ঘুমের বড়ি নয়, মিষ্টি খেয়েই ঘুমাতে যান কালীঘাটের কালী, জানেন কী নাম এই মিষ্টির?
Favourite sweet of Kalighat's Kali : কালীঘাটের কালীর ঘুমের রহস্য লুকিয়ে আছে একটি মিষ্টিতেই। রোজ রাতে অন্তত একটা করে চাই-ই চাই। তবেই নিশ্চিন্তে ঘুম দেবেন তিনিও, জানেন কোন মিষ্টি?
মাছে ভাতে বাঙালির শেষ পাতে একটু মিষ্টিমুখ না হলে ঠিক জমে না। ঘরোয়া অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে উৎসব বা নিমন্ত্রণ বাড়ি, সবেতেই এই মিষ্টির স্বাদটুকুই আসলে যথার্থ ক্লাইম্যাক্স। কেবল বাঙালির যে মিষ্টির প্রতি প্রেম আছে তাই নয়, মিষ্টি নিয়ে ভালোবাসায় পিছিয়ে নেই দেবদেবীরাও। এমনিতেই পুজোর প্রসাদ হিসেবে মিষ্টিকেই সর্বপ্রথম গণ্য করা হয়। কিন্তু জানেন কি খোদ কলকাতা শহরের নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন যে কালী তিনিও নাকি মিষ্টি ছাড়া ঘুমাতে পারেন না? ভাগ্যিস ব্লাড সুগারের ভয় নেই, নচেৎ এতদিনে যে ইনসুলিন নেওয়া ছাড়া বিশেষ কোনও উপায় ছিল না স্বয়ং কালীঘাটের কালীর, তা হলপ করেই বলা যায়। আমাদের যেমন ঘুম না এলে চিকিৎসকেরা ঘুমের বড়ি খাওয়ার পরামর্শ দেন, ঠিক তেমনই কালীঘাটের কালীর ঘুমের রহস্য লুকিয়ে আছে একটি মিষ্টিতেই। রোজ রাতে অন্তত একটা করে চাই-ই চাই। তবেই নিশ্চিন্তে ঘুম দেবেন তিনিও, জানেন কোন মিষ্টি?
স্বাদে খানিকটা রসগোল্লার মতো হলেও দেখতে একটু অন্যরকম। কলকাতার রসগোল্লা নিয়ে এমনিতেই রয়েছে অজস্র গল্পগাঁথা, তার ওপর যদি মা কালীর প্রিয় হিসেবে বিবেচ্য হয়, তবে তো কোনও কথাই নেই। না ঠিক রসগোল্লা নয় মিষ্টি, বরং বলা ভালো চ্যাপ্টা রসগোল্লা! উড়িষ্যার সঙ্গে যে মিষ্টির স্বত্ব নিয়ে এতো যুদ্ধ সেই মিষ্টিই কিনা রাতারাতি খাস কলকাতার বুকে হয়ে গেল চ্যাপ্টা। আর সেই চ্যাপ্টা স্বদেই মজলেন স্বয়ং কালীঘাটের কালী। ব্যাস, এটাই তো যথেষ্ট সার্টিফিকেট। তাই কালীঘাট চত্বরে আর গোল হওয়া হল না রসগোল্লার।
আরও পড়ুন - কোথাও রসের হদিশ, কোথাও ঘিয়ের গন্ধ, উত্তর থেকে দক্ষিণে রাজ করছে বাংলার যেসব মিষ্টি
বাঙালির অহংকার এই রসগোল্লা, নবীর ময়রার অনবদ্য আবিষ্কার। ছানার গোল্লা পাকিয়ে রসের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু এই মিষ্টি তৈরির সময় সেই গোল্লা পাকানোর প্রথায় এল বদল, হাতের চাপে চ্যাপ্টা করে ডুবিয়ে দেওয়া হতো রসে। দেখতে অবশ্য অবিকল রসগোল্লার মতোই সাদা, এবং সেই একই রকম রসালো। জানেন কি কালীঘাট চত্বরে ঠিক কোথায় পাওয়া যায় এই চ্যাপ্টা রসগোল্লা?
ধোপদুরস্থ দোকান, সবেকিয়ানা যেন আগলে রেখেছেন এঁরাই। চারপাশের এই এত আধুনিকতার লেশ মাত্র স্পর্শ করতে পারেনি আজও। কালীঘাট মন্দির চত্বরে একডাকে সবাই চেনে হারান মাঝিকে। সেই হারান বাবু জীবনের নিয়মে হারিয়ে গেলেও, দোকানখানা আজও একই রকমভাবে অক্ষত আছে। অক্ষত আছে ঐতিহ্যও। আলাদা করে তথাকথিত কোনও নাম নেই এই দোকানের। ‘হারান মাঝি’ নামটাই কাফি, এই নামতেই দোকানের আসল ইউ এস পি। বলা ভালো, দোকানের প্রতিষ্ঠাতার নামটাই এই দোকানের আসল বিজ্ঞাপন। কালীঘাট মন্দিরের কাছে দেবনারায়ণ লেনে রয়েছে এই দোকান। লোকমুখে হারান মাঝির মিষ্টির দোকান আজও সাক্ষাৎ ইতিহাসের দর্শন করায় ভক্তদের। এই দোকানেই মেলে চ্যাপ্টা রসগোল্লা। আদতে মিষ্টির নাম ক্ষীরমোহন, তবে রসগোল্লা যেভাবে তৈরি হয়, ঠিক একইভাবে তৈরি করা হয় এই মিষ্টিও। একই রকমভাবে রসে ফুটিয়ে তৈরি করা হয় ক্ষীরমোহন, পার্থক্য কেবল ওই আকারেই। স্বয়ং কালীর প্রসঙ্গ জুড়ে আছে বলেই হয়তো এতটা জনপ্রিয় হয়ে যায় এই মিষ্টি। আজও দুবেলা দেদার বিক্রি হয় চ্যাপ্টা রসগোল্লা।
আরও পড়ুন - ‘চিনি’-র দখল চিনের? স্বাদে মিষ্টি, কিন্তু শব্দের ভেতর লুকিয়ে জটিল রহস্য
হারান মাঝির মিষ্টির দোকানের বয়স প্রায় ১৫০ বছরেরও বেশি। হাওড়ার দেউলটি থেকে এসেছিলেন এই ময়রা। কলকাতায় এসে প্রাথমিকভাবে কালীর সেবায় মিষ্টি বানানোর ভাবনা আসে তাঁর। কালীঘাট মন্দিরের পিছনে তৈরি করেন এক চিলতে দোকান। সেই দোকানই রয়ে গিয়েছে আজও। চার পুরুষ ধরে এই দোকান থেকেই মিষ্টি যায় দেবীর ভোগে। বুবাই মাঝি ও রাজু মাঝি এখন সামলাচ্ছেন দোকান। আজও কম করে দিনে প্রায় ২০০ পিস চ্যাপ্টা রসগোল্লা বিক্রি হয়। নানান এলাকার লোক, এমনকী দূর দূরান্ত থেকেও লোকজন আসেন এই মিষ্টির খোঁজে। দেবীর প্রিয় মিষ্টির স্বাদ চেখে দেখার সাধ যে কিছু কম নয়, তা বোঝা যায় রোজের বিক্রির হিসেবেই। তাছাড়া কালীকে তাঁর প্রিয় মিষ্টি দিয়ে পুজো দেওয়ার সাধও মেটান কেউ কেউ। ভোগের মিষ্টিও যায় এই দোকান থেকে। সন্ধ্যা আরতির সময় চ্যাপ্টা রসগোল্লা না থাকলে পুজো অসমাপ্ত থেকে যায় বলেই ধারণা সকলের। কথিত আছে, এই চ্যাপ্টা রসগোল্লা খেয়েই নাকি ঘুমোতে যান স্বয়ং কালী। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাবেকিয়ানায় ভর করেই পথ চলছে সার্ধ শতবর্ষের এই দোকান। আর একটু একটু করে প্রতিদিন নিজেকে জুড়ে নিচ্ছে কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে।