মণিপুর অসুস্থ, রোগের খোঁজ রাখে না ভারতবর্ষ
Revisiting Manipur: কোথাও যেন মণিপুর ভীষণ ক্লান্ত, আর পারছে না। মণিপুর এখনও অসুস্থ। কবে মণিপুর সুস্থ হবে তার উত্তর আছে সত্যিই কারও কাছে?
বছর ঘুরে গেল মণিপুরে! এখন ভোট মরসুম। লোকসভা নির্বাচনের আবহে কে আর মনে রাখছে ওদের কথা? মাত্র দুটো আসন মণিপুরে। মনে রেখেই বা কী হবে? মণিপুর কেমন আছে, জানতে চাইল না প্রায় কেউই। মণিপুরে ভোটের টান নেই তেমন, তাই আর খোঁজও নিচ্ছে না কেউ। বছর ঘুরে গেলেও মণিপুরে এখনও ইম্ফলের লোক মেইতিরা যেতে পারে না চুরাচান্দপুরে। আর চুরাচান্দপুরের লোকেরাও এখনও ইম্ফল আসতে পারে না। মণিপুরে এখনও পাহাড় আর সমতলের মধ্যে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া, অবিশ্বাসের বেড়া।
মণিপুরের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে জানাল, “অনেক বদলে গেছে সবকিছুই। হিংসা কমেছে ,তবে আমরা এখনও উপরে যেতে পারি না, আর ওরা ইম্ফলে আসতে পারে না। যারা ঘর ছেড়ে চলে এসেছিল, তারা এখনও ক্যাম্পে আছে, ফেরত যেতেই পারেনি। তারা আর ফিরবেও না হয়তো।” খানিক ভেবে সেই সাংবাদিক আরও বলে, “আসলে আমরা মেনে নিয়েছি পরিস্থিতি আর ঠিক হবে না।” কোভিডের মতো এটাই মণিপুরে New Normal। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই।
আরও পড়ুন- শান্তি ফিরছে মণিপুরে, বলছেন প্রধানমন্ত্রী, আসল সত্যটা কী?
মহিলারা ক্যাম্পকেই নিজেদের বাড়ি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। সেখানে জনতা রান্নাঘরে এখন রান্না করেন তারা। কোনও নিজস্ব জায়গা নেই, কোনও গোপনীয়তা নেই এখানে। উপায় নেই। এভাবে থাকা ছাড়া কোনও উপায়ই নেই। "বুক ফেটে যায় কিন্তু কী করব উপায় নেই," বলছেন ইম্ফলের শিবিরে থাকা এক মহিলা। কীভাবে চলছে দিন? বললেন, “খাবার পাই, হিংসা কম। তবে কাজ নেই বরের, ওপরে দোকান ছিলো, এখন যা পাচ্ছে তাই করছে"। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠলেন মহিলা, “ফিরব না দিদি আমরা? সরকার কিছু করছে?” সরকারের কী করার কথা, সরকার কী কী করছে, সেই উত্তর নেই, এই মহিলার মতো অজস্র মহিলার এমন প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে।
হইনু পেশায় একজন সাংবাদিক। দিল্লিতে থাকে। ২০২৩ সালের ৩ মে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর বাড়িতে। বাবা, মাকে কোনওমতে বার করে গুয়াহাটিতে এনেছিল হইনু। ওঁর পরিবার এখনও ফিরতে পারেনি। ইম্ফলের হ্যাপি ভ্যালিতে হইনুর পোড়া বাড়ি ওভাবেই আছে এখনও, এক বছর পেরিয়েও।
হইনুর চোখে জল। বলল, "আমার বাড়ির একটা ছবি তুলে দেবে? কতদিন দেখি না। বলল, “কী বদলেছে? আমাদের মধ্যে যে ভাগ হওযা শুরু হয়েছিল তা আরও গভীর হয়েছে। সরকার চুপ, যেন আমাদের দরকার নেই! ৬০,০০০ লোকের ঠাঁই ক্যাম্পে! আমরা আশা করি না আর কিছু। হিংসা নেই কিন্তু এই যে চুপ করে আছে সবাই, এটাই সাংঘাতিক।”
নির্বাচনে হিংসাও হয়েছে। তবে কোথাও যেন গা সয়ে গেছে সেটাও। ক্যাম্পে যারা থাকে তাদের জন্য পুতুল তৈরির কাজ, আরও কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে বিবিধ এনজিও আর সরকারের তরফে। তাতে জীবন যে চলে না তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন- সারা বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদির নির্বুদ্ধিতা
কৈলাম গোবিন্দ মোরে তে স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন। এখন সবজি বিক্রি করেন ইম্ফলে। আমাকে বললেন, “আমি ১২,০০০ টাকা পেতাম মাইনে। ৩ তারিখ পালিয়ে আসি ইম্ফলে। মাসের পর মাস গেল। শিবিরেই আছি। কিছু করতে তো হবে, তাই এখন সবজি বিক্রি করি। কোনওরকম পেট চলে। সরকার বলেছিল বাড়ি যেতে পারব কিন্তু বছর ঘুরে গেল, কিছুই হলো না। মাঝে মাঝে আপনাদের মতো সাংবাদিকরা আসেন, লেখেন কিন্তু কিছুই হয় না। আজকাল সম্মানেও লাগে না। শিক্ষক থেকে সবজি বিক্রেতা হতে গেছি। বাঁচতে তো হবে?”
বাঁচতে তো হবে! কথাটা ধাক্কা দেয়, কথাটা শিকড় নাড়িয়ে দেয়। কৈলাম ভোট দেননি। ভোটের দিনও হিংসা হয়েছে সেখানে।
মণিপুরকে ফিরে দেখতে গেছিলাম, দেখলাম। কোথাও যেন মণিপুর ভীষণ ক্লান্ত, আর পারছে না। মণিপুর এখনও অসুস্থ। কবে মণিপুর সুস্থ হবে তার উত্তর আছে সত্যিই কারও কাছে?