সন্ত্রাস ছাড়া জয় নেই! শেষ ২০ বছরে বাংলার পঞ্চায়েত মানেই লাশের রাজনীতি
Panchayat Election Result 2023: শনিবার মারা যাওয়া ১৩ জনের মধ্যে ৭ জনই ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী। আর সবচেয়ে মৃত্যু ঘটেছে মুর্শিদাবাদে!
দিনের শেষে লাশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৩। যুদ্ধ না, সাম্প্রদায়িক হানাহানি না, সন্ত্রাসবাদী হামলা না, স্রেফ গণতন্ত্র 'বাঁচাতে' গিয়ে মারা গিয়েছেন ৩৩। রাজ্যে, মানে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ হয়েছে। গণনা চলছে। ভোট গোনার পর লাশ গোনা হবে আগামী অন্তত একপক্ষকাল জুড়ে। গণনা পরবর্তী হার-জিতে এই ৩৩ বেড়ে কোথায় পৌঁছবে কেউ জানে না। জানে না ঠিকই, কিন্তু অভ্যস্ত। রাজ্যে ভোট হবে, হিংসা হবে, লাশ পড়বে, বোমা ছোঁড়া হবে এই নিয়ে রাজ্যের মানুষ এখন মাত্রাতিরিক্ত অভ্যস্ত। আসলে শুধু তো চলতি পঞ্চায়েত ভোটে না, বহুকাল ধরেই গ্রাম দখলের লড়াইতে হিংসা প্রত্যক্ষ করেছে মানুষ। হিংসা আসলে রাজ্যের নির্বাচনী রাজনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
২০১৩ সালেও এমনটাই ছিল, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও ছবি বদলায়নি। ২০১৩ সালে ভোটের দিন সরকারি তথ্য অনুযায়ী মৃত্যু হয়েছিল ১৩ জনের। ২০১৮ সালে সংখ্যাটা ছিল ১৪ জন। যদিও সকলেরই জানা, সরকারি হিসেবে যা লিখতে হয়, বাস্তবের সঙ্গে তার ফারাক বেশ অনেকটাই। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রায় ৮০ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালে সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৫ জন। ২০১৩ সালে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩১ জন। ২০১৮ সালে তা সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেয়। সেই বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসায় প্রাণ যায় ৭৫ জনের!
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে মৃত্যু হয় ৯ জন মানুষের। এর দু' বছর পরে বিধানসভা নির্বাচনে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। তবে নির্বাচন পরবর্তী হিংসা ছিল আরও বীভৎস। ভোট পরবর্তী হিংসাতে ২০২১ সালে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়। হিংসা ছাড়া জয় নয়, এই রাজ্যে মোটামুটি প্রমাণিত। এই মেয়াদগুলিতে তৃণমূল কংগ্রস প্রতিবারই ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু রাজার মেয়াদ অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে বোড়েদের প্রাণ গিয়েছে। এবারের ভোটেও তৃণমূল কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য চোখে পড়েছে। বিকেল অবধি যা গণনা এগিয়েছে, তাতে গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের নির্বাচনে ১৪,৭৬৭ টি আসন জিতেছে তৃণমূল। সে তো জানা কথাই। রাজ্যে শাসকের হাতে গ্রাম যদি না থাকে, তাহলে কীসের আর ক্ষমতা! ঠিক এই ভয়েই প্রতি পঞ্চায়েত রক্তে লাল হয়ে যায়। কোথাও যাতে লাগাম বিন্দুমাত্র না নড়বড়ে হয় তা নিশ্চিত করতে গিয়ে নিচুতলার কর্মীদের প্রাণ যায়।
আরও পড়ুন- মানুষ বড় সস্তা! ফের প্রমাণ করল ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোট
এবারের পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের ভোট যেভাবে ভাগ হয়েছে তা চোখে পড়ার মতো। এই আশঙ্কা করেছিল শাসক। বহুকাল পর বামেদের আসন বেড়েছে সামান্য হলেও, কুড়মিদের ভোটব্যাঙ্ক এর আগে বিজেপিদের সাহায্য করলেও এবার আর শিকে ছেঁড়েনি। জঙ্গলমহলে বিজেপি দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আদিবাসী ভোটের একটা বড় অংশই স্পষ্টত সরে গিয়েছে বিজেপির মাথার উপর থেকে। সেই লাভের গুড় খেয়েছে তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েতে বামেরা পেয়েছে ১,০৮৬ টি আসন। কংগ্রেস ৭৮৩ টি আর বিজেপি ৩,৩৪৪ টি! এখনও অবধি তাও তৃণমূলই সর্বে সর্বা। একক আধিপত্য তার। তাই যেকোনও উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার মনোবৃত্তিই ডেকে এনেছে অবশ্যম্ভাবী হিংসা। অস্বস্তিকর হলেও এটি সত্য যে, এই হিংসা আর মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, আগামীতেও। কিন্তু গল্প এখানে নয়। তৃণমূল যদি সর্বেসর্বা হতে মরিয়া হয় তাহলে যারা মারা গেলেন তারা বিরোধী হওয়া স্বাভাবিক? এখানেই বড় এক বিস্ময়! একের পর এক মারা গিয়েছে তৃণমূলেরই কর্মীরা। শনিবার মারা যাওয়া ১৩ জনের মধ্যে ৭ জনই ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী। আর সবচেয়ে মৃত্যু ঘটেছে মুর্শিদাবাদে!
মুর্শিদাবাদ প্রতি পঞ্চায়েতে সবচেয়ে উত্তপ্ত জেলা! ক্ষমতায় থাকা কোনও দল কোনওদিনই এই জেলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। মুর্শিদাবাদে বরাবরই শক্তিশালী কংগ্রেস। রাজ্যে বাম আমলে আর পালা বদলের পরে তৃণমূলের আমলেও যতবারই মুর্শিদাবাদে পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদল জিততে চেয়েছে, হিংসা বেঁধেছে। তৃণমূল লাখো চেষ্টা করেও কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা তথা বর্তমান প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরীকে কোণঠাসা করতে পারেনি।
সম্প্রতি সাগরদিঘির উপনির্বাচনে এক আজব ঘটনা ঘটে। তৃণমূলকে হারিয়ে দেয় কংগ্রেস। কিন্তু জেতার পরেই তৃণমূলে নাম লিখিয়ে ফেলেন উপনির্বাচনে কংগ্রেসের টিকিটে জেতা বায়রন বিশ্বাস! এই ঘটনাটির প্রভাব অবশ্যই পড়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও।