পিকে বিজেপির গোপন তাস, কেন বলছেন নীতীশ? বিস্ফোরক অভিযোগের আড়ালে কোন সত্যি
Nitish Kumar-Prashant Kishore: নীতীশ কুমারকে ঘায়েল করতে বিজেপির রাজনৈতিক অস্ত্র হবেন প্রশান্ত কিশোর?
রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু অথবা শত্রু বলে কিছু হয় না! রাজনৈতিক আঙিনায় বারবার সার্থক হয় এই প্রবাদবাক্য। দেশের কোনায় কোনায় মুহূর্তেই বদলে যায় সমীকরণ। শত্রু হয় মিত্র আর মিত্র হয় শত্রু! কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ফের আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসছে গো-বলয়ের অন্যতম রাজ্য বিহারের নাম। চলতি বছরের অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে নীতীশ কুমারের মনবদল এবং তেজস্বী যাদবের হাত ধরে বিজেপি-প্রত্যাখ্যানের পরেই রাজনীতির অলিন্দে জেঁকে বসেছে বিহার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজিওয়াল অথবা দক্ষিণের একাধিক রাজ্যের প্রভাব ছাড়িয়ে বিজেপি এবং নীতিশ লড়াই জায়গা করেছে আলোচনার টেবিলে। আর এখানেই নীতিশের মনবদলে সরব হয়েছেন তাঁর পুরনো বন্ধু, জল্পনা-কল্পনায় দেশের সর্বোৎকৃষ্ট রাজনৈতিক বুদ্ধির অধিকারী প্রশান্ত কিশোর। নীতিশের দল জনতা দল ইউনাইটেড-এর প্রাক্তন সহ-সভাপতি প্রশান্ত 'জন সুরজ যাত্রা'র আবহে বিহার চষে বেড়াচ্ছেন। সেই সূত্রেই সোমবার সিতাগঢ়ী জেলায় দাঁড়িয়ে দিল্লি সফররত বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রসঙ্গে পিকে বলেন, ''এক মাস আগে তিনি শাসকের আর এক মাস পরে বিরোধীদের। ওঁ কী করবেন ওঁ জানেন! মানুষ সব বোঝেন। রাজনীতিতে সকলের যা কিছু করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে বিহারের নীতীশ কুমার প্রভাব পড়বে না বলেই মনে হয়।''
প্রসঙ্গত, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে মোদি-বিরোধী মুখ কে? এই জল্পনায় ইন্ধন জুগিয়ে দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন নীতীশ। রাহুল গান্ধী সহ একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। পোড়খাওয়া রাজনীতিক মুখে 'বিরোধী মুখ' না হওয়ার কথা বললেও তাঁর সঙ্গে তেলঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের সাক্ষাৎ জল্পনা বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে পুরনো বন্ধু প্রশান্ত কিশোর নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন নীতিশ কুমার। দিল্লিতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ''ওঁকে আমার সঙ্গেই কাজ করতে বলেছিলাম। কিন্তু ওঁ বিভিন্ন দলের হয়ে কাজ করেছে। এটা ওঁর ব্যবসা। হয়তো বিজেপির হয়ে গোপন কোনও পথে কাজ চালাচ্ছেন প্রশান্ত।''
কিছুদিন আগে পর্যন্ত 'বন্ধু' বিজেপির হাত ছেড়ে দেওয়ার পর নীতীশের গেরুয়া-বিক্ষোভে প্রশান্তের নাম জড়িয়ে দেওয়া বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তাহলে কি ফের বিজেপি-র সঙ্গেই কাজ করছেন প্রশান্ত কিশোর? এই প্রসঙ্গেই উঠে আসছে বিজেপি এবং প্রশান্ত কিশোর সম্পর্কের ইতিহাস।
আরও পড়ুন: হাওয়াই চটি বনাম পল্টুরাম || দেশে বিজেপি-বিরোধী মুখ হিসেবে বেশি এগিয়ে কে?
২০১১ সাল। এর আগের প্রায় ৮ বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের হয়ে কাজ করেন বিহারের রোহতাস জেলার প্রশান্ত। এরপর গুজরাতের নির্বাচন এবং কঠিন সময়ে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার নেপথ্য-কারিগর হিসেবে উঠে আসে তাঁর নাম। দেশে পরিচিত হতে শুরু করেন মোদির 'বন্ধু' ভোটকুশলী প্রশান্ত। ২০১২ সালে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে ফের জয় পান নরেন্দ্র মোদি। গুজরাতে সফল মোদির সঙ্গেই সফল হন প্রশান্ত কিশোর (Prashant Kishor)। 'সিটিজেনস্ অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবল গভর্নেন্স' বা সিএজি নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন ২০১৩ সালে। যাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কাজ করা শুরু করে পরামর্শদাতা হিসেবে। এই সংস্থার অধারেই নরেন্দ্র মোদি-র, (Narendra Modi) অর্থাৎ বিজেপির হয়ে ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের কাজ করেন প্রশান্ত। 'চায়ে পে চর্চা', 'থ্রিডি জনসভা', 'রান ফর ইউনিটি'র মতো একাধিক কর্মসূচি নেওয়া হয়। এখানেও সফল হন প্রশান্ত কিশোর। মোদি-ঝড়ে দেশের ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় কংগ্রেস। ২০১৫ সালে ওই সংস্থা থেকেই তৈরি হয় 'আইপ্যাক' (I-PAC)। তারপর বিহারে নীতীশ কুমারের দলের হয়ে কাজ করে সফল হন প্রশান্ত। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। পরে ২০১৮ নাগাদ জনতা দল ইউনাইটেডে-র সহ-সভাপতি হন তিনি। এর মাঝে ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী কংগ্রেসের হয়ে কাজ করে ব্যর্থ হন পিকে। এর মাঝেই পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে কাজ করে তাঁর সংস্থা। দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি-র হয়ে ২০২০-তে কাজ করে আইপ্যাক। ক্রমশ বিজেপি এবং প্রশান্ত সম্পর্কের অবনতি হয়। ২০২১-এ বাংলায় এবং তামিলনাড়ুতে কাজ করে তাঁর সংস্থা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এমকে স্তালিনকে জেতাতে সফলতা পান প্রশান্ত কিশোর। ওই বছরই পাকাপাকি আইপ্যাক থেকে বিদায় নেন তিনি।
সফল ভোটকুশলীর জীবনপথে বিজেপি, বিশেষত মোদির প্রভাব যে অন্যতম, তা অস্বীকার করেন না তিনিও। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং প্রশান্ত কিশোরের বিচ্ছেদ অক্সিজেন যোগায় বিজেপি বিরোধীদের। এবং সেই পথেও সফল হন তিনি। তবে ২০২১ পরবর্তী সময়ে দেশীয় রাজনীতির অলিন্দে বিরোধী ঐক্য এবং নতুন কংগ্রেসের প্রকাশে অন্যতম ভূমিকা নিয়েও সফল হননি প্রশান্ত। মোদি বিরোধিতায় এক ছাতার তলায় বিরোধীদের অবস্থানের চেষ্টা করেও খুব একটা কাজের কাজ হয়নি এখনও। এই অবস্থাতেই পিকে-র কিছু মন্তব্য ফের বিজেপি-সম্পর্ক নিয়ে জল্পনা বাড়ায়। একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ''কেউ যদি ভাবে আগামী ২০-৩০ বছরে বিজেপিকে বাদ দিয়ে ভারতের রাজনীতি আবর্তিত হবে সেটা ভাবা মারাত্মক ভুল হবে। হয় বিজেপি অথবা বিজেপি-র বিরোধিতা, এই সূত্রেই দেশের রাজনীতি এগোবে।'' আর এই আবহেই নীতীশ-বিরোধী মন্তব্য, দেশে বিহারের রাজনীতির প্রভাব না পড়ার ভাবনা এবং নীতীশের বিজেপি-প্রশান্ত সম্পর্ক মন্তব্য বিতর্ক বাড়িয়েছে। শোনা যায়, মোদি বিরোধী মমতার বর্তমান অবস্থানে ভূমিকা রয়েছে পিকে-র। আবার এ-ও শোনা যায় মমতার সঙ্গে এখন খুব একটা যোগাযোগ রাখেন না পিকে। এখানেই উঠছে প্রশ্ন, তাহলে কি ফের মোদি আর পিকে-র বন্ধুত্ব গাঢ় হচ্ছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পিকে-র বর্তমান অবস্থান কি ফের ২০১৪-র অবস্থা সৃষ্টি করবে? অর্থাৎ ২০২৪-এর মোদি মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন প্রশান্ত কিশোর। না কি বিহারি নীতীশ কুমারকে ঘায়েল করতে বিজেপির রাজনৈতিক অস্ত্র হবেন প্রশান্ত কিশোর? নীতীশের মনবদলের আবহেই বিজেপির হাত ধরবেন পিকে? এই জল্পনাও কিন্তু শুরু হয়েছে রাজনীতির অলি-গলিতে। যেখানে একদা বন্ধু নীতিশ এবং প্রশান্তের দ্বৈরথ অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। অনেকেই কটাক্ষ করে বলছেন, কে বলতে পারে আবার সব ভুলে মোদির হাতেই বিহারি লাড্ডু খাবেন না বন্ধু প্রশান্ত!