বাদ পড়ল জাতীয় সঙ্গীতও, যেভাবে 'একদিনের মুখ্যমন্ত্রী' হয়েছিলেন জগদম্বিকা পাল
One Day CM Jagadambika Pal: ২৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায় দিল জগদম্বিকা পালের সরকার বরখাস্ত করার। রায়দান হতেই অনশন তুলে নিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।
একই সময়ে, একটি রাজ্যে কি দু'জন মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারেন? আপনি বলবেন ‘না’। সাংবিধানিক ভাবেও একই সময়, একটি রাজ্যের একজনই মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন। কিন্তু এর ব্যতিক্রমী এক ঘটনা আমাদের দেশে হয়েছিল একবার। ২৪ বছর আগে, ১৯৯৮ সালে ঘটনাটি ঘটে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, দেশে তখন দ্বাদশ লোকসভা ভোটের প্রচার পর্ব তুঙ্গে। দেশের সব রাজনৈতিক দল তখন বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের প্রচার করছে। এমন সময় লখনউতে রাজভবনে বসে অন্যরকমের এক রাজনৈতিক পরিকল্পনা ফাঁদছেন উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন রাজ্যপাল রোমেশ ভাণ্ডারি। ২২ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের সব হেভিওয়েট আসনগুলি, যেমন- লখনউ (প্রার্থী অটল বিহারী বাজপেয়ী), সম্বল (প্রার্থী তৎকালীন রক্ষামন্ত্রী মুলায়াম সিং যাদব), বাঘপথে (প্রার্থী অজিত সিং) নির্বাচন ছিল। এর আগের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি যখন রাজ্যজুড়ে প্রচার করছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং, ঠিক সেই সময় একটি প্রেস কনফারেন্স হচ্ছিল আকবরপুরে। প্রেস কনফারেন্সটি করছিলেন বহুজন সমাজ পার্টির উপাধ্যক্ষ মায়াবতী। সেখানে তিনি সাফ জানিয়ে দেন তাঁর সম্পূর্ণ ফোকাস এখন কল্যাণ সিং সরকারের পতনের ওপর। পাঁচ মাস আগে যেভাবে কল্যাণ সিং পার্টি থেকে ভাঙিয়ে বিধায়ক নিয়ে গিয়ে সরকার বানিয়েছেন, তার প্রতিশোধ তিনি নেবেন।
প্রেস কনফারেন্স সেরে সেদিন দুপুর দুটোর সময় রাজ্যপাল রোমেশ ভাণ্ডারির কাছে চলে যান মায়াবতী। মায়াবতীর সঙ্গী বহুজন সমাজ পার্টি, অজিত সিংয়ের কিষাণ কামগার পার্টি, ভারতীয় লোক দল, জনতা দল এবং সরকারের সমর্থনকারী লোকতান্ত্রিক কংগ্রেসের সকল বিধায়ক। রাজ্যপালের কাছে গিয়ে মায়াবতী, কল্যাণ সিং সরকারের পরিবহন মন্ত্রী এবং লোকতান্ত্রিক কংগ্রেসের বিধায়ক জগদম্বিকা পালকে এগিয়ে দেন। তিনি জানান উপস্থিত সকল বিধায়কের সমর্থন রয়েছে জগদম্বিকা পালের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমাজবাদী পার্টিও ঘোষণা করে দেবে তাদের সমর্থনের কথা। সুতরাং কল্যাণ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে যেন বরখাস্ত করে জগদম্বিকা পালকে মুখ্যমন্ত্রী করে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজভবনে পৌঁছে গেল সমাজবাদী পার্টির সমর্থনের চিঠি। তবে এরপর যা হল, তা গণতন্ত্রের নামে প্রহসন।
আরও পড়ুন- ‘বাংলাদেশি বাবু’ ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা
সরকার ফেলার পরিকল্পনা হচ্ছে শুনেই প্রচার ছেড়ে লখনউ ছুটলেন কল্যাণ সিং। তিনি রাজ্যপালকে অনুরোধ করলেন তাঁকে যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করার জন্য সময় দেওয়া হয়। এস আর বোম্মাই বনাম ভারত সরকারের কেসের উদাহরণ টেনে তিনি জানান, সদনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ একমাত্র সদনেই হতে পারে। তবে কল্যাণ সিংয়ের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করলেন না রাজ্যপাল রোমেশ ভাণ্ডারি। রাত সওয়া দশটা নাগাদ কল্যাণ সিং সরকারকে বরখাস্ত করা হয় এবং তাড়াহুড়ো করে জগদম্বিকা পালকে মুখ্যমন্ত্রী পদের শপথ পড়িয়ে দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের পর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার একটি রীতি রয়েছে। জগদম্বিকা পালকে এত তাড়াহুড়োয় মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল যে জাতীয় সংগীত গাইতেও ভুলে যান সকলে। জগদম্বিকা পালের পাশাপাশি লোকতান্ত্রিক কংগ্রেসের বিধায়ক এবং বিদ্যুৎমন্ত্রী নরেশ আগরওয়ালকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজনৈতিক পটচিত্র পরিবর্তন হয়ে যায় দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্যের।
পরদিন, অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা লখনউতে নিজের ভোট দিয়েই সরকারি গেস্ট হাউসে গিয়ে আমরণ অনশনে বসে যান অটল বিহারী বাজপেয়ী। এদিকে রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন উত্তরপ্রদেশের এই ঘটনায় অসন্তোষ জাহির করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্র কুমার গুজরালকে চিঠিও লেখেন। কিন্তু আসল রাজনীতি চলছিল লখনউয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে। সেদিন সকাল সকাল গিয়ে চেয়ার আগলে বসে পড়েন জগদম্বিকা পাল। একই সঙ্গে সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে হাজির হয়ে যান কল্যাণ সিং। সব ঘটনায় বিরক্ত কল্যাণ সিং ঠিক করলেন, এবার তাঁরা আইনের দ্বারস্থ হবেন। রাজ্যপাল রোমেশ ভাণ্ডারির সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক, এই মর্মে এলাহাবাদ হাইকোর্টে গেল বিজেপি। পরদিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট জানিয়ে দিল, রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বেআইনি এবং রায় দেওয়া হল জগদম্বিকা পালের সরকার বরখাস্ত করার। রায়দান হতেই অনশন তুলে নিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। শপথ নেওয়ার একদিনের মধ্যেই পড়ে গেল জগদম্বিকা পালের সরকার। কিন্তু এতেও মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি পেলেন না কল্যাণ সিং। হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গেলেন জগদম্বিকা পাল। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টে যেতেই একটি বড় ধাক্কা খেলেন তিনি।
আরও পড়ুন- বড় ভোটে মোদি, ছোট ভোটে মিঠুন! এবারে কার্যসিদ্ধি হবে, না কি খালি হাতেই ফিরতে হবে
ততক্ষণে উপমুখ্যমন্ত্রী নরেশ আগরওয়াল, লোকতান্ত্রিক কংগ্রেসের বিধায়ক হরিশ তিওয়ারি-সহ যাবতীয় বিধায়করা কল্যাণ সিং শিবিরে ফিরে গেছেন। গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার আদর্শ উদাহরণ এই ঘটনাটি। শুধু বিধায়করাই নন, মুখ্যমন্ত্রী আবাসের আর একটিও কর্মচারী জগদম্বিকা পালকে মুখ্যমন্ত্রী মানতে রাজি ছিলেন না। শোনা যায়, রায় ঘোষণার পর বিকেলে নিজের অফিসে বসেছিলেন জগদম্বিকা পাল। বিকেল হতেই তিনি কিছু জলখাবারের অর্ডার করেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর এসে বেয়ারা এক কাপ চা এবং দু’টি বিস্কুট দিয়ে বলে, “কল্যাণ সিং খাওয়ার পর যা রয়ে গেছে তাইই আপনাকে দিলাম।” যাই হোক, ২৪ ফেব্রুয়ারি জগদম্বিকা পালের করা মামলার শুনানি হল সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট একটি অভিনব রায় দিল। সুপ্রিম কোর্টের তরফে জানানো হল, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে টিভি ক্যামেরার সামনে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় ফ্লোর টেস্ট হবে। ফ্লোর টেস্টে যিনি জিতবেন, তিনিই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে তার আগে পর্যন্ত যেন কল্যাণ সিং এবং জগদম্বিকা পাল দু’জনের সঙ্গেই যেন মুখ্যমন্ত্রীর মতো আচরণ করা হয়। তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়ালো? খুবই অল্প সময়ের জন্য হলেও, একই রাজ্যে একই সময় দু’জন মুখ্যমন্ত্রী।
অবশেষে ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় হয় ফ্লোর টেস্ট। ৪২৫ সদস্যের বিধানসভায় কল্যাণ সিং পান ২২৫টি ভোট এবং জগদম্বিকা পাল পান ১৯৬টি ভোট। দলত্যাগ বিরোধী আইনের জেরে ১২ জনের ভোট (তাঁরা কল্যাণ সিংয়ের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন) বাতিল করে দেন স্পিকার কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। ফলত কল্যাণ সিংয়ের পক্ষে মোট ভোটের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১৩, যা জগদম্বিকা পালের বিধায়ক সংখ্যার থেকে বেশি। যথারীতি ফের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন কল্যাণ সিং। এর কয়েক সপ্তাহ পর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল সামনে আসে। বিজেপি অন্যান্য দলগুলির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়ে কেন্দ্রে। ১৬ মার্চ দেশের প্রধানমন্ত্রী রূপে শপথ নেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হতেই উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল রোমেশ ভাণ্ডারি বুঝতে পারেন এবার তাঁর বিদায়ও আসন্ন। তাই সেদিন সন্ধ্যেবেলাই ইস্তফা দিয়ে দেন রোমেশ। কেউ যথার্থই বলেছেন, ‘There is no permanent friend and no permanent enemy in politics’। আজ আপনি যখন এই লেখাটা পড়ছেন, তখন জগদম্বিকা পাল সেই বিজেপির টিকিটেই উত্তরপ্রদেশের সাংসদ। ২০১৪ থেকে পরপর দু'বার তিনি বিজেপির হয়ে ভোটে লড়ছেন। এর আগে ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের টিকিটেও সাংসদ ছিলেন।