সন্ত্রাসের নার্সারি, কাসভকে প্রশিক্ষণ! কেন মুরিদকের মারকাজেই প্রত্যাঘাত ভারতের?
Operation Sindoor Muridke Markaz: মারকাজ-ই-তৈবা নামে পরিচিত লস্কর-ই-তৈবার এই সদর দফতরটি জামাত-উদ-দাওয়ার নামে একটি দাতব্য সংস্থার ছদ্মবেশে পরিচালিত হয়।
বুধবার ভোরে অতর্কিতে সামরিক অভিযানে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী বদলা নিল গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসী হামলার। পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি সন্ত্রাসী-সংশ্লিষ্ট স্থানে হামলা চালাল ভারত। হামলার সময় ও স্থান যে ভারত নিজের ইচ্ছেমতো বেছে নেবে সেই বার্তা আগেই দিয়েছিল দেশ। সেই মতোই চালানো হলো অপারেশন সিঁদুর। তবে এই হামলাগুলি কোথায় চালানো হবে সেই স্থান নির্বাচনের পিছনে রয়েছে ভারতের সুনির্দিষ্ট মতামত। ভারত সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রক নিশ্চিত করেছে যে, যে জায়গাগুলিতে হামলা চালানো হয়েছে তার মধ্যে আছে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈবার ব্যবহৃত কিছু আস্তানা। এর মধ্যে সবচেয়ে হাই-প্রোফাইল নিশানা ছিল পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের লাহোরের কাছে মুরিদকেতে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ চত্বর। মসজিদ ওয়া মারকাজ তৈবা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈবার মতাদর্শিক এবং স্নায়ু কেন্দ্র।
ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে লাহোর থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, মুরিদকে লস্কর-ই-তৈবার সদর দফতর অবস্থিত। মারকাজ-ই-তৈবা নামে পরিচিত লস্কর-ই-তৈবার এই সদর দফতরটি জামাত-উদ-দাওয়ার নামে একটি দাতব্য সংস্থার ছদ্মবেশে পরিচালিত হয়। ৮২ একর জুড়ে বিস্তৃত এই মসজিদ চত্বরকে পাকিস্তানের 'সন্ত্রাসের নার্সারি" বলা হয়। ভারতীয় ভূমিতে হামলার ষড়যন্ত্র করা এবং বা মদত জোগানোর অভিযোগের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নজরে ছিল মারকাজ তৈবা মসজিদ চত্বর। কেন এই জায়গাটি এত গুরুত্বপূর্ণ পাক জঙ্গিদের একাংশের কাছে?
১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে আফগান জেহাদকে সমর্থন করার জন্য মারকাজ মূলত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে তখন এর এমন রূপ ছিল না। সোভিয়েতরা পিছু হটার পর, এটি ভারত-বিরোধী অভিযানের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ৯/১১ হামলার পর পাকিস্তান যখন লস্কর-ই-তৈবাকে নিষিদ্ধ করে, তখন মারকাজকে জামাত-উদ-দাওয়া নামে একটি মাদ্রাসার রূপ দেওয়া হয় কিন্তু, আড়ালে এটি লস্করের লক্ষ্যপূরণই করতে থাকে। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদ মারকাজ তৈবা। বলা হয়, আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন এই মসজিদের টাকা পয়সার বেশ খানিকটা জোগান দিতেন। তাঁর মদতে পরিচালিত মারকাজ তৈবা ছিল হাফিজ সাঈদের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। এই স্থানে লস্করের প্রচার কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একটি মাদ্রাসা, আবাসিকদের আবাসন এবং ধর্মীয় শিক্ষা, অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং নিয়োগের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও এখানে আছে হাসপাতাল, অফিস, ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক শাখা। যেন শহরের মধ্যে আস্ত এক শহর।
ভারতীয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বারবার স্থানীয় এবং বিদেশি দুই ধরনের যুবকদের মৌলবাদী করে তোলার ক্ষেত্রে এই এলাকার ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। বছরে আনুমানিক ১,০০০ শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। এই চত্বরে নিযুক্ত হওয়া পুরুষদের জন্য আছে সুফা আকাডেমি। নিযুক্ত মহিলাদের জন্যও একটি পৃথক শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। এটি লস্কর-ই-তৈবার উঁচুতলার নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে।
সূত্রের খবর, ২০০৮ সালের মুম্বই হামলায় জড়িত সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মারকাজ ব্যবহার করা হয়েছিল। এদের মধ্যেই ছিল আজমল কাসভ। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর নির্দেশনায় গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ (দৌরা-ই-রিব্বাফ) পেয়েছিল কাসভ।
লস্কর-ই-তৈবার জন্মস্থান ছিল আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশ। ১৯৯০ সালের দিকে আল-কায়েদার অর্থ সাহায্যে তৈরি হয় লস্কর।লস্কর-ই-তৈবা স্পষ্ট ভাষায় একটি সালাফি-জিহাদি সংগঠন। এর প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ জৈশ-ই-মহম্মদ আবার দেওবন্দি মতাদর্শে অনুপ্রাণিত। অনেক জঙ্গি সংগঠনই কাশ্মীরের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করলেও লস্করের লক্ষ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করা। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য লস্কর-ই-তৈবা সহ-প্রতিষ্ঠা করে হাফিজ মুহাম্মদ সাঈদ, জাফর ইকবাল এবং আবদুল্লাহ আজ্জাম। এর মূল গোষ্ঠী, মারকাজ-উদ-দাওয়া-ওয়াল-ইরশাদ (MDI), ছিল একটি সুন্নি মিশনারি সংগঠন যা ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামের সবচেয়ে গোঁড়া রূপ সালাফিবাদ প্রচারের জন্য।
এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীটি জম্মু ও কাশ্মীরে ফিঁদায়ে হামলার মতলব নিয়ে আসে, অর্থাৎ অভীষ্টের লক্ষ্যে আত্মঘাতী হামলা। ১৯৯৩ সালে, লস্কর-ই-তৈবার সন্ত্রাসীরা আইএসআই এবং উপত্যকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির সাহায্যে ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালে ১৬ জন হিন্দুকে হত্যা করেছিল এই গোষ্ঠী।
নয়াদিল্লির দাবি, মুরিদকেতে হামলা পহেলগাঁওয়ে পর্যটন কেন্দ্র বৈসরনে হামলার এক যথাযোগ্য প্রতিশোধ। লস্কর-ই-তৈবার ছায়া সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট পহেলগাঁও হামলার দায় স্বীকার করেছিল। ফলে লস্করের এই ঘাঁটিতে আক্রমণ ছিল ভারতের কাছে অত্যাবশ্যিক। মারকাজকে লক্ষ্য করে এই হামলা লস্কর-ই-তৈবার সন্ত্রাসবাদকেই এক মোক্ষম জবাব দেওয়া।