সরকার থেকে আম জমায়েত, গুঁড়িয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনের পাশে স্পেন

Protest Against Palestine War in Spain : স্পেন এবং আয়ারল্যান্ড এই দু'টি দেশ ফিলিস্তিন ইস্যুতে সামগ্রিকভাবে ভিন্ন অবস্থান নেওয়ার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে।

স্পেনে এবারে শীত বেশ অন্যরকম। এই বছরই দক্ষিণ স্পেনের রেকর্ড ছুঁই ছুঁই গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের, দক্ষিণাঞ্চলে আন্দালুসিয়ার ক্রমশ মরুকরণ, জল সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন - বৈশ্বিক উষ্ণতার উদ্বেগ, এবং তার মাঝে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু শীত জমাট বাঁধার আগেই স্পেনের রাজপথে মানুষের ঢল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বন্ধুরা জানায়, স্পেনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একইসঙ্গে এত বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথ উত্তাল হওয়ার কথা তারা খুব একটা মনে করতে পারে না।

কলকাতাতে অহরহ রাজপথ উত্তাল হতে দেখা চোখ যখন পশ্চিম ইওরোপের সুনির্দিষ্ট এবং মার্জিত প্রতিবাদের ভাষার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া শুরু করতে থাকে তখনই এহেন স্পেন যেন মনে করিয়ে দেয় তিলোত্তমার চেতনা এবং তার বহিঃপ্রকাশকে। মূলত অক্টোবরের শেষ থেকে স্পেনের বড় বড় শহরগুলিতে ফিলিস্তিনের সমর্থনে মিছিল বের হতে থাকে। মাদ্রিদ এবং মূলত বার্সেলোনা বিশ্বের খবরের শিরোনামে আসতে শুরু করে প্রতিবাদের কারণে। যুদ্ধ যত বাড়ে এবং গাজার নৃশংসতার ছবি যত সামাজিক মাধ্যম মারফত বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, স্পেনের মিছিলও বৃহত্তর হতে শুরু করে এবং তা আরও বেশি শহরে প্রকটভাবে দেখা যায়।

আমি সেভিয়া বলে যে শহরে থাকি, সেখানে প্রথমদিকে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংগঠনকেন্দ্রিক সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। আমার মনে আছে, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে লিফলেট বিলি এবং পথসভার আয়োজন দেখা যেতে শুরু করে। ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং প্রতিরোধের ইতিহাস নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস শুরু হয় ধীরে ধীরে। একপাক্ষিক আক্রমণ এবং নিরীহ মানুষদের মৃত্যুর খবর বাড়তে থাকায় এই প্রতিবাদের সক্রিয়তা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালের বাইরে রাজপথেও ছড়িয়ে পড়ে। নভেম্বরের শেষভাগ থেকে ডিসেম্বরের এখনও পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন নাগরিক মঞ্চ, ছাত্র সংগঠন, অবসরপ্রাপ্তদের সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনগুলির যৌথ প্রতিবাদ মিছিল কর্মসূচি খুবই সক্রিয়ভাবে দেখা যেতে থাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির পাশাপাশি।

আরও পড়ুন- যুদ্ধ কেড়েছে ঘর, সন্তানদের দূরে পাঠিয়ে গাজায় জেগে একা সাংবাদিক

'পাশ্চাত্য' যখন একটা গোষ্ঠী হিসেবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বে এক হয়ে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে, তাৎপর্যপূর্ণভাবে স্পেন এবং আয়ারল্যান্ড এই দু'টি দেশ ফিলিস্তিন ইস্যুতে সামগ্রিকভাবে ভিন্ন অবস্থান নেওয়ার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। একদিকে ইওরোপিয় ইউনিয়নের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই দুই দেশ ক্রমাগত যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব রাখবার চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে ইজরায়েলকে অর্থ সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাবের লাগাতার বিরোধিতা করবার চেষ্টা করেছে। স্পেনের বর্তমান সরকারের পদাধিকারী মন্ত্রীরা ইওরোপিয় ইউনিয়নের ফিলিস্তিনের জন্য বরাদ্দ মানবাধিকার 'এইড' আটকে দেওয়ার ঘটনার জনসমক্ষে নিন্দে করেছে এবং এর নেতৃবৃন্দকে তুলোধনা করেছে।

সামগ্রিকভাবে যেখানে অন্যান্য পশ্চিম ইওরোপের দেশগুলি ফিলিস্তিনের সমর্থনে প্রতিবাদকে বিভিন্নভাবে লাগাম পরানোর চেষ্টা করেছে, যার থেকে ছাড় পাননি ফুটবল তারকারাও - সেখানে স্পেন এক অদ্ভুত ব্যতিক্রম। তাই হয়তো অন্যান্য ইওরোপিয় শহরের যেখানে পুলিশদের সঙ্গে প্যালেস্তাইনের সমর্থনে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের কথা দৈনন্দিন খবরের শিরোনাম, সেখানে স্পেনের সরকার এবং এই জমায়েতগুলি প্রায় একই সুরে কথা বলছে।

স্পেনের এই পরিস্থিতি ইউরোপিও বিশ্লেষকদের কাছে আরও আশ্চর্যজনক কারণ স্পেন এইবছর এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের দোরগোড়ায় চলে এসেছে বহুবার। অভিবাসন সংকটে ইওরোপিয় রাজনীতিতে তীব্রভাবে দক্ষিণপন্থার আবির্ভাব ঘটেছে এবং একের পর এক জাতীয় নির্বাচনে ইতালি, নেদারল্যান্ডস থেকে সুইডেনে অতি ডানপন্থীরা ক্ষমতা দখল করেছে। এই একই সময়ে আবার সমস্ত পূর্বাভাস উল্টে দিয়ে স্পেনের সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি এবং পেদ্রো স্যানচেজ কোনওমতে ক্ষমতাসীন জোট গঠন করতে পেরেছে ক্যাটালান পার্টির সমর্থনে। সেখানকার রাজনৈতিক বোঝাপড়া এবং সম্প্রতি অতি বিতর্কিত 'ক্যাটালান অ্যামনেস্টি ডিল'-এ ডানপন্থী শক্তিগুলোর নেতৃত্বে স্পেনের রাজপথ বড় বড় মিছিল এবং বেশ কিছু সহিংস বিক্ষোভ দেখেছে, যেখানে রায়ট পুলিশকে নামতে হয়েছে।

আরও পড়ুন- ভাঙা হুইলচেয়ার, কানে আসে না বোমার শব্দ! কেমন আছেন গাজার ৯৩,০০০ বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ?

একই সময়ে, এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার পরিস্থিতিতেও এরকম প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতির নিদর্শন সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। তবে এই আপাত বিস্ময় অন্যভাবে পর্যালোচনা করা যায় ইতিহাস ঘেঁটে। একদিকে পশ্চিম ইওরোপের বেশিরভাগ দেশেই যেখানে অপরাধবোধ খুবই প্রকট ইহুদিদের নিধন এবং নির্বাসন নিয়ে, বিশেষ করে জার্মানি এবং ইতালিতে, সেখানে স্পেনের ইতিহাস খানিক অন্যরকম।

বিশেষত দক্ষিণ স্পেনের ইতিহাসে রয়েছে খ্রিস্টিয় এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের একে অপরের বিপক্ষে তীব্র লড়াই। যার সমাপ্তি হয় ১৪৯২-তে গ্রানাদা থেকে নাসরিদ রাজত্বের পতনের মধ্যে দিয়ে, যা ইতিহাসে 'ফল অফ গ্রানাদা' নামেই বিশেষ পরিচিত। এর পরেই শুরু হয় 'স্প্যানিশ ইনকুইজিশন' যা চলে ১৮৩৪ পর্যন্ত। সেখানে অ-খ্রিস্টিও মানুষদের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় যদি না তারা ক্যাথলিক ধর্মে ফেরত আসে। এরকম প্রচুর নিদর্শন আছে যেখানে ইহুদিদের তবুও বিভিন্ন ঘেটোতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয় কিন্তু মুসলিমদের স্পেন থেকে (এবং মূলত আন্দালুসিয়া থেকে) সম্পূর্ণভাবে নির্বাসিত করা হয়।

প্রায় সমস্ত মসজিদই ক্যাথেড্রাল বা চার্চে রূপান্তরিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, আন্দালুসিয়ার অনেক চার্চের নামের মধ্যেই মসজিদ শব্দটি দেখা যায়, যেমন সম্প্রতি অতি বিতর্কিত কর্দোবা শহরের মেজকুইটা (মসজিদ)-ক্যাথেড্রাল দে কর্দোবা। আধুনিক সময়ে ইতিহাস বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে। তার নিদর্শন হিসেবে অনেক সামাজিক আন্দোলনকে বোঝার উপায় বের করা হয়ে থাকে। এবং ঠিক সেরকমভাবেই হয়তো স্পেনের শীত এবং তার রাজপথকে খানিকটা বোঝার চেষ্টা করা সম্ভব।

More Articles