লকডাউন তুললেই করোনায় আক্রান্ত ২০ লাখ! চিনে প্রমাদ গুণছেন স্বয়ং চিকিৎসকরাই....

China Zero Covid Policy: প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে শেষমেশ কোভিড নিয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল জিনপিং সরকার। তারপরও লুকিয়ে রয়েছে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন।

২০২২ পেরিয়ে ২০২৩-এ প্রবেশ করতে চলেছে পৃথিবী। তবুও দু’বছর আগের ভয়াবহতার কথা এখনও ভুলতে পারেনি সভ্যতা। মহামারি, অতিমারি আর করোনা ভাইরাস – গোটা দুনিয়ার রোজনামচা হয়ে দাঁড়ায় এই শব্দগুলো। সেইসঙ্গে হাজির হয় লকডাউন। ঘরবন্দি সেই পৃথিবীর থেকে একটু একটু করে মুক্ত হয়েছি আমরা। সাম্প্রতিক সময় তার মধ্যেই আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে চিন। গোটা বিশ্ব যেখানে লকডাউন থেকে সরে এসেছে, সেখানে চিনে লাগাতার চলেছে বন্দিদশা। করোনা ঠেকাতে এমন ‘জিরো কোভিড পলিসি’, এবং লকডাউনের চূড়ান্ত কড়াকড়ি। তার প্রতিবাদেই পথে নেমেছে সেখানকার জনতা। হাতে ধরে থাকা প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা ‘ফ্রি চায়না’। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ।

“We don’t want to be locked, we want Freedom”। বেজিং, সাংহাই সহ একাধিক জায়গায় এমনই বক্তব্য শোনা গিয়েছে মানুষের মুখে। হয় লকডাউন মুক্ত করো, স্বাধীনতা দাও, নয়তো একেবারেই মৃত্যু দাও – এই প্রতিবাদই তুলে ধরেছিল সংবাদমাধ্যমগুলি। সম্প্রতি তারই ফলাফল সামনে এল। প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে শেষমেশ কোভিড নিয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল জিনপিং সরকার। বিমানে হোক বা সাধারণ বাস, ট্রেন, গাড়ি – এতদিন চিনে সবকিছুতেই কোভিড পরীক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে সেসব এখন আর লাগবে না। পাশাপাশি সাংহাইয়ের সমস্ত শপিং মল, দোকান বাজারও খোলা হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। সমস্ত পার্ক, খোলা জায়গায় প্রবেশ করতেও কোনও কোভিড শংসাপত্র লাগবে না। ফলে সাময়িক স্বস্তি ফিরেছে চিনের জনগণের মধ্যে। কিন্তু…

আরও পড়ুন : স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমজনতার লড়াই! চিনের দুর্দশাকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারে ভারত?

হ্যাঁ, এখানেও লুকিয়ে রয়েছে একটা বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন। তবে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একবার চিনের পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া যাক। করোনা মহামারির সূত্রপাত চিন থেকে হয়েছিল। পোorররথিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও আশঙ্কার মেঘ সরেনি। বারবার করোনার ধাক্কা নেমে এসেছে চিনের ওপর। চলতি বছরের শুরুতে ফের সাংহাইয়ে করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেড়েছিল। ফলে অতিরিক্ত কড়া পদক্ষেপ জারি করে চিনের প্রশাসন। ‘জিরো কোভিড পলিসি’ প্রয়োগের ফলে অনন্তকাল ধরে চলে লকডাউন। করোনার বাড়বাড়ন্ত আটকাতে এমন প্রয়াসই পরে ব্যুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাসনের অতিদমন নীতির জেরে সমস্যায় পড়ে স্থানীয় মানুষরাই।

আসল বিক্ষোভ শুরু হয় বেশ কয়েকদিন আগের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। চিনের শিনজিয়াং প্রদেশের উরুমকিতে একটি বহুতলে হঠাৎই আগুন লাগে। ভেতরে আটকে পড়েন বেশকিছু মানুষ। কিন্তু তাঁরা আর সেখান থেকে বেরোতে পারেননি। কেন? স্থানীয়দের বক্তব্য, এর জন্য দায়ী ‘জিরো কোভিড পলিসি’। সম্পূর্ণ লকডাউন থাকার কারণে দমকল কর্মীরা ঘটনাস্থলে যেতে পারলেন না। ফলে আটকে রইলেন ওই মানুষগুলো। শেষমেশ আগুন লাগার ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যু হয়। চিনের বেশকিছু সংবাদপত্র আরও মর্মান্তিক খবর সামনে আনে। কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য এক ১৪ বছরের শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়নি। এসবের জন্যই শুরু হয় বিদ্রোহ, আন্দোলন। বেজিং, সাংহাই সহ বেশকিছু জায়গায় গর্জে ওঠেন মানুষ। শেষমেশ সেই লকডাউন নীতি একটু একটু করে তুলে দেওয়ায় মানুষজন খুশি।

কিন্তু…

এই পুরো ঘটনাটিতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন গবেষকরা। কারণ? ডাক্তার ও গবেষকদের আশঙ্কা, লকডাউন নিয়ে এই ‘জিরো কোভিড পলিসি’ একটু একটু করে সরানো হলে ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে করোনার সংক্রমণ। চিনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইতিমধ্যে গত ৪ ডিসেম্বর শানডং এবং শিচুয়ান প্রদেশে দু’জন মারা গিয়েছেন। এখানেই প্রমাদ গুনছেন গবেষকরা। সংখ্যার বিচারে এটা যত সামান্যই হোক, ভবিষ্যতে এটাই বড়ো আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন তাঁরা। এই বিষয়ে তাঁরা হংকংয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন। করোনা নিয়ে বিধিনিষেধ একেবারে শিথিল করার পর সেখানেও ফের নতুন করে সংক্রমণ বেড়েছিল। চিনের বিপুল জনসংখ্যার কথা বিবেচনা করে ফের সেই প্রসঙ্গটাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

আরও পড়ুন : এখনও কেন লকডাউন চিনে! সাদা কাগজ নিয়ে বিক্ষোভকে ডরাচ্ছে কমিউনিস্ট চিন?

কেন এমন পরিস্থিতি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টই প্রভাব বিস্তার করছে সবথেকে বেশি। এদিকে পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, এই মুহূর্তে চিনের ৯৫ শতাংশেরও বেশি করোনা আক্রান্তেরা ’Asymptomatic’; অর্থাৎ কোনও রকম উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। উপসর্গ থাকলেও তা খুব সামান্য। মামুলি জ্বরের পর্যায়ে নেমে আসায় করোনায় মৃতের সংখ্যাও আগের থেকে অনেকটাই কম। তবুও গবেষকরা প্রমাদ গুনছেন। কারণ, চিনে এখনও বহু মানুষ সঠিকভাবে ভ্যাকসিন পাননি।

আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত চিনের বয়স্ক মানুষদের একটা বড়ো অংশ কোভিডের তিনটে ভ্যাকসিন পাননি। কেবলমাত্র সাংহাই প্রদেশেই ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মাত্র ৩৮ শতাংশ করোনার তিনটে টিকাই পেয়েছেন। ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে এই হিসেবটা আরও কম। অন্যান্য জায়গাতেও পরিসংখ্যান প্রায় এরকমই। ফলে ভাইরাস যত দুর্বলই হোক না কেন, তার শক্তি একেবারে হ্রাস পায়নি। ভ্যাকসিনেশনের এরকম পরিসংখ্যান থাকলে আরেকটা বড়ো ঢেউ আসাটা কেবল কিছু সময়ের অপেক্ষামাত্র। তাতে বেশি আক্রান্ত হবেন এই বয়স্ক মানুষেরাই। ফলে সব মিলিয়ে গ্রাফ ফের ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে, আশঙ্কা গবেষকদের।

আরও পড়ুন : এখনও হয়নি যথেষ্ট টিকাকরণ, বিশ্বজুড়ে নখ শানাচ্ছে করোনা! আবার অতিমারী?

কতটা ভয়ংকর হবে পরিস্থিতি? সংবাদ সংস্থা রয়টার্স বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের এই নিয়ে প্রশ্ন করে। সেখান থেকেই জানা যায়, লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে চিনে ২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবেন। ব্রিটিশ সায়েন্টিফিক ইনফরমেশন অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স কোম্পানি ‘এয়ারফিনিটি’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লকডাউন উঠিয়ে নিলে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে। এর কারণ হিসেবেও বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছে সংস্থাটি।

তাহলে উপায়? ফের অনন্তকাল লকডাউন নেমে আসবে চিনের বুকে? বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সেটা বলছেন না। বরং এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে চিনের প্রশাসনকে ‘প্ল্যান বি’ তৈরি করতে বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, সবার আগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মজবুত করতে হবে। কেন এতো সংখ্যক মানুষের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছয়নি, সেটা দেখতে হবে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিনেশন শুরু করতে হবে। কেবল বুস্টার নয়, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজও অনেকেই পাননি। রোগ প্রতিরোধ করতে পারলে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। ফলে করোনাকে রোখাও যাবে। লকডাউন ফের প্রয়োগ করা হলেও তাতে দেশের মানুষদের যাতে এক ফোঁটাও অসুবিধা না হয়, সেটাও নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আপাতত সেই পরিস্থিতির দিকে তাকিয়েই গোটা বিশ্ব। চিনে করোনা সংক্রমণ বাড়লে কি গোটা বিশ্বে ফের ফিরে আসবে আতঙ্ক? সেই আশঙ্কাও ওড়াচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।

More Articles