ছাত্র বিক্ষোভ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ! যা যা ঘটল নেপালে
Nepal’s Prime Minister KP Sharma Oli: সরকার ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরেও জেন জি-র ছেলেমেয়েরা ৮ সেপ্টেম্বর সকালে টিকটক ও রেডিটের মতো বিকল্প প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে একসঙ্গে হয়ে আন্দোলনে নামেন।
রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে নেপাল। প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ, সহিংসতা আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম। মন্ত্রীদের ইস্তফা এবং প্রাণহানির ঘটনায় কাঠমান্ডু কার্যত টালমাটাল। সূত্রের খবর সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়েছেন সদ্যপ্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি শর্মা। দেখে নেওয়া যাক— কীভাবে শুরু হল এই আন্দোলন এবং এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে নেপাল?
জেনারেশন জি-এর নেতৃত্বে কে পি শর্মা ওলি সরকারের দুর্নীতি ও সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদে নামেন নেপালের হাজার ছাত্রছাত্রী। প্রথমে অনলাইনে প্রতিবাদ শুরু হয়। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর রাস্তায় নেমে আসে, পার্লামেন্টের কাছে পৌঁছতেই প্রতিবাদকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
নেপাল সরকার ঘোষণা করেছিল— ২৬টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব–সহ জনপ্রিয় মাধ্যমগুলিকে নিষিদ্ধ করার কথা জানানো হয়।
সরকার দাবি করে এটি “নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা”। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি আনরেজিস্টার্ড সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের পক্ষে কথা বলেন, "জাতির বিরুদ্ধে কোনো কাজ সহ্য করা হবে না।" তিনি ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) সম্মেলনে বলেন, পার্টি "সবসময় অনিয়ম ও অহংকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং জাতিকে দুর্বল করে এমন কোনো কাজ মেনে নেবে না।" তিনি প্রশ্ন তোলেন, "জাতির স্বাধীনতা কয়েকজনের চাকরি হারানোর চেয়ে বড়। আইন অমান্য করা, সংবিধানের অবমাননা, এবং জাতীয় মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অবমাননা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে"। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম বিষয়টিকে “কণ্ঠরোধ” এবং সরাসরি সেন্সরশিপ হিসেবে দেখছে। তাঁদের মূল স্লোগান ছিল— “স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ফিরিয়ে দাও”।
মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোকে ২৮ অগাস্ট থেকে সাত দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশনের সময় দেওয়া হয়েছিল। তবে ৩ সেপ্টেম্বর রাতে সময়সীমা শেষ হওয়ার পরেও ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, এক্স, রেডিট ও লিঙ্কডিনের মতো কোনো প্রধান প্ল্যাটফর্ম আবেদন জমা দেয়নি।
সরকার ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরেও জেন জি-র ছেলেমেয়েরা ৮ সেপ্টেম্বর সকালে টিকটক ও রেডিটের মতো বিকল্প প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে একসঙ্গে হয়ে আন্দোলনে নামেন। হাজার হাজার তরুণ প্রতিবাদকারী সরকার ও তার নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মাইটিঘর মণ্ডলা থেকে পার্লামেন্টের দিকে এগিয়ে যান। পার্লামেন্টের কাছে বিক্ষুব্ধরা পৌঁছলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তা ভেঙে ফেলেন। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে। বিশৃঙ্খলার মধ্যে কিছু প্রতিবাদকারী পার্লামেন্ট প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। ভিডিও ও ছবিতে দেখা গিয়েছে, টিয়ার গ্যাস, রবার বুলেট ছুঁড়ছে পুলিশ। আর প্রতিবাদকারীরাও পুলিশের উপর পাল্টা আক্রমণ করেছেন।
এরপর সরকার আন্দোলন দমনে আরও কড়া পুলিশি ব্যবস্থা নেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করতে দেশজুড়ে কার্ফু জারি করা হয়। নিরাপত্তাবাহিনী গুলি চালালে বেশ কয়েকজন প্রতিবাদকারী আহতও হন। এখনও পর্যন্ত অন্তত ১৯ জন নিহত, ২৫০-এরও বেশি আহত। সংঘর্ষে প্রথম দিনেই ৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল, আহত অন্তত ৮০।
বিদ্রোহের মুখে পুলিশ গুলি চালালে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। বিক্ষোভকারীরা একাধিক মন্ত্রীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। সহিংসতার জেরে সরকারের ভেতরে বিভাজন দেখা দেয়। একে একে নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ফলে ওলি শর্মার সরকার কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েন। কে পি শর্মা ওলিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হতে থাকে চিকিৎসার অজুহাতে প্রাইভেট বিমানে দুবাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঘটনাপ্রবাহ হুবহু যেন মিলে যায় শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ত্যাগের সঙ্গে। অবশেষে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন কে পি ওলিও।
কে পি ওলি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনেকদিন ধরেই সরব নেপাল। পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেও ক্ষোভ ছিলই। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করেছে। বিক্ষোভের পুরো ভাগে ছাত্রছাত্রীরা থাকলেও, এই বিক্ষোভে দক্ষিণ পন্থীরাও সামিল হয়েছেন বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বিক্ষোভকারীদের ১৯ জনের মৃত্যুর পর সরকার এখন সামাজিক মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। তবে নেপালের পরিস্থিতি এখনও উত্তপ্ত। প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা ও নতুন রাজনৈতিক সমাধানের দাবিতে তরুণ প্রজন্ম এখনও রাস্তায়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসেও একই ভাবে অভ্যুত্থানে শামিল হন বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা। আন্দোলনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নেপালের বর্তমান সঙ্কট শুধু সরকারের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেনি, বরং ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকার ইঙ্গিতও দিয়েছে। স্বাধীন মতপ্রকাশ ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে ছাত্র-যুব সমাজের এই প্রতিবাদ নেপালের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় ।

Whatsapp
