অভিনয় অথবা লেখালিখি সবেতেই দক্ষ পেলে, ফুটবল সম্রাটের জীবনের যে সত্য অনেকেরই অজানা
Pele : ব্রাজিলিয়ান ফুটবল সম্রাট তিনিই
তিন মাসের বেশি হয়ে গেল মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি। টানটান লড়াই। জীবনের সবটুকু রসদ দিয়ে ফিরতে চাইছেন আশি ঊর্ধ্ব ফুটবল সম্রাট পেলে। কিন্তু মারণ রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে, সেও এবার জায়গা ছাড়তে নারাজ। একটু একটু করে কোণঠাসা হচ্ছেন সম্রাট। অথচ মাঠের যে লড়াইটা আজীবন লড়েছেন তিনি, সেটা তো নেহাৎই সহজ ছিল তাঁর কাছে। প্রতিপক্ষকে চোখের নিমেষে পাশ কাটিয়ে লক্ষ্যভেদ করা যেন জলভাত। আজও ফুটবল বিশ্বের কাছে সম্রাটের জায়গা রয়েছে অটুট।
সম্প্রতি শেষ হল টানটান উত্তেজনার একটা মাস। একটা বিশ্বজয়ের জার্নি। নীল সাদা শিবিরের হয়ে লড়াই জিতলেন মেসি। চলতি বিরোধ মেসি না রোনাল্ডো তার একপ্রকার ইতি টানতে চাইছেন এখন অনেকেই। কিন্তু এতকালের ফুটবল ইতিহাসের আরও যে লড়াইটা রিয়ে গিয়েছে তার ইতি টানবে কে? আজও ময়দানের ইতিউতি শোনা যায় সে বিরোধ। মারাদোনা নাকি পেলে? বিতর্কের অবসান বুঝি আর সম্ভব নয়। যাদের নিয়ে এত বিতর্ক তার একজন চলে গিয়েছেন ইতিমধ্যেই, অন্যজন দাঁড়িয়ে জীবনের এক খাদের ধারে। এখনও লড়ছেন তিনি, এটুকুই যা সান্ত্বনা।
পেলে, এ নামটুকুই যেন যথেষ্ট। সাদা চামড়ার সঙ্গে কালো চামড়ার যে প্রচ্ছন্ন লড়াইয়ে আজীবন সাদার পাল্লাটা ভারী ঠেকেছে আমাদের, এই একটা নামে এসে যেন পাশার সব দান উল্টে যায়। জিতে যান কালো চামড়ার পেলেই। ফুটবল বিশ্বের সম্রাটের মুকটটাও জ্বলজ্বল করে তাঁরই মাথায়।
ব্রাজিলের দস্যু নয়, ব্রাজিলের হিরো পেলে। আন্তর্জাতিক মহলে খেলোয়াড়ী জীবনের শুরু হয় ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই। বিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা। সে ম্যাচে ২-১ গোলে হেরে গেল ব্রাজিল। কিন্তু ওই একটি মাত্র গোলেই নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন পেলে। মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোলটি করে তিনি অর্জন করলেন আন্তর্জাতিক ময়দানে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার শিরোপা। ফুটবল বিশ্ব বুঝি সেইদিনই আঁচ করতে পেরেছিল ময়দান সাক্ষী হতে চলেছে একটা ঝোড়ো সফরের। হলও ঠিক তাই। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে ৯২ টি হ্যাট্রিক, ব্রাজিলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা, ব্রাজিলের হয়ে তিনবার বিশ্বকাপ জয় সহ অজস্র পরিসংখ্যানগুলোর দিকে ফিরে তাকালে আজ শুধু অবাক হতে হয় এমন নয়। দেশ কাল সীমানা বেড়া ভেঙে গিয়ে যেন নিমেষেই একজন ফুটবল প্রেমীর গর্ববোধ হয়। এছাড়াও ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮৩ টি গোল করে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও জায়গা করে নিয়েছেন পেলে।
আরও পড়ুন - কখনও বিশ্বজয়, আবার হতাশা, মারাদোনা-মেসির আর্জেন্টিনা যেন বিশ্বকাপের হাসি কান্নার ককটেল
ছাপোষা মধ্যবিত্তও, একেবারে নিম্নবিত্ত ‘বস্তির ছেলে’ পেলে। ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্ম হয় পেলের। পুরো নাম ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্তো’। বাবা ছিলেন জোয়াও রামোস দো নাসিমেন্তো ওরফে ডনডিনহোএবং মায়ের নাম সেলেস্তে আরান্তেস। দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন পেলে। ফুটবল শিক্ষার শুরুটা হয় বাবার হাত ধরেই। পেলের বাবা নিজেও ছিলেন একজন ফুটবলার। পেলে আজীবন তাঁর বাবাকেই ফুটবল গুরু হিসেবে মেনে এসেছেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডসনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছিল পেলের। পাড়ার বন্ধুরা তাকে ডাকত ‘ডিকো’ নামে। ছোট থেকেই অভাব অনটনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন ডিকো। একে বস্তিতে থাকা ছোট্ট পরিবার, তাই আবার বড় ছেলে। তাই পেলের ঘাড়ে ছিল সংসারের বোঝা। অভাবের টানে চায়ের দোকানে কাজ করেছেন পেলে। কাজ করেছেন প্লাটফর্মের ঝাড়ুদার হিসেবেও। এমনকী পথ চলতি মানুষের জুতো পরিষ্কার করেও সংসার টানতে হয়েছে কিংবদন্তি পেলেকে। কিন্তু ভাগ্যদেবতা হয়তো নিয়ন্ত্রণটা ঠিক সময় করেছিলেন, তিনি বুঝেছিলেন জাত খেলোয়ার পেলে। তাই ভাগ্যের চাকাটা তো ঘোরবারই ছিল। যে ছেলেটা একদিন পয়সার অভাবে মোজার মধ্যে কাগজ ভরে ফুটবল বানিয়ে অনুশীলন করতেন, সময় ক্রমেই তাঁকে বানিয়ে দিল খোদ ফুটবল সম্রাট। আজ তাঁর পা স্পর্শ করা ফুটবলকে ছুঁয়ে দেখার জন্য গোটা বিশ্ব তোলপাড়।এহেন একজন সম্রাটের খেলার জীবন নিয়ে সমসময় চর্চা হয়েছে। কিন্তু তাঁর জীবনের আরও অনেক দিক, যেগুলো তথাকথিতভাবে অনালোচিত সেগুলো রইল এই প্রতিবেদনে।
জনেন কি আজকের সম্রাটকে একদিন মাঠ থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল? সময়টা ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন। দর্শকের আসনে উপচে পড়া ভিড়। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায় চলছিল প্রীতি ম্যাচ। পেলে খেলছেন সান্তোস এফসিতে, অপরদিকে রয়েছে কলম্বিয়ান অলিম্পিক স্কোয়াড। তখনও লাল কার্ডের প্রচলন হয়নি খেলায়। তাই কলাম্বিয়ার একজন ডিফেন্ডারকে ফাউল করা এবং তাঁকে অপমান করার অপরাধে সোজা মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরোয়ানা নেমে এসেছিল পেলের ওপর।
পেলের নিজের লেখা থেকেই জানা যায়, বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী জন লেনন এবং বিটলস নাকি দেখা করতে চেয়েছিলেন পেলের সঙ্গে। পেলে স্মৃতিকথা লিখেছেন ২০০৭ সালে। পেলে বলেছেন, জন লেনন তাকে বলেছেন ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ চলার সময় লেনন এবং বিটলসের অন্য শিল্পীরা হোটেলে গিয়ে ব্রাজিলের টিমের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সেবার বিশ্বকাপ হয়েছিল ইংল্যান্ডে। যদিও শেষমেশ ব্রাজিল অ্যাসোসিয়েশনের অনুমতি না মেলায় দেখা হয়নি দুপক্ষের। শুধু তাই নয়, পেলের আরেকটি আত্মজীবনী থেকে জানা যায় একসময় তাঁর দল সান্তোস এফসি একের পর এক প্রীতি ম্যাচে অংশ নিত সে সময়ে। যা যুদ্ধ বিদ্ধস্ত নাইজেরিয়াকে যুদ্ধবিরতির আলোর দিশা দেখিয়েছিল। অথচ কখনও সারা জীবনে ইউরোপের কোনও দলে খেলেননি পেলে। যদিও এ বিষয়ে সমালোচকরা অন্য কথা বলেন। তাঁরা বলেন এটাই নাকি পেলের জার্নি এতটা সহজ হয়েছিল। কিন্তু আসল কথা হল, পেলেকে ব্রাজিলে রেখে দেওয়ার জন্য চাপ ছিল সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। ১৯৬১ সালের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদ্রস পেলেকে "জাতীয় সম্পদ" হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাকে "রপ্তানি করা যাবে না" বলে একটি ডিক্রিও জারি করেছিলেন বলেই শোনা যায়। অথচ এই এতো কিছুর পরও অধিনায়কের শিরোপা পেয়েছেন ফুটবল জীবনের একেবারে উপান্তে এসেই। অর্থাৎ ৫০ বছর বয়সে। এর আগে যতবারই তাকে অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, প্রত্যেকবারই প্রত্যাখ্যান করেন পেলে। কিন্তু তার ব্যতিক্রম ঘটে ৫০ বছর বয়সে এসে। সেটা ছিল ১৯৯০ সালের ঘটনা, জাতীয় ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার ১৯ বছর পরে।
আরও পড়ুন - ফাইনালে মেসির গোলটি কি অবৈধ? আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স সমর্থকদের তর্কে তুলকালাম সোশ্যাল মিডিয়ায়
খেলোয়াড় পেলেকে আমরা সকলেই চিনি লেখক পেলেকেও। বারবার তাঁর আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন খেলোয়াড় জীবনের বিশদ বিবরণ। ওঠা পড়া উচ্ছ্বাস উত্তেজনা সবকিছুই রয়েছে পেলেকে ঘিরে। কিন্তু জানেন কি তিনি খেলা ছাড়ার পর অভিনয় করেছিলেন?
১৯৮০ সাল, ‘এসকেপ টু ভিক্টরি’ ছবির শুটিং চলছে। অভিনয় করছেন তৎকালীন চলচ্চিত্রাঙ্গনে খ্যাতির তুঙ্গে থাকা সিলভেস্টার স্ট্যালোন। এই ছবিতেই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ের নাৎসি একাদশ ও বন্দীদের মধ্যে একটি কাল্পনিক ফুটবল ম্যাচের গল্প তুলে ধরা হয়। সেখানেই অভিনয় করেন খোদ পেলে। শুধু তাই নয়, এ ছবিতে অ্যাক্রোবেটিক বাইসাইকেল কিক দৃশ্যে প্রথম শটেই সফল হন পেলে। এমনকী ছবির স্ট্রাইকার স্ট্যালোনকে গোল দিতেও শিখিয়েছিলেন পেলেই।
পেলের জীবনে ওঠা পড়ার শেষ নেই। পরতে পরতে রোমাঞ্চ। সেই বস্তু থেকে শুরু করে ফুটবলের ময়দানে দাপুটে ভূমিকায় পেলে আজীবন স্বপ্ন ছোঁয়ার খুব কাছাকাছি রেখেছেন নিজেকে। ছুঁয়েছেনও বারংবার। খেলাধুলার পাশাপাশি লেখালিখি এবং অভিনয় যখন যতোটুকু সুযোগ পেয়েছেন চেটেপুটে উপভোগ করেছেন সবটুকু রসদ। এখানেই শেষ নয় রাজনীতির অঙ্গনেও পেলেকে দেখা গিয়েছে স্ব ভূমিকায়। ১৯৯০ সালে সাংবাদিকদের কাছে পেলে ঘোষণা করেছিলেন, ব্রাজিলে ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন তিনি। যদিও সে সুযোগ হয়নি, কিন্তু রাজনীতি জীবনে পা রেখেছিলেন ঠিকই। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই তিন বছর ব্রাজিলের ক্রীড়া মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার নেতৃত্বেই ব্রাজিলের ফুটবলের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য নতুন আইন পাস হয়। যার নাম ‘পেলে আইন’।
১৫ কেজি ওজনের একটি আত্মজীবনী লেখেন পেলে, আর তাতেই তুলে ধরেন তার জীবনের সমস্ত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব। ফুটবল জীবনের মোট গোল সংখ্যার হিসেবেই বইটির নাম রাখেন ‘১২৮৩’। এ বইতে ৫০০ টি বহুমূল্য ছবির পাশাপাশি অনেক নামজাদা ফুটবলারদের সই ও সংগৃহিত রয়েছে। ২৫০ ইউরো ধার্য করা হয়েছে এর দাম। সারা জীবন অজস্র সম্মানের সম্মানিত হয়েছেন পেলে। শতাব্দীর সেরা অ্যাথলিট থেকে শুরু করে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, কি নেই তাঁর দখলে! আর সব থেকে বেশি যেটা রয়েছে তা হল অগুনতি মানুষের প্রাণ ঢালা ভালোবাসা। ফুটবল জীবনের প্রতিটি পরতে তিনি মানুষের কাছে উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে তাই আজও জীবনের এই পর্যায়ে এসে যখন হাসপাতালে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ৮০ ঊর্ধ্ব পেলে, তখনও গোটা বিশ্ব অপেক্ষা করে আছে একটা মাত্র মিরাক্কেলের জন্যই।