শুধু উদ্ভাবন নয়, চাই সমান সুযোগ— অর্থনীতির নোবেল যে বার্তা দিল
Nobel in Economic: ২০২৫ সালের অর্থনীতির নোবেল একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে— উদ্ভাবন অর্থনীতির ইঞ্জিন হতে পারে, কিন্তু সেটি চালানোর জন্য দরকার শিক্ষা, নীতি ও ন্যায়বোধ।
২০২৫ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ— ফিলিপ ক্যানিয়ন (Philippe Aghion), পিটার হাউইট (Peter Howitt) এবং জোয়েল মোকির (Joel Mokyr)। প্রযুক্তির নতুন উদ্ভাবন কী ভাবে অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়ক হতে পারে তার দিশা দেখিয়েই তিন গবেষক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই পুরস্কার এসেছে এমন এক সময়ে, যখন গোটা বিশ্বের অর্থনীতি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের মতো বা দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আগামী দিনের অর্থনৈতিক ছবি এখনও পরিষ্কার নয়। কোথায় বিনিয়োগ বাড়বে, কতটা নতুন চাকরি তৈরি হবে, প্রযুক্তির পরিবর্তন সাধারণ মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে— এসবের স্পষ্ট উত্তর এখনও নেই।
আগিওন ও হাউইট তাঁদের গবেষণার ব্যাখ্যা দেখিয়েছেন, অর্থনৈতিক উন্নতি সহজ নয়। এটি অনেকটা ‘মান উন্নয়নের সিঁড়ি’ (quality ladder)-এর মতো। সমাজ ধাপে ধাপে এগোয়— প্রতিযোগিতা, নতুন ভাবনা আর পরিবর্তনের মাধ্যমে। সমাজ তখনই এগোয়, যখন পুরনোকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন চিন্তা সামনে আসে। তবে এই উন্নতির সুফল সবাই সমান ভাবে পায় না। যাদের শিক্ষার সুযোগ বা প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই, তারা স্বাভাবিক ভাবেই তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। ফলে সমাজে বৈষম্য ও অনিশ্চয়তা বাড়ে।
১৯৯২ সালে ফিলিপ আগিওন এবং পিটার হাউইট একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তাঁরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা উপস্থাপন করেন, যাকে বলা হয় সৃজনশীল ধ্বংস (Creative Destruction)। এর অর্থ হলো, যখন নতুন ও উন্নত পণ্য বাজারে আসে, তখন পুরনো পণ্য বিক্রি করা কোম্পানিগুলির লোকসান হয়। নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে পুরনো সিস্টেম ধীরে ধীরে চলে যায়, আর বাজারে স্থান পায় নতুন শক্তি ও নতুন ব্যবসা।
আরও পড়ুন- জেন জেডের বিনিয়োগ ঝড়ে বদলাচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতি?
জোয়েল মোকির দেখিয়েছেন, ইতিহাসে যেসব সমাজে মুক্ত চিন্তা, প্রশ্ন করার অধিকার এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিবেশ ছিল, সেখানেই বড় উদ্ভাবন হয়েছে। তাঁর মতে, কেবল প্রযুক্তি থাকলেই চলবে না। সমাজে এমন পরিবেশ দরকার, যেখানে জ্ঞান, সৃজনশীলতা এবং মুক্ত চিন্তা বিকশিত হতে পারে। উদ্ভাবন টিকিয়ে রাখতে হলে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সরকারের নীতিতেও মুক্ত ভাবনার জায়গা থাকতে হবে।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিগত উন্নতি খুব দ্রুত ঘটছে। কিন্তু এর সুফল সব মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না। উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু কাজ ও আয়ের সুযোগ অনেক ক্ষেত্রে অনিশ্চিত। উদ্ভাবন যেমন অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি যদি তার সঙ্গে সামাজিক ও প্রতিষ্ঠানগত প্রস্তুতি না থাকে, তা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, চাকরি হারানো, আয়ের বৈষম্য বা মধ্যবিত্তের সংকট।
ভারতের মতো দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও অটোমেশন ক্রমে বাড়ছে। কিন্তু এর ফলে নতুন চাকরির সুযোগ যতটা তৈরি হচ্ছে, তার চেয়ে দ্রুত কমছে প্রচলিত কাজের সংখ্যা। তাই শুধু উদ্ভাবন নয়, দরকার এমন নীতি, যা মানুষকে এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন- শতবর্ষে বোসন: তাঁর আবিষ্কারেই বিশ্বজয় বিজ্ঞানীদের! কেন নোবেল পেলেন না সত্যেন্দ্রনাথ?
এই নোবেল পুরস্কার আবারও মনে করিয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নতি কেবল প্রযুক্তি বা নতুন উদ্ভাবনের উপর নির্ভর করে না। একটি দেশের অগ্রগতি তখনই সম্ভব, যখন সমাজের ভিত্তি মজবুত, নিয়ম-কানুন ন্যায়সঙ্গত এবং মানুষ দক্ষ হয়। সরকারের কাজ হবে মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে এগোতে উৎসাহ দেওয়া, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার নয়। শিক্ষায় ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি করতে হবে, নতুন কোম্পানি ও উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে এবং চাকরি হারানো মানুষের জন্য নতুন দক্ষতা শেখার সুযোগ দিতে হবে তবেই আসবে আর্থিক উন্নতি।
২০২৫ সালের অর্থনীতির নোবেল একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে— উদ্ভাবন অর্থনীতির ইঞ্জিন হতে পারে, কিন্তু সেটি চালানোর জন্য দরকার শিক্ষা, নীতি ও ন্যায়বোধ। শুধু পরিবর্তনের দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেই হবে না, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানকেও সেই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতও করতে হবে।
Whatsapp
