নিউইয়র্কের ফার্স্ট লেডি রামা দুয়াজি মনে করাচ্ছেন ডায়নাকে
Rama Duwaji: রামা দুয়াজির শিল্পকর্মে রাজনৈতিক অবস্থানও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ইনস্টাগ্রামে প্রকাশিত তাঁর বেশ কিছু কাজ সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করে।
নিউইয়র্ক সিটির নতুন ইতিহাস লিখতে চলেছেন রামা দুয়াজি। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি হতে চলেছেন শহরের সর্বকনিষ্ঠ ফার্স্ট লেডি। স্বামী জোহরান মামদানি মেয়র নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন তিনি। বিজয় বক্তৃতায় স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মামদানি বলেন, “আমার অসাধারণ স্ত্রী রামা, হায়াতি— এই মুহূর্তে এবং প্রতিটি মুহূর্তে আমি তাঁর চেয়ে বেশি আর কাউকে আমার পাশে চাই না।” আরবি শব্দ ‘হায়াতি’ অর্থ “আমার জীবন”।
সিরিয় বংশোদ্ভূত রামা দুয়াজি পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। তাঁর ক্যানভাসে প্রায়ই ফুটে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষ। বিবিসি নিউজ, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ভাইস প্রভৃতি আন্তর্জাতিক মাধ্যমে তাঁর কাজ প্রকাশিত হয়েছে; লন্ডনের টেট মডার্ন জাদুঘরেও স্থান পেয়েছে তাঁর শিল্পকর্ম। রামা দুয়াজি ও জোহরান মামদানির পরিচয় হয় একটি ডেটিং অ্যাপ, হিঞ্জ-এ।
নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম দিকে স্বামীর পাশে তাঁকে খুব একটা দেখা যায়নি। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিলেন— মামদানি নাকি ইচ্ছে করেই স্ত্রীকে আড়ালে রাখছেন। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে নিজেদের পারিবারিক মূল্যবোধ তুলে ধরতে স্ত্রী বা স্বামীকে প্রচারের মুখ করে তোলেন। তাই দুয়াজির অনুপস্থিতি অনেকেরই চোখে পড়ে। তবে এই সমালোচনার জবাব দেন মামদানি নিজেই। গত মে মাসে নিউইয়র্ক সিটি ক্লার্কের অফিসে তাঁদের বিয়ের কিছু ছবি প্রকাশ করে তিনি লেখেন, “আজকের টুইটারই বোঝা যায় রাজনীতি কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। সাধারণত আমি এসব মন্তব্য এড়িয়ে যাই, তা সে হুমকি হোক বা আমাকে দেশছাড়া করার ডাক। কিন্তু যখন প্রিয়জনদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখন সেটা একেবারেই ভিন্ন বিষয়। আমার মতের সমালোচনা করুন, কিন্তু আমার পরিবারকে ছেড়ে দিন।” প্রচারের আলোয় না এসেও, পর্দার আড়ালে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন দুয়াজি। সিএনএন জানিয়েছে, মামদানির প্রচারণায় ব্যবহৃত হলুদ, কমলা ও নীল রঙের গ্রাফিক্স ও ফন্ট নির্বাচনে তাঁর পরামর্শ ছিল।
আরও পড়ুন
কোটিপতিদের শহরে সাধারণের মেয়র! কী ভাবে হলেন মামদানি?
টেক্সাসের হিউস্টনে জন্ম নেওয়া রামা শৈশবে পরিবার সঙ্গে দুবাইয়ে চলে যান, পরে কিছুদিন কাটান কাতারে। আরবি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর পরিবার সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের আদি বাসিন্দা। মামদানি প্রশাসনে তিনি কেমন ভূমিকা নেবেন, তা নিয়ে জল্পনা বাড়লেও, পরিচিত মহলে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রশংসা শোনা যায়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁর বন্ধু হাসনাইন ভাট্টি বলেন, “রামা আমাদের সময়ের আধুনিক প্রিন্সেস ডায়ানা।”
রামা দুয়াজি ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে নিউইয়র্কের স্কুল অব ভিজুয়াল আর্টস থেকে ইলাস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তাঁর শিল্পকর্মের বেশিরভাগই কালো-সাদা রঙে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফুটে উঠেছে আরব বিশ্বের মানুষ ও জীবনের চিত্র। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুয়াজি টেক্সাসে জন্ম নেওয়া এক সিরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিনি। ২০২২ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ডকুমেন্টারি “হু কিল্ড মাই গ্র্যান্ডফাদার”-এ তাঁর কিছু চিত্র ব্যবহৃত হয়েছিল। ওই ডকুমেন্টারিটি ১৯৭৪ সালে এক ইয়েমেনি রাজনীতিবিদের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
রামা দুয়াজির শিল্পকর্মে রাজনৈতিক অবস্থানও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ইনস্টাগ্রামে প্রকাশিত তাঁর বেশ কিছু কাজ সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করে। তিনি ইজরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ‘জাতিগত নিধন’-এর প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর এক শিল্পকর্মে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহমুদ খলিলের প্রতিও সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলার কারণে ট্রাম্প প্রশাসন খলিলকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল, আর তাঁর কাজকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ বলে সমালোচনা করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন
ট্রাম্প-মাস্কের হুঙ্কারকে দুয়ো! ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি
ব্রুকলিনের বাসিন্দা হলেও মহামারির সময় দুয়াজি ছিলেন পরিবারের সঙ্গে দুবাইয়ে। ইয়াং ম্যাগাজিন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তাঁর পরিবার এখনও সেখানে থাকে। সেই সাক্ষাৎকারে তাঁকে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান অস্থিরতা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন এবং অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়াকড়ি বাড়ার মতো নানা বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, “নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান অবস্থা সত্যিই হতাশাজনক। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।” দুয়াজি আরও বলেন, “আজ এত মানুষ ভয়ে চুপ করে যাচ্ছে। আমি অন্তত আমার কণ্ঠ ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে যতটা সম্ভব সচেতনতা তৈরি করতে চাই।”
শিল্পীদের সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি কিংবদন্তি গায়িকা নিনা সিমোন-কে উদ্ধৃত করে বলেন, “একজন শিল্পীর কর্তব্য হলো তাঁর সময়ের প্রতিফলন ঘটানো।” দুয়াজির মতে, “অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। আর শিল্পের মাধ্যমে তা করাও যায়। আমি মনে করি না যে প্রত্যেক শিল্পকেই সরাসরি রাজনৈতিক হতে হবে, কিন্তু শিল্পের সৃষ্টির ধরন, অর্থায়ন এবং প্রচার— সবেতেই রাজনীতির প্রভাব থাকে। এমনকি যেসব শিল্প আমরা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মুক্তির আশায় তৈরি করি, সেগুলিও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকই হয়ে ওঠে। শিল্প হলো আমাদের চারপাশের জগতের প্রতিক্রিয়া।”
নিউইয়র্কের সর্বকনিষ্ঠ ফার্স্ট লেডি হিসেবে রামা দুয়াজির এখন নতুন এক যাত্রা শুরু। তাঁর সৃজনশীলতা নিউ ইয়র্কের মানুষদের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলবে, তাই এখন দেখার।

Whatsapp
