দুর্নীতির শিখরে একাই পার্থ-অনুব্রত, না কি নেপথ্যে আরও বড় জাল? বাড়ছে জল্পনা
তাহলে কি এই দুর্নীতির পাহাড়ের অন্দরেও রয়েছে এমন কোনও আশ্চর্য প্রদীপ, যার আলোকে শুধুই একাকী, নিঃসঙ্গ পার্থ নন, দেখা যাবে অন্য কিছুও!
'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে..!' এখন আর ঝাঁ চকচকে পার্টি অফিসে পায়ের চিহ্ন পড়ে না দলের প্রাক্তন মহাসচিবের। মন্ত্রিসভার বৈঠকও থাকে পার্থহীন। কালীঘাটের নেত্রীগৃহেও দেখা মেলে না পার্থর। বোলপুরের নিচু পট্টির উঁচু দরের নেতার আসনও আজ ফাঁকা! খাঁ খাঁ করে আজ গমগম করা সেই ঘর। শিবের মাথায় বেলপাতা অথবা মা কালীর পুজো আর করেন না কেষ্ট!
আজ যেন সবকিছুর মধ্যেই অনেকটা ফাঁকা! এঁরা বিলীন হয়েছেন সাময়িকভাবে। একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতারা আজ দুর্নীতির 'কালো দায়' নিয়ে জেলবন্দি। কেউ কেন্দ্রীয় এজেন্সির ঘেরাটোপে কাটাচ্ছেন দিন। যাঁরা একদা নির্দেশ দিতেন, তাঁরাই এখন নির্দেশ পালন করছেন রোজ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটে সবকিছুর। বদলে যায় আশপাশ। বদল ঘটে পরিস্থিতির। রাজনীতিও আলাদা কিছু নয়। মুহূর্তেই বদলে যায় প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতির আচমকা দাবদাহে একদা প্রভাবশালী হারান ক্ষমতা, আবার মাটি থেকে আকাশসম উচ্চতায় পৌঁছে যান কেউ কেউ। বঙ্গের রাজনীতি এবং বর্তমানের পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অনুব্রত মন্ডলের উদাহরণ যেন তারই ইঙ্গিত বহন করে।
আরও পড়ুন: বদলে যাচ্ছেন মমতা! এবার কি বদলাচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক লাইন?
এঁরা আজও প্রভাবশালী রয়েছেন কি না, কতটা দোষী, আদৌ কিছু করেছেন কি না, তা নিয়ে একাধিক প্রশ্নের মধ্যেও একথা মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত, এইরকম আচমকা জীবনের গতিপথ পরিবর্তন বোধহয় ঘুণাক্ষরেও টের পাননি ওঁরা।
আচমকা উপহার পাওয়ার মতো বিজেপি-সহ বিরোধীরা এই পর্বে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করলেও প্রশ্ন উঠেছে বিজেপির অমিত শাহ-পুত্র জয় শাহের সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে। ব্যাপম কেলেঙ্কারি নিয়েও কথা তুলছেন কেউ কেউ। বিরোধীদের নাস্তানাবুদ করতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অপব্যবহার নিয়েও বিতর্ক হয়েছে বিস্তর।
কোটি কোটি টাকার পাহাড় সন্ধানের আবহেই অবাক হয়েছে জনতা। আবেগে তৃণমূল করা কর্মীর মনেও শুরু হয়েছে টানাপড়েন। প্রশ্ন উঠেছে সত্তা এবং সম্মানের সঙ্গে দল করা নিয়ে! সমস্ত দোষ উপনীত হয়েছে জেলবন্দি পার্থর ওপরেই! অর্থাৎ, একদা দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড, অভিষেক-প্রভাবে 'তৃতীয়' হলেও প্রভাবশালী থেকেও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, অভিযোগ উঠেছে তা নিয়েও। ক্রমশ দলের প্রভাব কাজে লাগিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন আখের! অর্থাৎ দল নয়, দায় অভিযুক্ত নেতা বা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত; এই বিষয়টি জোরালভাবে প্রতিষ্ঠিত করার তীব্র প্রচেষ্টার আবহেও প্রশ্ন উঠছে।
প্রশ্ন উঠছে এই কেলেঙ্কারি, এই দুর্নীতি কি শুধুই একার? একজন দীর্ঘ দিনের জনপ্রতিনিধি কেন কোটি কোটি টাকার পাহাড় জমাবেন, কী কারণে টাকার অট্টালিকা তৈরি করবেন তিনি, এই প্রশ্ন তো উঠবেই। পার্থ অভিযুক্ত। তিনি দোষী কি না, এখনও বিচার্য। কিন্তু যে অভিযোগ, যে কুকীর্তি, হাজার হাজার জ্বলন্ত ভবিষ্যতের হকের চাকরি ছিনিয়ে নেওয়ার যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, তা এককথায় ভয়ানক! কিন্তু সবটাই কি তাঁর একার? কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, গরু, কয়লা, রাইস মিলের আবহে প্রায় ১৭ কোটির ফিক্সড ডিপোজিট- অনুব্রতর এহেন জড়িয়ে যাওয়াও কি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত? অনেকেই বলবেন, সম্পত্তি তাঁর বা তাঁদের এবং তাঁদেরই পরিবারের ঘনিষ্ঠ কারও। সেখানে দাঁড়িয়ে অভিযোগ যে তাঁদের বিরুদ্ধেই উঠবে একথাও সত্য। সেখানে দল বা অন্য কেউ কেন তার দায় নেবে?
পার্থকাণ্ডে তৃণমূলের অবস্থান এবং অনুব্রত-গ্রেফতারির পরে এই জল্পনায় যেন ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে। যে বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, এই দুর্নীতি, টাকা উদ্ধার হিমশৈলের চূড়ামাত্র। তাঁরাই ফের সরব হচ্ছেন, এই দুর্নীতির গভীরে রয়েছে আরও কিছু, তা নিয়েও। এক বা একাধিক কোনও শিকড়, যা প্রতি মুহূর্তে জড়িয়ে নিয়েছে সবটা। যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও ছুড়ে বা ছিড়ে ফেলা কঠিন, এমনও বলছেন কেউ কেউ।
তাহলে? যে-সময় পার্থ দলের ব্যবস্থার খবরের পরেই নড়েচড়ে বসেছেন, আদালতকক্ষে বলেছেন সকলের শাস্তি হবে, চক্রান্তের ইঙ্গিত দিয়েছেন, ঠিক সেই সময়েই নেত্রীর পাশে দাঁড়ানোর খবরে, আশার বাণী শুনিয়েছেন চড়াম চড়াম ঢাক বাজানোর স্রষ্টা অনুব্রত। অর্থাৎ এক পথে দুই বাহনের ব্যবহার নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। কেন?
কেউ কেউ বলছেন, একজন অন্যতম নেতা। দলের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান প্রভাবশালী মন্ত্রী দিনের দিনের পর দিন (অভিযোগ অনুযায়ী) শিক্ষক নিয়োগ-সংক্রান্ত দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকার লেনদেন যদি করে থাকেন, যদি প্রমাণিত হয় তাঁর দোষ, সেক্ষেত্রে এত ঘনিষ্ট বৃত্তের নেতার কুকীর্তি জানতে পারল না দল? জানতে পারলেন না তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা? কীভাবে কোটি কোটি টাকা জমিয়ে ফেললেন, একাধিক সম্পত্তি কিনে ফেললেন কয়েক বছরেই! মন্ত্রীদের গতিবিধি নিরাপত্তার স্বার্থে রাজ্য সরকারের নজরে থাকলেও কীভাবে বেলাগাম, অবাধ দুর্নীতির শিকড়ে যাতায়াত ছিল পার্থর? প্রশ্ন উঠেছে। বিতর্ক তৈরি হয়েছে পার্থ এবং তাঁর দলের সংযোগ স্থাপনেও। তাহলে কি পার্থ একাই অপরাধী? সব তাঁর নিজের দায়? আর বাকি, অর্থাৎ তাঁর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা দল ধোয়া তুলসীপাতা! মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারি বা কোনও রাজ্যের কোনও দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা শীর্ষ নেতা বা অন্যতম মন্ত্রীর নামে কি দায় থাকে না প্রশাসন বা তাঁর দলের?
এমন প্রশ্নের মধ্যেই অনেকেই নিমজ্জিত হতে চাইছেন এই পর্বের গভীরে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, ২০১৩-২০১৪ সালের পর থেকেই মূলত মমতা-সৃষ্ট তৃণমূলের মধ্যে খানিকটা তারতম্য ঘটেছে। সারদা চিটফান্ডের ব্যাপক দুর্নীতি, নারদা-কাণ্ড খানিকটা টলিয়ে দিয়েছে তৃণমূলের সততার ভিত্তিকে।
তারপর ঘটনাপরম্পরা এবং স্মৃতির অতলে চলে যাওয়া সারদা, নারদা তৃণমূলকে পুনরুজ্জীবিত করলেও সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি এবং অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগ ব্যতিব্যস্ত করেছে ফের। অস্বস্তি বেড়েছে পার্থর মতো নেতার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে। দায় ঝাড়া গিয়েছে। সব দায় পার্থর বলে তাঁকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিঃসঙ্গ হয়েছেন বেহালার দাপুটে নেতা। কিন্তু দক্ষ সংগঠক অনুব্রত! তাঁকে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারেনি দল। কারণ, অনেকেই বলেন, বীরভূম তো বটেই, সমগ্র রাঢ়বঙ্গে মমতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবুজের ঝড় তুলতে এক এবং অদ্বিতীয় অনুব্রত। সিবিআই হেফাজতও যাঁর খুব একটা ক্ষতি করেনি। তাই, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা সাংগঠনিকভাবে দলের মারাত্মক ক্ষতির শামিল হবে। উঠেছে প্রশ্ন। অনুব্রত সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগ এবং দলের ভূমিকা আলাদা হলেও পার্থর জন্য আলাদা কেন!
এখানেই খানিকটা সহজ যুক্তি দিচ্ছেন রাজনৈতিক কারবারিদের একাংশ। তাঁদের দাবি, পার্থকাণ্ডে দল অস্বস্তিতে পড়লেও বিরোধীদের বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দানা বাঁধতে দেননি, মমতা-অভিষেকরা। কুণাল-বয়ানে রাতারাতি বদলে ফেলা হয়েছে অবস্থান। অর্থাৎ দায় পার্থর, সে যত বড়ই নেতা হোক, দুর্নীতির ঘটনায় যে কাউকে রেওয়াত করা হয় না, এই কঠোর বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে তৃণমূল। কিন্তু অনুব্রতর ক্ষেত্রে সেই অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ওই নেতার পাশে দাঁড়িয়েছে দল। কেন? অনেকেই মনে করছেন, এর পিছনে রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। আসলে, পার্থ একা দোষী! দল নয়! এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে খানিকটা ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের চেষ্টা হলেও অনুব্রত ক্ষেত্রেও যদি সেই ভূমিকা নেওয়া হয় তাহলে দলের বহু ক্ষেত্রেই একই ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে একাধিক নেতা, মন্ত্রীকে খোয়াতে হবে। সেখানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া, সংগঠনকে ধরে রাখা, একা মমতা থাকলেও কঠিন হতে পারে। আবার দলীয় কর্মীদের মধ্যে বারবার দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাওয়া মানে দল এটাকে মেনে নিচ্ছে, দোষ রয়েছে বলে প্রতিবাদ করছে না, এটা প্রমাণ হতে পারে! তাই, তৃণমূল খানিকটা ভারসাম্যের নীতিতে হেঁটেছে।
যদিও এই অবস্থানেও অশনি সংকেত দেখছেন কেউ কেউ। কেন? আসলে পঞ্চায়েত স্তর, পৌরসভা থেকে জেলা, রাজ্য নেতারা। একাধিকের বিরুদ্ধে উঠছে তোলাবাজি, টাকা নয়ছয়, দুর্নীতির অভিযোগ। চাকরির নামে টাকা তোলা, সরকারি প্রকল্পের নামে 'কাটমানি' নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগে জর্জরিত হয়েছে তৃণমূলের একটা বড় অংশ। বিরোধীদের দাবি, এই দুর্নীতি, তোলাবাজি, কাটমানি সম্পর্কে শুধু দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতৃত্ব নয়, রাজ্য নেতৃত্বও অবহিত! না হলে দিনের পর দিন কোটি কোটি টাকার কারবার, দুর্নীতি কীভাবে ঘটে? কীভাবে রাজ্যের শাসক দলের কিছু নেতার কীর্তি প্রশাসন, পুলিশের নজর এড়িয়ে যায়? তাহলে কি ছোট থেকে মাঝারির নাগাল বেঁধে দেওয়া রয়েছে বড় অথবা অতি বড় কিছুর সঙ্গে! না হলে কী ভাবে সম্ভব এমন! কোনও রাজ্যে বিরাট দুর্নীতি বা চক্রান্তের সঙ্গে শুধুই যোগ নির্দিষ্ট কারও কারও! এই নয়ছয়ের মারণ ক্যানসার যুগে যুগে যেভাবে প্রসারিত হচ্ছে, তা কি শুধুই প্রকাশ্যে আসা নেতা, মন্ত্রীদের মধ্যেই? না কি...
প্রশ্ন উঠছে। যুক্তির দাবানলে প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। তৃণমূল স্তরের আবেগযুক্ত সৎ কর্মীর মনেও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ নেতারা। তাহলে কি এই দুর্নীতির পাহাড়ের অন্দরেও রয়েছে এমন কোনও আশ্চর্য প্রদীপ, যার আলোকে শুধুই একাকী, নিঃসঙ্গ পার্থ নন, দেখা যাবে অন্য কিছুও! প্রশ্নের মায়াজালে উথালপাথাল হলেও উত্তর পেতে হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আগামী সুনামি পর্যন্ত!