েটিকে একটি কথা বলবেন যেটা বলবার জন্য বর্তমানে তিনি প্রস্তত নন। কথাটা হলো, “আমি তোমার বাবাকে চিনতাম, তিনি একজন দারুণ মহিলা ছিলেন।”

এইটাও একটা ডার্ক জোক। এইটাও।

কে বলছেন? ডেভ শ্যাপেল বলছেন। কে ডেভ শ্যাপেল? সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কমেডিয়ানদের একজন। কার ব্যাপারে বলছেন? নিজের বন্ধুর ব্যাপারে। এই ডেভই বলেছেন যে, ওঁর ট্রান্স মানুষদের ঈর্ষা হয় যে কী চমৎকারভাবে ওরা নিজেদের মুভমেন্টকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! কী অর্গানাইজড! কী ঐক্য ওদের মধ্যে! ডেভ শ্যাপেল কৃষ্ণাঙ্গ। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে চলা মুভমেন্ট নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন ওই কথা।

সেটাও কারও অফেন্সিভ লাগতে পারে। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কোনও কিছুই আর অসম্ভব না।

শ্যাপেলের মতোই রিকি জার্ভিস, সারা সিলভারম্যান, নর্ম ম্যাকডোনাল্ড, বিল বার এমন আরও অনেকের নাম করা যায় যাঁরা ব্যাকল্যাশকে পাত্তাই দেন না। অ্যান্থনি জেসলনিক বা জিম কারের মতো কমেডিয়ানদের শো-তে মানুষ যায়ই অফেন্সিভ জোক শুনবে বলে। কারণ কমেডির বিভিন্ন শাখার মধ্যে ডার্ক বা মরবিড কমেডিও একটা শাখা। যে শাখার জোক লেখা সবচেয়ে কঠিন। কারণ স্ট্যান্ড আপ কমেডি এই গোটা মহাবিশ্বে একমাত্র এমন এক আর্টফর্ম যেটা একা একা প্র্যাকটিস পর্যন্ত করা যায় না। দর্শক দরকার হয়। আপনি প্রথমে মাথা খাটিয়ে এক ঘণ্টার জোক লিখবেন। তারপর সেটা অনেকগুলো ওপেন মাইকে করার পর দু’মিনিটের হয়ে যাবে। কারণ ওই শুধুমাত্র ওই দু’মিনিটেই মানুষ হাসছে। তারপর আবার লেখা। আবার ওপেন মাইক। চার মিনিট। এইভাবে অনেকটা সময় পর আপনার হাতে একটা একঘণ্টার ‘সেট’ থাকবে যেটা নিয়ে আপনি কনফিডেন্ট। তারপর আপনি এক-দেড় বছর ধরে সেই একই জিনিস পারফর্ম করবেন। করতে করতে আপনার রিফ্লেক্স বাড়বে, একটা কথার চারটে উত্তর মাথায় ঘুরবে। প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস। ডার্ক হোক বা ক্লিন, জোক লেখার এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

যে ‘ডার্ক জোক’ নিয়ে বর্তমানে সকলে হাঁইহাঁই করছে সেটা না ডার্ক, না জোক। সর্বোপরি সেটাও আবার চুরি করা। ওই জোক নিয়ে আলোচনা করার কোনও মানে নেই।

আরও পড়ুন- মফসস্‌লের উস্কোখুস্কো চরিত্ররা, বানি হতে চেয়ে, নয়না হয়ে গেল যারা…

একজন কমিক যখন কোনও জোক দর্শকদের সামনে বলছেন, তখন তিনি দু'ভাবে ভাবতে পারেন। এক, আমার যা প্রাণ চায় আমি তাই বলব, তাতে কেউ রেগে গেলে যাবে। তখন তাঁকে প্রস্তুত থাকতে হবে সেই রাগটার জন্য। কারণ সেই কমিকের যেমন সেই জোক জনসমক্ষে বলার অধিকার আছে, তেমনই শ্রোতারও রেগে যাওয়ার অধিকার আছে। একশোবার আছে। দুই, যে পরিসরে দাঁড়িয়ে কমিক সেই জোকটা বলছেন সেই পরিসরকে ভালো করে চিনতে হবে। সেখানকার দর্শকদের, শ্রোতাদের বাস্তবতা জানতে হবে। তাদের মনন ধরার চেষ্টা করতে হবে। ব্যাস সেফ গেম!

কিন্তু দুটো একসঙ্গে হয় না। কারণ এমন কোনও জোক আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি যেটায় কেউ অফেন্ডেড হবে না!

ড্যাফনি

যে জোকে আমি হাসব, সেই জোক আপনার অফেন্সিভ মনে হতেই পারে। আবার যে জোকে আপনি হাসবেন সেই জোক শুনে আমার বিরক্ত লাগতেই পারে। কিন্তু হাসিটা ইম্পর্টেন্ট। হাসছেন মানে ওটা জোক। সে ওই জোক আর কারও ভালো লাগুক, ছাই না লাগুক। তাই সমস্যাটা জোকে নয়। সমস্যাটা কমিকের না। দর্শকদেরও সমস্যা না। সমস্যাটা মব মেন্টালিটির। একজন মানুষকে কোনও কারণে পাঁচজন লোক গালাগাল করছে। মানুষটার সঙ্গে একজন আছে। দুই বনাম পাঁচ। আমি তাহলে গালাগাল পক্ষে যাই। ছয় বনাম দুই। ব্যাস। হয়তো বিষয়টার সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই কিন্তু তাও আমি গালাগাল করব! কারণ আমি চাই আমার একটা দল, একটা লেবেল, একটা মব যারা আমায় সাপোর্ট করবে। এমনও তো হতে পারে যে সর্বশ্রেষ্ঠ গালাগালটা দিলে আমি বিখ্যাতও হয়ে যাব। লোকে বলবে ‘বাহ কী দিলি ভাই’। আজ ডার্ক জোক নিয়ে হচ্ছে। পরশু অন্য কিছু নিয়ে হবে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েকটা উঠতি গাধাও মাঝেমধ্যেই এই নেশায় ভুলভাল কিছু একটা লিখে ফেলে। তারপর যেই গালাগাল খায়, সঙ্গে সঙ্গে বলে ডার্ক জোক লিখেছি। সমাজ আমায় বুঝল না!

না বান্টি। না। অত সোজা না।

ডেভ শ্যাপেলের আরেকটা গপ্পো দিয়েই এই অমূলক লেখাটি শেষ করি। ডেভ তখন ‘শ্যাপেল শো’ করছেন। সেই সময়ে চ্যানেল কর্তৃপক্ষের তরফে তাঁকে একটা বিশেষ শব্দবন্ধ বলতে বারণ করা হয় একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষদের নিয়ে। ডেভ বলেন তিনি তো কথায় কথায় ‘নিগার’ শব্দটিও ব্যবহার করেন, তাহলে? তখন কর্তৃপক্ষ বলে যে, না, ডেভ সেই বিশেষ শ্রেণির মানুষদের নিয়ে সেই বিশেষ কথাটা বলতে পারেন না তার কারণ ডেভ সেই শ্রেণির অর্ন্তভুক্ত নন। তার উত্তরে ডেভ বলেছিলেন, 'ভাই আমি নিগারও নই!'

Ps. এই লেখাটি পড়ে যারা অফেন্স নেওয়ার কথা ভাবছেন কেন আমি এখানকার কমিকের উদাহরণ দিলাম, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই আমাকে ডার্ক জোক, অফেন্সিভ কমেডি— এইসব নিয়েই লিখতে বলা হয়েছিল। আমাদের এখানে এই ধরনের কোনও কমিক নেই। যারা ছিল, তারা এখন কেসের ঠেলা সামলাচ্ছে। বেশ হচ্ছে। এখানকার স্ট্যান্ড আপ নিয়ে যদি কখনও লিখতে বলা হয়, তাহলে আপনার জন্য লিখতে পারব এক পৃথিবী। চিয়ার্স।

More Articles