হু হু করে বাড়ছে কৃষক আত্মহত্যা! দেশজুড়ে অন্নদাতাদের দুর্দশার দায় কার

Farmer's Suicide: নানান সমস্যায় জর্জরিত কৃষকরা বেঁচে থাকার কোনও বিকল্প উপায় না খুঁজে পেয়ে দলে দলে আত্মঘাতী হচ্ছেন।

এদেশের কোটি কোটি মানুষের পাতে যে মানুষগুলো খাদ্য জোগায় বিপন্ন তাঁরা। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে সমগ্র দেশবাসীর কাছে বিষয়টা চরম লজ্জার।

নানান সমস্যায় জর্জরিত কৃষকরা বেঁচে থাকার কোনও বিকল্প উপায় না খুঁজে পেয়ে দলে দলে আত্মঘাতী হচ্ছেন। এদিকে কৃষকদের আত্মহত্যা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সরকার চেপে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। গত কয়েক বছর ধরে 'মা-মাটি-মানুষ'-এর সরকার বিধানসভাতে দাবি করে আসছে, বাংলায় কৃষকরা ভালো আছেন। বাংলায় একজন কৃষকও আত্মঘাতী হননি। এই তথ্য যে অসত্য তাও প্রমাণিত হয়েছে। সম্প্রতি তথ্য জানার অধিকার আইনে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বাংলার কৃষকদের আত্মহত্যা সম্পর্কে। দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে কেবলমাত্র পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেই আত্মঘাতী হয়েছেন ১২২ জন কৃষক। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ২৩টি থানার বাসিন্দা আত্মঘাতী এই কৃষকরা।

এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, শুধুমাত্র কৃষকরাই নিজের হাতে নিজের জীবন খতম করছেন না, গোটা বাংলায় আত্মঘাতী নাগরিকের যে খতিয়ান পেশ করেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো তাতে উল্লেখ রয়েছে, ২০২১ সালে সারা বাংলায় আত্মঘাতী হয়েছেন ১৩ হাজার ৫০০জন নাগরিক। সেহিসেবে আত্মহত্যায় সারা দেশের নিরিখে বাংলা এখন চতুর্থ স্থানাধিকারী।সমাজকর্মীদের বক্তব্য, কেবল পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘাটালেই গত বছরে ৬৩জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। এ-ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কাছে কোনও তথ্য নেই। বলা বাহুল্য, এ-ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। চলতি বছরেও পশ্চিম মেদিনীপুরে কৃষকদের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা অব্যাহত। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এই জেলাতে আত্মঘাতী হয়েছেন ৩৪জন কৃষক। এর পরের মাসগুলিতে কৃষক আত্মহত্যা সম্পর্কিত পরিসংখ্যান জানা যায়নি এখনও।

আরও পড়ুন: ইউনিসেফের বিস্ফোরক রিপোর্ট! কয়েক বছরেই তাপপ্রবাহের ভয়াবহ বলি হবে শিশুরা

ভারতের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় মহারাষ্ট্রে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক আকার নিয়েছে। মহারাষ্ট্র সরকারই একথা জানিয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার কৃষক আত্মহত্যা সংক্রান্ত যে পরিসংখ্যান পেশ করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে মহারাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই ৬০০ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। যদিও সমাজকর্মীদের অভিযোগ, সরকার আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে দেখাচ্ছে। গত বছরও পরিস্থিতি মোটেও সুবিধার ছিল না। সরকার জানিয়েছে, গত বছর মহারাষ্ট্রের আট জেলাতে ৮০৫ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। এঁদের ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকই ঋণ পরিশোধ না পেরে দিশাহারা হয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন।

এছাড়া আরেকটি কারণ রয়েছে শত শত কৃষক আত্মহত্যার নেপথ্যে। সেটা আন্তর্জাতিক সমস্যাও। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের জের পড়েছে ফসলের উৎপন্ন করার ওপর। তাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিকাজ। চাষআবাদ করে যে মানুষগুলির জীবন চলে ব্যাপক ক্ষতির ধাক্কাটা সামলাতে পারেননি ওঁরা। প্রশাসনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা জোটেনি। ফলে জীবনটা খতম করে দেওয়াটাই সমীচীন হিসেবে মনে করেছেন বিপন্ন ওই কৃষকদের একাংশ।

জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি হওয়ায় মহারাষ্ট্রের ২৪টি জেলায় ৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাট, সয়াবিন থেকে কলা কিংবা সব্জি চাষে্ ক্ষতির পরিমাণ আকাশচুম্বী। 'ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো'-র সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, গত বছরে সারা দেশে ৫,৫৬৩ জন দরিদ্র কৃষক কিংবা কৃষিশ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন। এছাড়া ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতিতে মহারাষ্ট্রে শত শত কৃষক আত্মঘাতী হন। ২০২০ সালে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যার চেয়ে ২০২১ সালে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ৯ শতাংশ বেশি।

সারা দেশে মোট যতসংখ্যক কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন সেই তালিকার শীর্ষে মহারাষ্ট্র। এরপরই স্থান কর্নাটকের। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলি নামমাত্র ক্ষতিপূরণ আত্মঘাতী কৃষকদের হাতে ধরিয়ে দিয়েই খালাস। আত্মঘাতী কৃষকদের পাশে থাকতে দরিদ্র পরিবারের মানুষগুলির হাতে যে পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ তুলে দেওয়া হচ্ছে, মেরেকেটে অল্প কিছুদিন সংসার চলবে ওতে। তারপর কী হবে তা হয়তো শুধুমাত্র ঈশ্বরই জানেন। মহারাষ্ট্র ২০২১ সালে ১,৮৭৫ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। সবচেয়ে বেশি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে অমরাবতীতে। দ্বিতীয় স্থানাধিকারী কর্নাটকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ৯৯৯ জন কৃষক। এছাড়া দক্ষিণ ভারতের আরেকটি রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ তৃতীয় স্থানাধিকারী। অন্ধ্রপ্রদেশে ২০২১ সালে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ৫৮৪ জন।

কৃষক আত্মহত্যার ক্ষতিপূরণ বাবদ মহারাষ্ট্র সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির হাতে মোটে এক লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে। এদিকে দেশজুড়ে যেভাবে গ্যাস সিলিন্ডারের দামের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যেভাবে হু-হু করে বাড়ছে, তাতে এক লক্ষ টাকাটা কোনও টাকাই না। ওই টাকায় কয়েক মাস জোড়াতালি দিয়ে সংসারটা চলতে পারে। তারপর যে কে সেই। সইতে হবে সেই চরম দারিদ্ৰ।

বাংলা-সহ দেশের অন্য রাজ্যগুলিতে এখন আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ২০২২ সালে ঠিক কত দাঁডিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার এখনও সেসম্পর্কে কোনও পরিসংখ্যান পেশ করেনি। সমাজকর্মীরা মনে করছেন, আশাব্যঞ্জক কোনও তথ্য মিলবে না। কারণ দেশজুড়ে দারিদ্ৰসীমার নীচে তলিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা গত দু'বছরে অনেকটা বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আত্মঘাতী কৃষকদের একাংশের পরিবার সরকারি নিয়মকানুনের ফাঁসে পড়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ নগদ কোনও টাকাও যে পাচ্ছেন না এমন ঘটনাও শত শত।

দলে দলে কৃষক আত্মহত্যার কারণ ওয়াকিবহাল মহলের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষিনীতি খাদের কিনারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গোটা কৃষক সমাজকে। চলতি বছরে কেন্দ্রীয় সরকারই সংসদে যে তথ্য পেশ করেছে তাতেও বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়সীমায় দেশের নাগরিক ১৭ হাজারের বেশি কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এরপরও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত রয়েছে।

কৃষিপ্রধান দেশ ভারতের কৃষিজীবীদের ভবিষ্যতের ভালোমন্দ নিয়ে এখনই ভাবা দরকার বলে মনে করেন সমাজকর্মীরা। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ মানুষের কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০১৯ সালের মধ্যে কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ করে দেবেন। বাস্তব পরিস্থিতির বিচারে সেও কথার কথায় পর্যবসিত হয়েছে। তাই বলাই যেতে পারে, 'কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না'। অথচ পেরিয়ে গিয়েছে দেশের স্বাধীনতার পরের ৭৫ বছর।

More Articles