পদ্মা সেতুই নির্বাচনে বৈতরণী পার করাবে হাসিনাকে?

২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের নির্বাচনে পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করলেন।

বাংলাদেশে ঐতিহাসিক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে উন্মাদনা আর উদ্দীপনার রেশ এখনও থিতোয়নি– কিন্তু ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে এই সেতুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষার পালা। ফেসবুক-ইউটিউবে পদ্মা সেতু নিয়ে তৈরি হয়েছে লক্ষ লক্ষ টেরাবাইটের কনটেন্ট– কিন্তু ভোটে তার প্রতিফলন কী হবে, তা নিয়েই এখন শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, 'দ্য ডেইলি স্টার'-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম প্রায়ই বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করে থাকেন। সেই মাহফুজ আনামও এক নিবন্ধে লিখেছেন, "এ-পর্যন্ত বহু দেশই তাদের নিজস্ব অর্থায়নে নিজেদের দেশের সেতু তৈরি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ খুবই ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ– যেহেতু আমাদের দেশ এই সেতুটি নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারের কাছে ‘চ্যারিটি’ বা দান-খয়রাতির উপর নির্ভরশীলতার নেতিবাচক ভাবমূর্তিকে চিরতরে ভেঙ্গে দিয়েছে।"

২০২৩ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী বছরের নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনায় উল্লেখযোগ্য সহায়ক হিসেবে দেখছেন। ২০২৩ সালের নির্বাচনে যদি এমনটাই ঘটে, তাহলে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হবেন– যা এদেশের ইতিহাসে কখনও হয়নি।

আরও পড়ুন: লাখো বাংলাদেশির স্বপ্ন, নজরকাড়া পদ্মা সেতু যে কারণে গোটা বিশ্বকে অবাক করছে

শক্তিশালী পদ্মা নদী বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকা থেকে অনেকটা সময় ধরে আলাদা করে রেখেছিল। বর্ষার মরশুমে উত্তাল পদ্মা পার হওয়া বেশ কঠিন। তাছাড়া ফেরিঘাটগুলোর চিরচেনা যানজট তো রয়েছেই। ফলে ওই অঞ্চলের মানুষদের ফেরি বা লঞ্চে পারাপার করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও দরকারি কাজগুলো সারতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হতো।

অনেকেই মনে করছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করে দেশটির দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের শরিয়তপুর, খুলনা, যশোর-সহ অন্তত ২১টি জেলা এবং উত্তরাঞ্চলের বরিশাল জেলার মানুষের দারিদ্র দূর করতে সরাসরি প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করবে পদ্মা সেতু- যা হবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমর্থনের একটি প্রধান উৎস।

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান যেমন বলছেন, "পদ্মা সেতু মোট জিডিপির বার্ষিক ১.৩% বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কর্মসংস্থান, সেবা কার্যক্রম ও পর্যটন বৃদ্ধি পাবে।"

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর আগে কখনওই এরকম একটা মেগা প্রোজেক্ট চালানোর ক্ষমতা ছিল না। আমরা পদ্মা সেতুর স্থাপনা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি, এটাই আমাদের বিশাল জিত।”

প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতার সঙ্গে বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থায় তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় কমে আসবে ঢাকা-বেনাপোল-কলকাতা রুটে আর এটা সম্ভব করবে পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের চট্রগ্রাম বন্দর-সহ গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে শুধুমাত্র ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বাকি প্রতিবেশী দেশগুলোরও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাজারে সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক লাভ হবে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক স্থাপন করাও সহজ হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লিগ সরকার ২০২৩ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেও পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।

একসময়ের বিখ্যাত মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে 'বাস্কেট কেস' নাম দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্ক-সহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থা ঋণ দিতে অস্বীকার করলে 'বাস্কেট কেস' স্টিরিওটাইপ থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন, বৈশ্বিক অর্থায়নে নয়, স্ব-অর্থায়নে তৈরি করা হবে পদ্মা সেতু। সরকারি তহবিল ও দেশের জনগণের টাকা দিয়ে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। দীর্ঘ আট বছর পর নির্মাণকাজ শেষ হলে অবশেষে, ২৫ জুন, ২০২২ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন।

দক্ষিণ এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য-সহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর কূটনৈতিকরা পদ্মা সেতুর সাফল্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শুভেচ্ছাবাণীতে শামিল ছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থা, এমনকী, বিশ্ব ব্যাঙ্কও।

এদিকে ২৫ জুন মধ্যরাত থেকেই লঞ্চে করে হাজার হাজার সরকারি সমর্থক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শুরু করেন পদ্মার পাড়ে। দুপুর নাগাদ অচিরেই জনসমুদ্রে পরিণত হয় পদ্মাপাড়ের জাজিরা প্রান্ত। পদ্মা সেতুকে এক নজর দেখতে বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল, সাইকেল এমনকী, পায়ে হেঁটেও দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে উৎসুক জনতা। রংবেরংয়ের টি-শার্টে আসেন বহু উৎসবমুখর মানুষ, কেউ আবার নিজেদের গায়ে শেখ হাসিনার ট্যাটু বানিয়ে আসেন, কেউ কেউ মাথা কামিয়ে চুল দিয়ে নৌকোর ডিজাইন করেন। নাচ, গান, ঢাক, ঢোল আর বাঁশি বাজিয়ে হাতে ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করতে করতে সমাবেশে জড়ো হয় লাখো মানুষের জনসমুদ্র।

বর্ণিল সাজে সাজানো হয় মাওয়া-জাজিরার দুই পাশের মহাসড়ক ও নদীর তীর। নৌকো বাইচের আয়োজন করা হয়, এমনকী লঞ্চ ও নৌকোগুলোকে বাহারি সাজে সাজিয়ে নৌ-পথেও মিছিল করতে করতে সমাবেশে এসে পৌঁছয় উৎসুক জনতা।

একদিকে পদ্মার পাড়ের দখিনা হাওয়ায় ৬ কিলোমিটারজুড়ে বিজয়ের উল্লাসে উপস্থিত দেশের একাংশের জনতা, অন্যদিকে দেশ ও বিদেশের বাকি বাংলাদেশিরা একযোগে লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে। এ যেন ষোলো কোটি জনতার বহু-অপেক্ষিত পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন সত্যি হতে দেখার আবেগের ঢেউ।

এরকম একটা মেগা ইভেন্টের মেগা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু চালু হবে, বাংলাদেশে অনেকেই তা ভাবতে পারেননি। আর এই অসম্ভব স্বপ্নটাকে সত্যি করতে পেরেছেন বলেই আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনাও প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে যোজন দূরত্বে এগিয়ে রইলেন।

২০২৩ সালের আসন্ন নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা শেখ হাসিনার সরকারের জন্য একটি বিশাল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও ছিল বটে। সেতুটি ঠিক সময় উদ্বোধন না হলে ২০২৩ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে দেখা যেত, যার কারণে টানা চতুর্থবার দলের জেতার সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত। বিরোধী দল বিএনপি-ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজে ত্রুটি ও ব্যর্থতা নিয়ে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পেয়ে যেত। কিন্তু শেখ হাসিনা তা হতে দেননি।

বলাই বাহুল্য, ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের নির্বাচনে পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করলেন। দেশের মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার ক্ষমতা প্রদর্শন, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষমতা ও বিশ্বাস স্থাপন-সহ বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল চিহ্ন তুলে ধরারই প্রতীক হল পদ্মা সেতু।

শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লিগের নির্বাচনী প্রতীক হল নৌকো– আর সেই নৌকোয় চেপেই তারা এতকাল নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছে। আগামী নির্বাচনে শুধু নৌকো নয়, ভোটের নদী পেরতে একটি সেতুও হতে চলেছে তাদের বড় ভরসা!

 

More Articles