পাতে উঠবে বিষমুক্ত খাবার, ত্রিপুরা পারছে, আমরা পারি না?
Nutrition Gardens In Tripura: পুষ্টি বাগান, যা মানুষের হাতে তুলে দেবে পুষ্টিমূল্যযুক্ত টাটকা শাকসব্জি,ফলমূল। আর গ্রামের অর্থনৈতিক ভিত্তিকেও করবে মজবুত।
সোনার ফসল, সোনার জমি, কৃষক, সমাজবন্ধু এই শব্দগুলির মধ্যে যতটা রোম্যান্টিসিজম রয়েছে, বাস্তব মাটিটা কিন্তু তার চেয়েও শক্ত, তার চেয়েও কঠিন। এই সোনার ফসল ফলানোর পিছনে একজন কৃষকের যে কী রক্তজল করা পরিশ্রম থাকে, তা ভাবার বাইরে। অথচ দাম পাওয়ার সময়ে মেলে না ফুটোকড়ি। আজও ভারতবর্ষের এখান ওখান সেখান থেকে কৃষক আত্মহত্যার খবর আসে। আমরা খবর দেখি, পড়ি ভুলে যাই। বাজারে গিয়ে দাম দিয়ে শাকসব্জি কিনি, অর্ডার করি অনলাইনে। কিন্তু যে দামে আমরা সব্জি-আনাজপত্র কিনি, তার সিকিভাগও কি যায় কৃষকের হাতে? নাকি মাঝরাস্তাতেই গলে পড়ে যায় বেশিরভাগটাই। কৃষকের হাতে যেটুকু পৌঁছয়, তাতে তাঁদের পেট চলে না। যে পথে শ্রমের মূল্য গলে পড়ে যায়, সে পথেই গলে যায় খাবারের পুষ্টিগুণও। ক্ষেত থেকে বাজার অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে তাতে চড়ে নানা রং, নানা রাসায়নিক। কৃষকের রক্তঘাম করে ফলানো সোনার ফসলে এসে ঢোকে বিষ। যা আমরা গুচ্ছ গুচ্ছ দাম দিয়ে কিনে আনি। রেঁধে বেড়ে খাই।
আরও পড়ুন: ফসল ফলিয়েও অপুষ্টিতে ভুগছে কৃষকদের সন্তানরাই! যেভাবে লড়ছে অসমের জনজাতিরা
প্রায়শই আমরা ভাবি, যেসব খাবারদাবার আমরা খাচ্ছি, তা আদৌ পুষ্টিযুক্ত তো? নাকি তার বদলে ভেজাল খাবারদাবারের মধ্যেই পুষ্টি খুঁজছে আমাদের শরীর। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ক্ষেতে বিষাক্ত সব রাসায়নিকের ব্যবহার কোনও নতুন কথা নয়, যার ফলে জমির স্বাভাবিক ফলন ক্ষমতা যেমন কমছে, তেমনই আমাদের শরীরে জমছে বিষ। তাছাড়া চাষবাসের উপর নির্ভরশীল গ্রামাঞ্চলগুলির অর্থনৈতির অবস্থাও তেমন বলার মতো নয়। আগেই বলেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফসলের ঠিকঠাক দাম যেন সোনার পাথরবাটি। এ হাত ও হাত ঘুরে কৃষকদের কাছে যখন ফসলের দাম এসে পৌঁছয়, ততক্ষণে তা পৌঁছেছে তলানিতে। তবে এই সব সমস্যা মেটাতেই ত্রিপুরায় শুরু হয়েছে নিউট্রিশন গার্ডেনের ভাবনা। পুষ্টি বাগান, যা মানুষের হাতে তুলে দেবে পুষ্টিমূল্যযুক্ত টাটকা শাকসব্জি,ফলমূল। আর গ্রামের অর্থনৈতিক ভিত্তিকেও করবে মজবুত। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা ত্রিপুরার গ্রামগুলিতে শুরু হয়েছে এই উদ্যোগ। যেখানে জোর দেওয়া হচ্ছে পুষ্টিসমৃদ্ধ চাষবাসের উপরে।
এখনও ভারতবর্ষের একটা বৃহত্তম জায়গা জুড়ে গরিবি ও খিদের সমস্যা। খাবার যদি জোটেও বা পুষ্টি অনেক দূরের কথা। বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েদেরই গোটা পুষ্টিটাই আসে স্কুলের মিডডে মিল থেকে। কারণ বাড়িতে একবেলার খাবারই ভালো করে জোটে না। তবে সেখানেও তো নানাবিধ দুর্নীতির বেড়াজাল। প্রয়োজনীয় ডিম-দুধ বা প্রোটিনের পুষ্টি তাই অধরাই থেকে যায় সেই সব বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের।
তবে ত্রিপুরায় এবার জোর দেওয়া হচ্ছে এমন চাষবাসের উপরে, যেখানে গোড়া থেকেই পুষ্টিমূল্য বজায় রাখার কথা মাথায় রাখা হবে। আর এমনি এমনি নয়, তার জন্য রীতিমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ছেলেমেয়েদের। ২০১৮ সালে আইসিএআরের সহায়তায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ওই পুষ্টিবাগানে শুধু শাকসবজিই নয়, তার পাশাপাশি ভেষজগুণ সম্পন্ন গাছ চাষেরও ব্যবস্থা করা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষিপ্রধান পরিবারগুলিতে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবারদাবার পৌঁছে দেওয়াই ছিল এই উদ্যোগের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। তার পাশাপাশি আর্থিক উন্নয়নের ভাবনা তো রয়েইছে।
২০২০ সাল নাগাদ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব রিসার্চ (আইসিএআর) এবং কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (কেভিকে) যৌথভাবে এই উদ্যোগ নেয়। ত্রিপুরার কৃষকদের নিজস্ব জমিতে বানিয়ে দেওয়া হয় একটি করে নিউট্রিশাস গার্ডেন। যেখান থেকে শুধু তাঁদের পরিবারেরই নয়, পাশাপাশি গোটা গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে যাতে পুষ্টিমূল্য পৌঁছে দেওয়া যায়, তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
এই উদ্যোগের জন্য নির্বাচিত কৃষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সমস্ত সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়। জমির সার থেকে ওষুধ, সব কিছুই সরবরাহ করা হয়, যাতে তাঁরা তাঁদের পুষ্টি বাগানে ফলাতে পারেন সোনার ফসল। আর এই মডেলটি এমন ভাবে ভাবা হয়েছে, যাতে এবার বাজারে না গিয়ে সোজা কৃষকের থেকেই তাজা শাকসব্জি, ফল কিনতে পারেন ক্রেতারা। ফলে ফঁড়ে এবং মধ্যসত্ত্বভোগীদের বাড়বাড়ন্তেও রাশ টানা যাবে খানিকটা। বাড়বে কৃষকের আয়। তাঁদের ঘাম-রক্ত ঝরানো ফসল সোজা তাঁদের কাছ থেকে কেনার চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে। এতে কৃষক যেমন ফসলের সঠিক দাম পাবেন, খদ্দেরও পাবেন ঠিকঠাক সব্জি বা ফলটি। কৃষকের ক্ষেত থেকে বাজারে ক্রেতার হাতে পৌঁছতে পৌঁছতে এতদিন অনেক স্তর, অনেক হাত ঘুরে আসতে হত পণ্য়কে। তাতে টাটকা সব্জি-ফলের রূপ এবং গুণ, দুটোই অনেকাংশে যেত বদলে। সেই পরিস্থিতিটাই পাল্টে দিতে চায় এই উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে জমি এবং শ্রমটুকুই শুধু কৃষকের, চাষবাসের বাকি সরঞ্জামই সরবরাহ করবে কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র।
এখানেই শেষ নয়। এই উদ্যোগের আরও একটি দিক হল, গ্রামের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের তুলে আনা। ত্রিপুরার বৈরাগীপাড়া গ্রামের সেভেন সিস্টারস ডেভলপমেন্ট অ্যাসিসটেন্স (SeSTA)-র তরফে চেষ্টা করা হচ্ছে, এমন পুষ্টি-উদ্যানের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের দিশা দেখানো। এই প্রকল্প থেকে উপকৃতল হচ্ছেন ত্রিপুরি সম্প্রদায়ের আদিবাসী কৃষকেরাও। আদিবাসী কৃষক পরিবারের মেয়ে হান্না ডেব্বারমা জানালেন, এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় দিক হল, আমরা আমাদের আশপাশে যা আছে, সেসব ব্যবহার করেই বিভিন্ন ধরনের সব্জি-ফলমূল উৎপাদন করছি। বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে উৎপাদিত সব্জির পুষ্টিগুণ বজায় থাকে পুরোমাত্রায়। বরং তা কীভাবে আরও বেশি বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: হু হু করে বাড়ছে কৃষক আত্মহত্যা! দেশজুড়ে অন্নদাতাদের দুর্দশার দায় কার
অর্গানিক গ্রাম গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে অভিনব এই উদ্যোগ। পাশাপাশি তাতে উপকৃত হচ্ছেন গ্রামের একাধিক কৃষক ও তাদের পরিবার। কাজ পাচ্ছেন বহু মানুষ। মেয়েদের জন্যও খুলে যাচ্ছে নতুন নতুন পথ। তার সঙ্গেই বাড়ছে জমির মানও। অকারণ কীটনাশকের ব্যবহার কমায় বাড়ছে স্বাস্থ্যকর শাকসবজির ফলন। সব মিলিয়ে সামগ্রিক ভাবে গ্রামীণ এলাকার অর্থনীতিকেই দিশা দেখাচ্ছে পুষ্টি-উদ্যান প্রকল্প। প্রাথমিক ভাবে শাকসব্জি দিয়ে শুরু হলেও আগামী দিনে ধান, গমের মতো দানাশস্য উৎপাদনের দিকেও মন দেওয়া হবে। যা বদলে দেবে ত্রিপুরার গ্রামীণ অর্থনীতি।
ত্রিপুরার মতো বাকি দেশও কি হাঁটতে পাবে সেই পথে! গড়ে উঠবে ভেজালহীন খাঁটি ভারত, রইল জিজ্ঞাসা।