বিবর্তনের টাইমমেশিন আবিষ্কার! চিকিৎসায় নোবেলজয়ী প্যাবোর গবেষণা বদলে দেবে ইতিহাস
Nobel Prize in Medicine 2022: সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহা থেকে পাওয়া যায় চল্লিশ হাজার বছর পুরনো এক খণ্ড আঙুলের হাড়। প্যাবোর অত্যাশ্চর্য প্রযুক্তি ছাড়া এই ডেনিসোভান মানুষদের খবর হয়তো আমাদের কাছে অধরাই থেকে যেত।
Svante Pääbo, সুইডেনের বিজ্ঞানী, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব ইভল্যুশনারি অ্যানথ্রপলজির জেনেটিক বিভাগের কর্ণধার। সম্প্রতি ঘোষণা হয়েছে, মানব-বিবর্তনের গবেষণায় দৃষ্টান্তমূলক অবদানের জন্য ২০২২-এর ফিসিওলজি ও মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেলেন সোয়ান্তে প্যাবো। কী বলছে প্যাবো-র গবেষণা? তার আগে ইভল্যুশনারি অ্যানথ্রপলজি বিষয়ে দু'কথা জানা যাক। অ্যানথ্রপলজি শব্দের অর্থ 'মানবজাতি বিষয়ে বোঝাপড়া'। তার ভাষা, তার সমাজব্যবস্থা কেমন, সাংস্কৃতিক রীতি রেওয়াজ কী? কেন এমন হল? পৃথক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ম কানুনের সাদৃশ্য বা বিভেদ কয়প্রকার। এসব বিষয়ে তথ্য আবিষ্কার এবং গবেষণা চলেছে প্রাচীনকাল থেকে। ইভল্যুশনারি অ্যানথ্রপলজি এই বিষয়ের এক উপশাখা বলা যেতে পারে, যার মূল লক্ষ্য আধুনিক মানুষ, অর্থাৎ Homo sapiens প্রজাতির বিবর্তন ইতিহাস খুঁড়ে বের করা।
প্রত্নতাত্ত্বিক মানুষের হাড়গোড়, খুলি, পায়ের ছাপ, যা কিছু উদ্ধার হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, তার সঙ্গে আধুনিক মানুষের গঠনগত তুলনা করে এই বিষয়ে কাজ চলছে। তবে তাতে গোটা ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে না। পাঁচ অন্ধের হাতি দর্শনের মতো এগিয়েছে কাজ। সোয়ান্তে প্যাবো এই সময়ে তুলে নিলেন এমন এক চ্যালেঞ্জ যা করার কথা এর আগে কেউ ভাবেননি, কারণ সে কাজ যে সম্ভব- এমন বিশ্বাস কারও ছিল না। প্যাবো প্রত্নতাত্ত্বিক স্পেসিমেন থেকে ডিএনএ উদ্ধার করে নির্মাণ করলেন অকল্পনীয় মানবেতিহাস। গুহাগহ্বর থেকে উদ্ধার করা আদিম মানুষের অবশিষ্টাংশ থেকে কার্যকরী ডিএনএ যে উদ্ধার করা যায়, এমন ধারণা বিশ্বের তাবড় বৈজ্ঞানিকদের কাছেও ছিল আশাতীত। টাটকা স্পেসিমেন থেকেই ডিএনএ বের করা ঝকমারি, তায় লক্ষ বছর পুরনো ডিএনএ!
সময়ের নিয়মেই ডিএনএ-র গঠন ভাঙে, তার উপর রয়েছে ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক জৈবিক সংক্রমণ। প্যাবো আদৌ যাকে আদিম মানুষের ডিএনএ ভেবে কাজ এগোচ্ছেন তা কি বিশ্বাসযোগ্য? ক্রমে যখন বিভিন্ন কনফারেন্সে আদিম মানুষের জিনোমের অংশবিশেষ একে একে প্রকাশ করছেন প্যাবো, তাঁর সতীর্থদের মনে তখনও সন্দেহের ছায়া।
আরও পড়ুন- কোয়ান্টাম মেকানিক্সে সাড়া জাগানো এই আবিষ্কারই নোবেল এনে দিল তিন পদার্থবিজ্ঞানীকে
হোমিনিন প্রজাতি গোষ্ঠী, যার মধ্যে রয়েছে আধুনিক মানুষ, সেই শাখায় ছিল আরও অনেক সহপ্রজাতি যারা আজ বিলুপ্ত। তাদের বিবর্তন ম্যাপ করাই প্যাবোর গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য। কিছু বছরের মধ্যেই প্রকাশ করেছেন নিয়ান্ডারথাল জিনোম। সেই প্রথম হলফ করে বলা যায়, আধুনিক Homo sapiens ও শিম্পাঞ্জিদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি নিয়ান্ডারথাল চল্লিশ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত ইওরোপ ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা। গবেষণায় এও স্পষ্ট হয় যে সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে উঠে আসা হোমো শাখার মানুষ এবং নিয়ান্ডারথাল একসঙ্গে থেকেছে, তাদের সন্তানাদি হয়েছে, যার স্বাক্ষর আজও আধুনিক মানুষের জিনপুলে দেখা যায় এবং সেই জিনের প্রভাব তাদের শারীরিক প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট।
এই হোমিনিন শাখার অন্য আরেক প্রশাখার কথাও আমরা জানতে পারি প্যাবোর গবেষণায়। সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহা থেকে পাওয়া যায় চল্লিশ হাজার বছর পুরনো এক খণ্ড আঙুলের হাড়। প্যাবোর অত্যাশ্চর্য প্রযুক্তি ছাড়া এই ডেনিসোভান মানুষদের খবর হয়তো আমাদের কাছে অধরাই থেকে যেত। জানা যায়, ডেনিসোভানদের সঙ্গেও আধুনিক মানুষ বসবাস করেছে, সঙ্গম করেছে, তাদের ছয় শতাংশ জিন এখনও দেখা যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মধ্যে এবং সেই জিনের দৌলতে স্বল্প অক্সিজেনেও নির্বিঘ্নে শ্বাস নিতে পারেন তিব্বতিরা।
সোয়ান্তে প্যাবোর নোবেল পাওয়ার পর থেকে সংবাদমাধ্যমে বারবার উঠে আসছে আধুনিক মানুষের সঙ্গে আদিম মানুষের পার্থক্যের দিকটি। বলা হচ্ছে, হোমিনিন শাখায় আধুনিক মানুষের সহচর আদিম মানুষগুলো বিলুপ্ত হল, আজকের মানুষ এগিয়ে চলল, অর্থাৎ আধুনিক মানুষের এই জয়যুক্ত ব্যতিক্রমী যাত্রার হয়ে গল্প বলাই প্যাবোর অন্যতম অবদান। মজার বিষয়, এইখানেই কালেক্টিভ মানসিকতা বৈজ্ঞানিক তথ্যের থেকে খানিক সরে যাচ্ছে । বিজ্ঞানের নিরিখে প্যাবোর অভূতপূর্ব অবদান নতুন এক বৈজ্ঞানিক দর্শনের জন্ম দিয়েছে, যা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অণু পরমাণু থেকে নির্মাণ করবে বিবর্তনের রহস্য। প্যালিওজেনেটিক্স নামের নতুন শাখা শুরু হল প্যাবোর গবেষণার হাত ধরে। এই টেকনোলজির বাইপ্রডাক্ট নিয়ান্ডারথাল বা ডেনিসোভানদের গল্পোন্মোচন। এগুলিকে বলা যেতে পারে কেস-স্টাডি, যে প্রযুক্তি ধীরে ধীরে তৈরি করছিলেন প্যাবো তা সঠিক পথে এগোচ্ছে কিনা যাচাই করে নেওয়ার পর্যায়ক্রমিক যাত্রা। নোবেল পাওয়ার পর বিবৃতিতে প্যাবো জানিয়েছেন,
"The thing that is amazing to me is that we now have some ability to go back in time and actually follow genetic history and genetic changes over time,” he said in a news conference several hours after."
অর্থাৎ গোটা ঘটনায় তাঁর কাছে সবচেয়ে বিস্ময়ের এই অদ্ভূত ক্ষমতা যার জোরে পিছিয়ে যেতে পারছি লক্ষ বছর। প্যাবো এমন এক টাইমমেশিনের আবিষ্কারক যার ব্যবহারে তিনি ইতিহাস লিখছেন এমন ঘটনাসমূহের যেগুলি ঐতিহাসিককে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে না। হয়তো একমাত্র বিবর্তনের ইতিহাস এভাবে নথিবদ্ধ করা সম্ভব এবং প্যাবো আগামী গবেষকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সেই জাদুকাঠি।
আরও পড়ুন- স্বৈরতন্ত্র বাধ্য করেছিল নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যানে, নোবেলের যে ইতিহাস আজও অজানা
এরকম একটা শক্তিশালী অস্ত্রের তাৎপর্য এক বাক্যে তর্জমা হয়ে দাঁড়াচ্ছে,
"Establishing a new field of science to answer the question of what makes humans unique from our extinct relatives has earned Svante Pääbo the Nobel Prize in physiology or medicine."
মানুষকে অদ্বিতীয় প্রমাণ করার কোনও দায় বিজ্ঞানের নেই, সমাজের হয়তো আছে। নিজেকে বিশেষ ভাবতে মানুষ ভালবাসে। আমি প্রকৃতির নিরীক্ষক, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে অবস্থানে সুখী। পপ-কালচারে, টিশার্টে, পোস্টারে বিবর্তনের যে একরৈখিক ছবি, দেখি শিম্পাঞ্জি পথ চলতে চলতে মানুষ হয়ে উঠছে। প্রকৃতির আসলে কোনও দায় নেই আদি বর্তমান প্রাণিকুলকে লাইন দিয়ে একে একে মানুষ করে তোলার। বরং আজকের মানুষের সঙ্গে সহযাত্রী প্রজাতিদের মিল কতখানি, কোন জিন-সূত্রে তাদের আত্মীয়তা সেই খোঁজ করেছে প্যাবোর গবেষণা। প্যাবো ইতিহাসের সেই অদেখা ইন্দ্রজালে আলো ফেলেছেন যা মানুষকে আরেকবার প্রকৃতির নিয়মের জালে ফিরিয়েছে, যে জালটা বাস্তবে খুব জটিল, এলোমেলো, বিশৃঙ্খল। অতীতে তাকিয়ে সেই গল্প জানার একটা জোরালো মাইক্রোস্কোপ যখন সোয়ান্তে প্যাবো উপহার দিচ্ছেন, তখন ইগোসেন্ট্রিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে নতুন করে ভাবব। চারপাশের জীবজগতের সঙ্গে এই সংযোগস্থাপন বিশেষ করে আজকের পৃথিবীতে জরুরি, কারণ নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভেবে প্রযুক্তি প্রয়োগে কেবল সামনের দিকে তাকিয়ে আমাদের যে ডালে বসবাস সেই ডালেই চালিয়েছি কুঠার।
এক বিশাল বৃক্ষে, সুবিশাল বৃত্তে, প্রাচীন শাখার ক্ষীণ প্রশাখায় ঝুলে থাকা একরত্তি নবীন পাতা ছাড়া মানুষের হওয়ার কিছু ছিল না। বছর দশেক আগে প্যাবোর গবেষণার সঙ্গে পরিচয় এবং বিবর্তনবাদের ছাত্রী হওয়ার সূত্রে ব্যক্তিগতভাবে সোয়ান্তে প্যাবোর নোবেলজয়ী গবেষণার সবচেয়ে আকর্ষণীয়, দার্শনিক অবদান আমার কাছে ওই শেষ বাক্যের সারাংশ।